হিন্দুকুশ আর হিমালয়— স্বতন্ত্র হতে গিয়েও যেন মিলে গেছে। এই মিলে যাওয়ার প্রয়াস তো আজকের নয়৷ ইতিহাস প্রসিদ্ধ রেশম পথ দিয়ে যে চলাচলের শুভারম্ভ হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে আরও নিবিড় হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা তো বিদেশ বিভুঁইয়ের ‘খোঁকি'র মধ্যে নিজের মেয়েকে দেখেছেন। ভাগ্যিস তখন ধর্মান্ধগুলো ক্ষমতার ত্রহ্যস্পর্শে আসেনি, কোতোয়াল সেজে হাতে মাথা কাটেনি।
কিন্তু এভাবে তো মেলার কথা ছিল না। এই অনুভূতিটা অনেকখানি জানা অঙ্কের উত্তর মেলাতে না পারার মতোই। অনেক পণ্ডিত বলেন, একদা রুখা সুখা আফগানিস্তান আর শস্যশ্যামলা ভারতের অন্তরপথ দিয়ে অন্তঃসলিলা সরস্বতী প্রবাহিত ছিল। সেই পুরাণের হারিয়ে যাওয়া সরস্বতী, ইতিহাসের প্রহেলিকা সরস্বতী। কুটিল রাজনীতি, ধর্মান্ধতা তার গতিপথকে কবেই রুদ্ধ করে দিয়েছে। তবুও মিলেছে তারা ফতোয়ায়, মিলেছে দারিদ্রে।
আফগান মুলুকে আবার তালিবানি শাসনের ভ্রুকুটি দেখা দিয়েছে। মার্কিন সেনা সরে যাওয়ার পর থেকেই দেশের উত্তর প্রান্তের বহু প্রদেশ তালিবানদের কব্জায়। পাশাপাশি যে খবরটা অতটা প্রচারমাধ্যমে তেমন আসছে না, সেটা হল— স্থানীয় গ্রামবাসীদের একাংশ তাঁদের স্বল্প সামর্থ্য নিয়েও তালিবানদের এই ফিরে আসাটাকে রুখতে চাইছেন, প্রাণপণে। কেন? কারণ তালিবান আর ফতোয়া সমার্থক। তালিবান মানে বোরখার অন্তরালে থেকে যাওয়া নারীদের চৌখুপি পৃথিবী, তালিবান মানে ধর্মের যূপকাষ্ঠে শতসহস্র নিরীহের বলিদান, অবাধ যৌন পীড়ন ইত্যাদি।
আরও পড়ুন: নীলকন্ঠ পাখিদের ‘অবিচুয়ারি’
ওদিকে ‘দার-উল-ইসলাম'-এর রণহুংকার শুনেছি আমরা। এদিকে শুনছি ‘অখণ্ড ভারত'-এর আস্ফালন। এ পারে মুড়ি মুড়কির মতো যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে না ঠিকই, চিলের মতো অতর্কিত ক্ষেপনাস্ত্র হানায় নির্বিচারে মরতেও হচ্ছে না, কিন্তু প্রতিনিয়ত মরিয়া প্রমাণ করতে হচ্ছে যে, এই দেশের নাগরিক, গণতন্ত্র, কেউ মরেনি, জিন্দা আছে। না হলে শাসকের সমর্থনে জিন্দাবাদ বলবে কারা? এই মুলুকে মেয়েদের বোরখায় মুখ ঢাকতে হয় না, কিন্তু রাত করে বাড়ি ফিরলে কৈফিয়ত দিতে হয়। এখানে তাদের তালিবান যোদ্ধাদের যৌনদাসী হতে হয় না, তবে উচ্চবর্ণের ছেলেপুলেরা দলিত মেয়েদের ওপর দমন-পীড়ন করলে একটু সয়ে নিতে হয়। এছাড়াও মুসলিম হয়ে গোরু নিয়ে যাওয়া যাবে না, হিন্দু মেয়ের প্রেমে পড়া যাবে না— ফতোয়ার তালিকা বেশ দীর্ঘ।
দু'পারেই প্রবল দারিদ্র আছে, দু'চোখ ভরা স্বপ্নও আছে । মনে আছে আফগানিস্তানের সেই ছোট্ট ফুটবল-ভক্ত শিশুটাকে, যে পলিথিন দিয়ে ফুটবলার মেসির জার্সি বানিয়ে পরেছিল? পরে মেসি তাকে একদিন নিজের জার্সি উপহার দেন। শিশুটির স্বপ্ন এভাবেই একদিন জলহাওয়া পায়। হয়তো এমন হাজার হাজার স্বপ্ন রুক্ষ মরুদেশে একদিন ফুল ফোটাবে৷ বোরখা পরা মেয়ে, রাত করে বাড়ি ফেরা মেয়ে একদিন ফতোয়ার পরোয়া করবে না, নিজের শর্তে বাঁচবে। প্রেম, ভালবাসা তো মানুষের স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতির প্রকাশ— তাকে কি ধর্ম, রাষ্ট্রের চোখরাঙানি, কিংবা কালাসনিকভ দিয়ে রোখা যায়? বাঙালি মেয়ে সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাবুলিওয়ালাকে ভালবেসে ঘর ছেড়েছিলেন, তবু হিংসার কাছে সেবারের মতো ভালবাসা হেরে গিয়েছিল। তবু ভালবাসা আছে, বিভেদের গণ্ডি মুছে মানুষে মানুষে মিলনস্পৃহা আছে, যাবতীয় ফতোয়াকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি টিভি সিরিজে শোনা যাচ্ছে ‘আমারও পরাণ যাহা চায়'। বাহিরের পথ খুলে যাচ্ছে, মহাপঞ্চকরা প্রশ্ন করছে এটা কী ও কেন— ফতোয়াবাজদের মাথায় বাজ!
তালিবান আফগানিস্তানকে পুনরায় কব্জা করলেও তাদের ফতোয়ানীতি, হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড আগের মতো চালাতে পারবে বলে মনে হয় না। হিংসা, ধর্মীয় উগ্রতা সংক্রামক ঠিকই। তবু মানবতা, প্রেম, ভালবাসা আরও অনেক বেশি সংক্রামক। কারণ এগুলো সহজাত। একদিন ওই রক্তে শোণিত মরুতেও ফুল ফুটবে, হিংসা টুটবে। দুই ফতোয়ার মাঝে আমরা যারা বাস করি তারা শান্তি খুঁজব। মেঘদূত হয়ে হিমালয় পেরিয়ে চলে যাব আফগান মুলুকে, কোনও লুকোনো প্রেমের সন্ধানে। অনেক বৃষ্টি হবে, আমুদরিয়ার জল ভালবেসে গঙ্গায় পড়বে৷ সেদিন হয়তো তালিবান শব্দ ফতোয়ার সমার্থক হবে না, প্রেমের সমার্থক হবে, মুক্তচিন্তা ও শান্তির সমার্থক হবে। বামিয়ানের বুদ্ধ অলক্ষ্যে হাসবেন। তিনি তখন শান্তিতে অন্তর্হিত হবেন।
শিল্পী মাত্রেই সংশয়ী, সংশয়ী হওয়া মানেই পরশ্রীকাতর হওয়া নয়
ক্লাসরুমের শিক্ষাই পারে কোভিড পরবর্তী বেহাল শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করতে।
শুধুই কি উন্মাদনা, জনারণ্য আর আবেগ? মানুষের রুজিরুটিও তো এসব মেঠো সভা সমাবেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল
বাঙালির সুকুমারি মন, ননসেন্স রাইমস লিখেও এখানে প্রফেট হওয়া যায়, গবেট নয়।
বকলমে লোকাল ট্রেন চলছে, খুশি নিত্যযাত্রীরা; দায় না নিয়ে সেফটি ভালভ থিওরি রাজ্য সরকারের?
ফলাফল যার পক্ষেই যাক, বাংলার সামনে ইতিহাসের হাতছানি স্পষ্ট।