×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ক্যান্সারের ম্যাজিক ওষুধ: বিজ্ঞানীর চোখে আশা, দুরাশা, নিরাশা, হতাশা 

    সুস্মিতা ঘোষ | 13-06-2022

    নিজস্ব ছবি

    একটা ম্যাজিক বড়ি নাকি সমস্ত রোগীর ক্যান্সার নির্মূল করে দিচ্ছে! বহু খবরের কাগজ ও মিডিয়া চ্যানেলের হেডলাইন, বহু ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ, এবং সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট এবং ফরওয়ার্ড তো তাই বলছে! কত জন যে আমাকে জিজ্ঞেস করল এটা সত্য কিনা! ম্যাজিক যেমন ছলনা, এই ম্যাজিক বড়ির প্রচার ও তেমনি আশার ছলনে ভোলানোর প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়।


     

    কল্পনা করুন একটা যেন ক্রিকেট কোচিং সেন্টার - লোকমুখে প্রচার তাদের ছাত্ররা সবাই ছক্কা মারতে  ওস্তাদ। কোনও  ম্যাচে তাদের টিমের সবাই দুই ইনিংসে ছক্কা মেরেছে। ছক্কা মারার ঘটনাটা সত্যি, কিন্তু যেটা লোকে বুঝল না, যে সেই খেলায় বেছে বেছে যে 11 জনকে পাঠানো হয়েছে তারা সবাই ন্যাশনাল লেভেল এ খেলে। অন্য পক্ষের সবাই পাঁচমিশেলি। 

     

    মিল পাচ্ছেন কি? বারোজনের মধ্যে  বারোজনের ই ক্যান্সার সেরে গেল! তারা কি যে সে বারোজন? অবশ্যই না। এই যে বারোজন রোগীকে সিলেক্ট করা হয়েছে, তার পিছনে অনেক গুলো সাধারণ বিচার্য ধর্ম বা প্যারামিটার আছে। সেগুলো কী, কীভাবে স্থির করা হয় বুঝতে গেলে বিজ্ঞানের চোখে বেশ কিছু ব্যাপার বোঝা দরকার। 


     

    ক্যান্সার কী? 

    ক্যান্সার এক শ্রেণীর অসুখ, যেখানে শরীরের একটি জায়গায় অস্বাভাবিক ভাবে কোষ বিভাজন হতে থাকে। একজায়গায় অতিরিক্ত কোষ পিণ্ডাকার নিলে তাকে বলে টিউমার। আরো বাড়তে দিলে সেই অস্বাভাবিক কোষগুলি আস্তে আস্তে নিকটতম লিমফ নোড বা লসিকাগ্রন্থিতে পৌঁছয় এবং তারপর  শরীরের অন্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে শরীরের অভ্যন্তরীণ স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হতে হতে মৃত্যু ডেকে আনে। 


     

    অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন বলতে কী বোঝায়? 

    স্বাভাবিক ভাবে যখন কোনো কোষ বিভাজিত হয়, যেটা স্বাভাবিক বৃদ্ধি, বা ক্ষয় পূরণের জন্য প্রয়োজনীয়, সেখানে একটি কোষ দ্বিভাজিত হয় নিখুঁত ভাবে। এই দ্বিভাজনের ঠিক আগেই কোষটির প্রতিটি ক্রোমোজোমের যে সুতোর মত DNA, তা নিখুঁত ভাবে এক কপি থেকে দু কপি হয়, DNA তে A, T , G C এই চার বেস রূপী বর্ণমালা দিয়ে যে নির্দিষ্ট সিকোয়েন্স এ জিনের সংকেত লেখা থাকে তা নিখুঁতভাবে কপি হয়। যখন আমরা টাইপ করি, কিছু কিছু টাইপো তো থেকেই যায়, যেটা আমরা পরে পরেই বা প্রুফ রিডিং এর সময় সংশোধন করে নিই। জিনের কপি করার সময়েও এরকম টাইপো ঢোকে, এবং তাকে সংশোধন করার জন্যে নানা ধরণের নির্দিষ্ট যন্ত্রপাতি আছে। আমরা জানি যে DNA হল দুই সুতোর বেণী "double stranded, double helix", এবং এখানে দুই সুতোর বেণী পাকানোর কারণ হল একটি সুতোতে যদি A থাকে, অন্য সুতোর  যেখানে T থাকবে সেখানেই সে জোড় বাঁধবে। পুরো সুতোটা বিনা গেরোতে বিনুনি পাকানো সম্ভব হয় কারণ একটি সুতোর জিনের যা সিকোয়েন্স, অন্য সুতোতে তার ঠিক "উল্টো" অর্থাৎ, যেখানে যেখানে A, ঠিক সেখানে সেখানে T, যেখানে T সেখানে A, যেখানে G, তার উল্টোতে C এইরকম ভাবে থাকে এবং তার কোনো নড়চড় হয় না। দৈবাৎ যে সব টাইপো ঢুকে পড়ে, তার ও নানা রকম হয়, বেশি অক্ষর আসা, অক্ষর বাদ যাওয়া, ভুল অক্ষর বসা, এইরকম। এই যে ভুল অক্ষর বসল, তার জন্যে কি হল, না বিপরীত সুতোটির সাথে ওই জায়গাটাতে জোড়বাঁধাটা ঠিক মত হল না- "mismatch" হল। শুধু এই mismatch কে খুঁজে বার করে সূক্ষ্ম ভাবে কেটে, সেখানে ঠিকঠাক বর্ণ বসানোর জন্যেই আলাদা একরকম যন্ত্রপাতি আছে কোষের মধ্যে (চিত্র ১)।

     

     

    আরো নানা রকম ভুল চেক করার জন্যে এবং ঠিক করার জন্যে অজস্র আলাদা আলাদা যন্ত্রপাতি থাকে কোষের মধ্যে। এদের জন্যেই কোষের দ্বিভাজন নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হতে পারে- নতুন তৈরি দুটি কোষে যে ক্রোমোজোমগুলি থাকে, তারা তাদের মাতৃকোষটির সঙ্গে সংখ্যায় অভিন্ন, তাদের DNA অভিন্ন। যদি ভিন্নতা আসে, তাহলে সেটা অস্বাভাবিক বিভাজন। অনেক সময়ে প্রকৃতি এই অস্বাভাবিক কোষ গুলোকেও ধরতে পারলে ধ্বংস করে ফেলে, সে ব্যবস্থা ও আছে। এই সব ভুল সংশোধন করার যেসব যন্ত্রপাতি, তাদের কেউ অকেজো হয়ে গেলে ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। 

     

    আরও পড়ুন:ক্ষত নিয়ে সাবধান হলে ক্ষতি করবে না স্ক্রাব টাইফাস


     

    ক্যান্সারের চিকিৎসা কী? 

    অস্বাভাবিক কোষকে নির্মূল করতে পারলেই ক্যান্সার সেরেছে বলা যেতে পারে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিউমারকে চেঁচে ফেলে নিকটবর্তী লসিকাগ্রন্থি ও বাদ দেওয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষেত্রে করা হয়। যদি তারপরেও অস্বাভাবিক কোষ থেকে যায় এই আশংকায় এমন কিছু ওষুধের প্রয়োগ করা হয়, যারা প্রায় নির্বিচারে বর্ধমান কোষকে নির্মূল করে। তাতে অস্বাভাবিক কোষ তো মরেই, আবার চুলের গোড়ার, অন্ত্রের ভেতরের আস্তরণ এর, এমনকি মজ্জার কোষ ও, যারা রক্ত তৈরি করে, তাদের মেরে ফেলতে পারে। এই চিকিৎসাকে কেমোথেরাপি বলে।  অনেক সময়ে অস্ত্রোপচারের পরেই, বা কেমোথেরাপির পরে যে যে জায়গায় টিউমার ছিল, সেখানটা তেজস্ক্রিয় রশ্মি দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ওপরের তিনটি চিকিৎসা আলাদা বা সম্মিলিত ভাবে এখন অনেক ক্যান্সার কেই নির্মূল করতে সক্ষম। তবুও তিনটি চিকিৎসাই যন্ত্রণাদায়ক তো বটেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রচুর। একটা বিরাট কারণ হল, পরের দুটি চিকিৎসা নিজের টার্গেট এর বাইরে সুস্থ স্বাভাবিক কোষগুলিকে মেরে ফেলে। তাহলে কি এমন কিছু চিকিৎসা বার করা যায়, যেটা শুধু মাত্র অস্বাভাবিক কোষকে টার্গেট করে সেটুকুই নির্মূল করবে? 


     

    অ্যান্টিবডি এনজিনিয়ারিং

    সেই চার দশক আগে থেকেই আরো একটা ভাবনা এল, যেই জানতে পারা গেল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার রহস্য। জানা গেল যে কোটি কোটি বিভিন্ন ধরণের বাইরে থেকে অনুপ্রবেশকারী জীবাণুকে শরীর আটকায় কোটি কোটি বিভিন্ন "অ্যান্টিবডি" তৈরি করে। খোদার ওপর খোদকারি করা তো মানুষের ধর্ম, তাই প্রকৃতির দ্বারা কোটি কোটি বিভিন্ন অ্যান্টিবডি বানানোর বিজ্ঞান বা স্ট্রাটেজি বুঝতে পারার সাথে সাথে অনেক বিজ্ঞানীরই  লক্ষ্য হয়ে গেল নিজেদের মনের মত অ্যান্টিবডি এনজিনিয়ারিং করে যেখানে প্রকৃতির বানানো অ্যান্টিবডি নেই বা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়, সেখানে প্রয়োগ করে রোগ সারানো ।  

    কিছু কিছু টার্গেটের(ক্ষতিকারক জীবাণু ইত্যাদির ছোট ছোট অংশ বা বিশেষ বিশেষ প্রোটিন)এর বিরুদ্ধে ইঁদুরের শরীরে তৈরী অ্যান্টিবডির জিন বিশ্লেষণ করে জানা যায় ওই টার্গেট কে অকেজো করতে গেলে কী ধরণের জিন সিকোয়েন্স দরকার। এবার তাতে জেনেটিক এনজিনিয়ারিং করে ইঁদুরের নিজস্ব জিন বাদ দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয় এমন কিছু অংশ, যা মানুষের শরীরে ঢুকলে কোনো খারাপ প্রতিক্রিয়া করবে না- এই পদ্ধতিকে বলে humanization . মনে রাখতে হবে যে এনজিনিয়ারিং করা কৃত্রিম অ্যান্টিবডি, একে ক্ষতিকারক কারুর মোকাবিলা করার জন্যে ওষুধ হিসেবে শরীরে ঢোকালে নানা রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে- প্রথম কথা এটি এসপিরিনের মত ছোট্ট অণু নয়, শরীর একে বহিরাগত মনে করে বিদ্রোহ করতে পারে। 

    চল্লিশ বছর ধরে পদ্ধতি উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে।  পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমেছে, ডিজাইন এবং এনজিনিয়ারিং করা সহজ থেকে সহজতর হয়েছে।  কিন্তু এখনো একে উৎপাদন করতে লাগে সেল কালচার (cell culture ), যেখানে মাত্র এক ধরণেরই  (monoclonal ) অ্যান্টিবডি উৎপাদিত করা হয়- সেই কারণে এই সব ওষুধে নামের শেষে “mab (monoclonal antibody” থাকে।  বর্তমানে শয়ে শয়ে ছোট বড় কোম্পানি নানা টার্গেট এর বিরুদ্ধে কৃত্রিম অ্যান্টিবডি বানাচ্ছে। 

     

     

    ক্যান্সারের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় কৃত্রিম অ্যান্টিবডি

    ক্যান্সার মার্কার: 

    দেখা গেছে যে ক্যান্সার কোষে কিছু কিছু প্রোটিন অস্বাভাবিক বেশি মাত্রায় থাকে।  কোন একটি প্রোটিন যদি কোনো একটি বিশেষ ধরণের ক্যান্সারে অস্বাভাবিক মাত্রায় থাকে, তাহলে তাকে ক্যান্সার মার্কার বলা হয়। যে সব ক্যান্সার মার্কার প্রোটিন কোষের বাইরে থাকে, কৃত্রিম অ্যান্টিবডি দিয়ে তাকে অকেজো করা একটি চিকিৎসা পদ্ধতি।  এখন বাজারে বেশ কয়েক রকম এই ধরণের ওষুধ আছে। এদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য স্তন ও পাকস্থলীর ক্যান্সারে বহুল ব্যবহৃত Trastuzumab ওষুধটি, যেটি ১৯৯৮ সাল থেকে  Herceptin  ব্র্যান্ড নামে প্রথমে আসে আমেরিকার বাজারে, পরে অন্যান্য দেশে   

     

    আরও পড়ুন:মাঙ্কি পক্সের ভয়, জাতিহত্যার পাপ ও জৈব মারাণাস্ত্রের মারাত্মক সম্ভাবনা


     

    প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটির খেল ও PD-1

    আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থায় বহিরাগত শত্রুর মোকাবিলা করার জন্যে T এবং B নামে দুধরণের শ্বেত কণিকা রক্তে ভেসে বেড়ায় । এরা সংক্ৰমিত অস্বাভাবিক কোষগুলিকে ধ্বংস করে। এই মারমুখী কোষগুলি, বিশেষ করে কিছু বিশেষ ধরণের T কোষ যাতে শরীরের ভাল স্বাভাবিক কোষ গুলিকে ধ্বংস করতে না পারে, তাই ব্রেক হিসেবে এদের গায়ে PD-1 নামে একটি বিশেষ প্রোটিন থাকে।  যে সব কোষের PD-1 তার জুড়ি PDL (PDL-1 বা PDL-2) কে খুঁজে পায়, সেখানে PD-1 নিষ্ক্রিয় হয় পড়ে - এবং সেই কোষটি বেঁচে যায়। সুস্থ স্বাভাবিক কোষের গায়ে PDL থাকে বলে তারা এই ধ্বংস থেকে সুরক্ষিত থাকে।  এই ঘটনাকে immune checkpoint বলে। 


     

    ক্যান্সার কোষ অস্বাভাবিক হলেও দেহের প্রতিরোধ তন্ত্রকে (immune system ) কে ভাঁওতা দেবার জন্যে গায়ে PDL  সাজিয়ে বসে থাকে।  জাপানি বিজ্ঞানী Tasuku Honjo 1992 সালে PD-1 প্রোটিনটি এবং তার কর্ম পদ্ধতি  আবিষ্কার করেন। তিনি ক্যান্সার কোষকে জব্দ করার একটা নতুন ফন্দি বলেন - যদি PD-1কে অ্যান্টিবডি দিয়ে নিষ্ক্রিয় করা যায়, তবে তো দেহের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতাই ক্যান্সার কোষকে অস্বাভাবিক বলে চিনে ফেলে ধ্বংস করতে সক্ষম হবে (চিত্র ২) . ইঁদুরে এই পরীক্ষাটি সফল হওয়ায় cancer immunotherapy র নতুন দিগন্ত খুলে যায়।  এই আবিষ্কারের জন্য 2018 সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। 

    এর পর থেকেই  ছোট বড় বহু কোম্পানি নেমে পড়েছে PD-1 এর বিরুদ্ধে ওষুধ হিসেবে কাজ করানো যেতে পারে এমন mab বানানোর জন্যে। তাদের অনেকেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করার বা বাজারে আসার ছাড়পত্র পেয়েছে, অনেকে বাজারে আছে ও।  


     

    আশা 

    Pembrolizumab Dostarlimab 

    ঠিক পাঁচ বছর আগে সায়েন্স পত্রিকায় একটি রিপোর্ট বেরিয়েছিল, যে, যে সব ক্যান্সার রোগীর কোষে DNA কপি করার সময়ে mismatch সংশোধন হয় না কিছু মিউটেশনের জন্য (MMRd, চিত্র 1), সেই সব রোগীর শক্ত টিউমার সারাতে PD-1 বিরোধী mab Merck এর Pembrolizumab ভালো ফল দেখাচ্ছে। এই আশাপ্রদ ফল 86 জন রোগীর নানা ধরণের ক্যান্সারে, বৃহদন্ত্র ও মলদ্বারের, এমন কি সবচেয়ে ভয়ংকর অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে ও দেখা গেছে। এই সব রোগীদের আগের চিকিৎসায় ক্যান্সার নির্মূল হয় নি, কাজেই  20% ক্ষেত্রে 2 বছরের মাথায় ক্যান্সার অন্ততঃ ক্যান্সার অদৃশ্য হয়েছে বা আর বাড়ে নি কে  আশাপ্রদ ফলই বলা উচিত।

     

    এই গবেষণাটির মূল  গবেষক ডঃ ডিয়াজ এর মাথায় এল যে Pembrolizumab নিয়ে এই গবেষণা বা ট্রায়ালটি তো শুরুই হয়েছিল সেই রকম রোগীদের নিয়ে, যাদের অস্ত্রোপচার, কেমো, রেডিয়েশন ইত্যাদি করার পরেও কোনও লাভ হয় নি, এবং লাভ না হওয়ার একটা কারণ সম্ভবতঃ ওই  MMRd  তাহলে MMRd সংবলিত কিছু রোগী নিয়ে একটা ট্রায়াল করে দেখাই যাক না, যাদের সবে ক্যান্সার ধরা পড়েছে, এখনো কোনো চিকিৎসা শুরু হয় নি।  দেখাই যাক না এই রকম কোনো PD-1 বিরোধী mab দিয়ে, সেই চিকিৎসার পরে কি কি লাভ হয়? অস্ত্রোপচার কেমো ইত্যাদি আর লাগে কিনা ? 


     

    এরকম ট্রায়ালে রিস্ক প্রচুর।  একে তো ওই MMRd  পাওয়া যায় মাত্র শতকরা চার ভাগ ক্যান্সার রোগীর মধ্যে।  তার ওপর প্রথম স্টেজের ক্যান্সার, যেখানে অন্য চিকিৎসাতে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে, সেখানে খামখা একটা নতুন চিকিৎসায় সময় নষ্ট করতে রাজি হওয়ার লোক পাওয়া মুশকিল হবে।  ডিয়াজ এর এই আবেদনে বড় কোম্পানিরা সাড়া দিল না, সাড়া দিল Tesaro নামে একটি ছোট্ট কোম্পানি।  তারা তাদের নিজস্ব mab, dostarlimab নিয়ে ট্রায়াল করতে রাজি হল।  এরা এই ওষুধটি তার আগে জরায়ু ক্যান্সারে যেসব রোগীর অস্ত্রোপচার ইত্যাদি চিকিৎসায় কাজ হয় নি, MMRd আছে, তাদের ওপর ট্রায়াল করে কিছুটা আশাপ্রদ ফল পাচ্ছিল। 


     

    ট্রায়ালের সাবজেক্ট জোগাড় করতে সময় লাগল।MMRd ওয়ালা মলদ্বারে এমন ক্যান্সার যেটা শুধু ওখানেই সীমাবদ্ধ আছে (স্টেজ 2) বা বড়জোর কাছাকাছি লসিকাগ্রন্থি অবধি ছড়িয়েছে (স্টেজ 3)   ২০২০ তে মাত্র ১৮ জন নিয়ে শুরু হল।  6 জন মাঝপথে বেরিয়ে গেল।  বাকি 12 জনকে না, মাত্র একটি বড়ি নয়, ছ মাস ধরে কড়া নজরদারিতে দু সপ্তাহ অন্তর অন্তর Dostarlimab দেওয়া চলল।  অস্ত্রোপচারের সব ব্যবস্থা রেডি রাখা হল। ছয় মাসের মাথায় এই বারোর জনের কারও কোনও টিউমারই কোনও পদ্ধতিতে খুঁজে পাওয়া গেল না এবং দু বছরের মাথায় নতুন কোনো টিউমার দেখা যায়নি। ও হ্যাঁ, এই ট্রায়াল চলাকালীনই GlaxoSKB কিনে নিয়েছে টেসারোকে! পোয়াবারো টেসারোর!    


     

    দুরাশা 

    Dostarlimab কি সত্যিই ম্যাজিক ওষুধ ? যেমন গোড়াতে বলেছি, ম্যাজিক বিভ্রম মাত্র। সবার জন্য সব ওষুধ যে নয় আমরা তো সবাই জানি। সব রকম ক্যান্সার এক নয়, কাজেই সব ক্যান্সারের এক ওষুধ হতে পারে না। 

    Dostarlimab-Pembrolizumabএর কাহিনী থেকে এটুকুই জানলাম এখনো পর্যন্ত প্রমাণিত ক্যান্সার রোগীদের 4% এর, যারা MMRdর কারণে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির সুফল থেকে বঞ্চিত, তাদের ক্ষেত্রে আশার আলো দেখা গেছে। তাও তো মাত্র দু বছর হল।  দু বছরে কি এখনকার চিকিৎসা শাস্ত্র কাউকে ক্যান্সার-মুক্ত  ঘোষণা করতে পারে? নজরদারি তো আরো অনেক বছর চলে! এখানেও চলছে এবং চলবে। মাত্র বারোজনকে নিয়ে যে ট্রায়ালটা হল এটা মাত্র ফেজ ২  আরো কম করে একশ-হাজার জনে ট্রায়াল করে দেখাই যাক না সেখানে শতকরা কত সফলতা আসে। সংখ্যাতত্বের নিয়ম অনুযায়ী বেশি সংখ্যা হলেই শতকরা সফলতা কমবে।  100 শতাংশ দূর অস্ত্  

     

    আরও পড়ুন:আতঙ্কের নয়া নাম মাঙ্কি পক্স


     

    যে কোনও ক্যান্সারে সফলতা? এ পর্যন্ত পাওয়ার নিরিখে নতুন ট্রায়াল নিশ্চয়ই চলছে, কিন্তু এখনো তো কিছু শুনিনি। এই মুহূর্তে সব ক্যান্সারে সফলতা, কারুর অস্ত্রোপচার পর্যন্ত লাগবে না এটা ভাবাই  এই মুহূর্তে দুরাশা। এছাড়া বিজ্ঞানীদের সাবধান বাণী তো আছেই। PD-1 বস্তুটি প্রকৃতি সৃষ্টি করেছিল অহেতুক যাতে সুস্থ কোষের বিরুদ্ধে শরীরের নিজস্ব ক্ষমতা চাগিয়ে না ওঠে- অর্থাৎ autoimmunity যেন না দেখা যায়। শরীরে PD-1 এর আরো অনেক অজানা ভূমিকা অবশ্যই আছে, যার থেকে শরীরে সাম্যাবস্থা বজায় থাকে।  PD-1 কে নিষ্ক্রিয় করলে সাম্যাবস্থা কিছুটা তো ব্যাহত হয় ই।  হয়ত সেই কারণেই বহু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। 

    এক বড়িতে ক্যান্সার জব্দ? অলীক ভাবনা।  খাওয়ার বড়িতে অ্যান্টিবডি দিলে সে হজম হয়ে যাবে, রোগ সারানোর সুযোগ পাবে না।  মাত্র একটা ডোজ? ক্যান্সার ধীরে ধীরে বাড়ে, ধীরে ধীরে সারে।  এই ওষুধটি ছয় মাস ধরে দেওয়া হয়েছিল। বহু কেস এ নানা সময় ধরে ওষুধ দেওয়ার পরীক্ষা না করলে তো সময় কমানোর প্রশ্নই ওঠে না। 



     

    নিরাশা 

    এই সব mab জাতীয় বায়োটেক ওষুধ অসম্ভব দামি।  দামের একটা বিরাট অংশ আসে যে কোম্পানি বাজারে আনছে তাদের লাইসেন্সের মূল্য থেকেভারতীয় বিজ্ঞানীরা এসব আবিষ্কারের টিমে আছেতবে নিজের দেশে নয়, বিদেশে! আমাদের দেশের জন সংখ্যার তুলনায় বায়োটেক কম্পানির সংখ্যা নগণ্য। যা আছে, তাতেও গবেষণা, বিশেষ করে বছরের পর বছর ধরে যে সব হাই রিস্ক গবেষণা চলে, তাতে বিনিয়োগের পরিমাণ খুদকুঁড়ো। শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান? তাদের সরকারি অনুদান ও গত কয়েক বছরে একেবারে তলানিতে দাঁড়িয়েছে- সমস্ত মৌলিক গবেষণা বন্ধ হওয়ার মুখে। কাজেই আত্মনির্ভর ভারতের নিজস্ব গরিবের সামর্থ্যের মধ্যে mab ওষুধ এই মুহূর্তে অলীক বাসনা ছাড়া কিছুই নয়।  

    আর একটা বিরাট আশংকা থেকে যাচ্ছে। গরিব দেশ ভারতে টাকার প্রতিশ্রুতিতে কত জনকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হয় ? সংখ্যাটা কেউ বলতে পারবে না কারণ পুরো বাজারটাই ধোঁয়াশার। গরীব নয়, অশিক্ষিত নয় এমন মানুষকেও অজান্তে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে তার নজির আছে অনেকেরই ব্যক্তিগত বৃত্তের মধ্যে। ভারতে এই মুহূর্তে একটা বড় ব্যবসা হল ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (CRO) র - যাদের বিদেশি ওষুধ কোম্পানিরা আউট সোর্স করে তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করার জন্যে।  ভারতের পেশাদুরস্ত ব্যবহারের অভাবের অভিযোগ অনেক বিদেশী কম্পানি করবে সন্দেহ নেই, কিন্তু নাম মাত্র খরচায় ট্রায়ালের জন্যে রোগী পাওয়াতে সব পুষিয়ে যায়।  এথিক্স সেখানে কাগুজে একটা শব্দ মাত্র হয়ে দাঁড়ায়।  


     

    হতাশা 

    হতাশ লাগছে গত কয়েকদিনে ম্যাজিক ওষুধ নিয়ে উন্মাদনা দেখে।  অনেক শিক্ষিত লোকই শুধু মাত্র হেডলাইন দেখে খবরটা নিয়ে ভাল করে ভেবে না দেখেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ফরওয়ার্ড করা শুরু করেছে- কি, না এমন ওষুধ বেরিয়ে গেছে, যাতে প্রতিটা ক্যান্সার রোগীই ভাল হয়ে গেছে। 12 তে 12 জন সুস্থ হলেই লক্ষ জনে লক্ষ জনই সুস্থ হবে না একশো  জনে একশো  জনও হবে কিনা সন্দেহ! 

    জনগণের স্মৃতি শক্তি কি বড়ই দুর্বল, না এখনকার জনগণ শুধু মিডিয়া যখন যা খাওয়ায় তাই বিশ্বাস করে?  ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বস্তুটার সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় হয়েছে covid-এর দৌলতে ।  ভ্যাকসিন ট্রায়ালে তো 12 জনের চেয়ে অনেকে বেশি জন অংশগ্রহণ করেছিল। অথচ তখন ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করেছে। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কোটি কোটি মানুষের মধ্যে হয়ত গোটা কুড়ি জনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তার পরেও ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে  এমন অনেককে দেখছি পরম উল্লসিত - ক্যান্সারের ম্যাজিক ওষুধ বেরিয়ে গেছে!


     

    পুনশ্চ : এই লাফালাফিটা শুধু মিডিয়ার। যে পত্রিকাতে  ( New England Journal of Medicine) এই 12  জনের ট্রায়ালের রিপোর্ট বেরিয়েছিল, তারা নিজেরাও বলেছে যে, আরও অনেক জনের মধ্যে অনেক দিন ধরে ট্রায়াল করে একই ফল পাওয়া যায় কিনা দেখা দরকার  এ ছাড়া অন্য কোন নামী বৈজ্ঞানিক পত্রিকাতে কোনো লাফালাফি নেই।   


     

    চিত্রাঙ্কন: লেখক 

     

    (ড: সুস্মিতা ঘোষ ডায়াগনোরাইট-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং জৈব-রসায়নবিদ। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের প্রাক্তন পোস্ট ডক্টরাল ফেলো। সুস্মিতার ডায়াগনোরাইট সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত একটি স্টার্ট-আপ সংস্থা, যার লক্ষ্য সকলের জন্য সুলভে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ডায়গনস্টিক্স।)


    সুস্মিতা ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    সংক্রমণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আর রোগের পরিসংখ্যানের তাৎপর্য বোঝে না সাধারণ মানুষ, সুযোগ নেয় মেডিক্যাল

    আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আত্মচরিত: একটি বিস্মৃত বই যা আজও প্রাসঙ্গিক

    দেশের সর্বত্র আইসক্রিম পাওয়া গেলে ভ্যাকসিন বণ্টনও অবশ্যই সম্ভব

    কোনও ঢাকা না থাকলে করোনা সোজা বর্ষিত হতে পারে মাথায়, মুখে, নাকে, হাতে

    তিনটির মধ্যে একটি ভ্যাকসিন নিয়ে বহু প্রশ্ন

    পালস এবং অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গেলেই সাবধান হওয়া জরুরি।

    ক্যান্সারের ম্যাজিক ওষুধ: বিজ্ঞানীর চোখে আশা, দুরাশা, নিরাশা, হতাশা -4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested