×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ধর্ম সংস্কৃতি ‘আশুরে পুডিং’, মিলে জুলে খেতে হয়, কেউ বুঝতে শিখল না!

    সুপর্ণা দেব | 01-05-2020

    প্রতীকী ছবি

    বিধাতার পিঙ্গল কেশরাশিতে জট লেগেছে। উত্তুরে হাওয়ায় খড়খড়ে হয়ে গেছে গায়ের চামড়ামুখে অজস্র বলিরেখা, চোখ দু’টো ঘোলাটে আর চোখের তলায় পুরু কালি বলে দিচ্ছে তিনি ইদানিং বিনিদ্র রজনী যাপন করছেনতিনি হনহন করে এসে খুব বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলেন,

    শোনো, আমি আর দেরি করতে পারব না। কালই আমি মহাপ্লাবন আনবতুমি এই বেলা পোঁটলা পুঁটলি বেঁধে নাও

    যাকে উদ্দেশ করে তিনি এই কথাগুলো বলছিলেন, সেই নোয়াহ তখন একটা পাথরের উপর বসে একটা লম্বা লতানে গাছ পাকিয়ে পাকিয়ে তাঁর নতুন বল্কলের দড়ি বানাচ্ছিলেনখুব অবাক হয়ে মুখ তুলে বললেন,

    সে কী! আপনি তিন দিন পরে প্লাবন আনবেন বলেছিলেন যে! এখনও কত কাজ বাকিজাহাজটার পাটাতন মেরামত করতে হবে। পালটার গায়ে বেশ কিছু তাপ্পি লাগাতে হবে। অমন পেল্লাই তিন তলা জাহাজ! সব ঘর গেরস্থালি গুছিয়ে তুলে নিয়ে ভেসে পড়তে হবেবাঁচবো কী মরবো ঠিক নেই, আর আপনি হুট করে এসে বলছেন কালকেই প্লাবন আনবেন! তা ছাড়া আমার বল্কলটাও বানানো শেষ হয়নি

    বিধাতা খুবই রাগের সঙ্গে বলে উঠলেন, পাপের ভার আর আমি বইতে পাচ্ছি না! এতো পাপ আর পাপের বিষে আমার ভাল করে নিঃশ্বাস নেওয়া হচ্ছে না। আমি ঘুমুতে পারি নাআদম আর ইভের বংশধরেরা আমার কালঘাম ছুটিয়ে দেবে জানলে আমি কক্ষনো মানুষ বানাতুমই নাশোনো হে নোয়াহ, আমি তোমাকে আর সময় দিতে পারব না। যা যা করবার এক্ষুনি করআমি কাল ঘোর প্লাবন নিয়ে পৃথিবী ধ্বংস করে দেবতোমাকে যেমন যেমন বলে রেখেছি, যাও করে ফেলো চটপট

    এই বলে বিধাতা একটা পাঁশুটে মেঘের আড়ালে হাওয়া হয়ে গেলেন

    নোয়াহ আর যাই হোক, বিধাতার মুখে মুখে কী করে তক্কো করেন? উপরন্তু তিনি বিধাতার বিশেষ প্রিয়পাত্রতাঁর উপর বিধাতা একটি অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব দিতে চলেছেন। নোয়াহ পড়িমরি করে ছুটে বউকে ডেকে বললেন, গিন্নি, প্রভু বেজায় চটে আছেনযা যা গোছাবার, এই বেলা গুছিয়ে নাওমনে আছে তো কী কী নিতে হবে সঙ্গে? আমি যাই জাহাজটার পাটাতন, পাল এই সব ঠিক করিগে

    বিধাতা প্লাবন তুললেন। সে এক কীর্তিনাশা মহাপ্লাবনফুলে উঠল সমুদ্র প্রবল জলোচ্ছ্বাসে সব ভেসে গেল। সব। জীবনের কোনও চিহ্নই রইল নাশুধু তোলপাড় জলরাশির মধ্যে গর্জনশীল চল্লিশার ঢেউয়ের মধ্যে আছাড়িবিছাড়ি খেতে লাগল মোচার খোলার মতো একটা জাহাজহ্যাঁ, ওটাই নোয়াহর তিনতলা জাহাজপ্রলয়পয়োধি জলে তখন কেশব বিষ্ণু, নৌকার মতো মৎস্য অবতার হয়ে ডুবন্ত প্রাণকে রক্ষা করছিলেন কোথাও বা

    নোয়াহর তিনতলা জাহাজও বাঁচালো, ঐ মৎস্য অবতারের মতই সমস্ত প্রাণকেও বাঁচালোনোয়াহ তাঁর বৌকে বলেছিলেন সব প্রাণীদের ভেতর থেকে একটি নারী আর একটি পুরুষ বেছে নিয়ে ভেসে পড়ি চলআবার যদি কোথাও গিয়ে ঘর গেরস্থালী বাঁধতে পারি। জীবন রুইতে পারি কোনওদিন!

    এই ভাবে জলের প্লাবনের সঙ্গে লড়তে লড়তে ভাসন্ত ডুবন্ত নোয়াহ একদিন দেখলেন, নাহ, অতটা উথাল পাথাল মনে হচ্ছে না আজ! তিনি জাহাজের কুঠরি থেকে বেরিয়ে দেখলেন দিগন্তে এক পাহাড়ের আবছা ছায়া

    আবার এদিকে কোথায় যেন মন্দার পর্বতকে দণ্ড করে ক্ষীর সমুদ্র মন্থন হচ্ছিলকেশব বিষ্ণু কচ্ছপ হয়ে তাঁর পিঠের শক্ত খোলের ওপর সেই পাহাড়কে তুলে নিলেনমন্থন হল শেষ, উঠল অমৃত। প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তো খাবার চাই

    নোয়াহর জাহাজও এতোদিন পর যেন জিরোতে চাইছে। সেই পাহাড় দুধেল গাইয়ের মতো তুলতুলে বরফে মোড়া। নোয়াহর মুখে বিজয়ীর হাসিচিৎকার করে বলে উঠলেন, গিন্নি ও গিন্নি বাইরে এসে দেখো একবারএই পাহাড়ের গায়ে জাহাজটাকে ভিড়িয়ে দি। চল একটু ডাঙায় নামিমনে হচ্ছে এ যাত্রা বেঁচে গেলুম গো!

    নোয়াহর জাহাজ থামল সেই পাহাড়ের তলায়। জাহাজ বাঁধা হল পাহাড়ের গায়েনোয়াহ, সেই প্লাবন পূর্ব যুগের আদি পিতা, আদি মাতাকে ডাক দিয়ে বললেন, ভাঁড়ারে কী কী আছে দেখো একবারকিছু একটা রাঁধতে ভারি ইচ্ছে করছেগিন্নি ভাঁড়ার হাটকে বললেন এই যা আছে নাওনোয়াহ জুলজুল করে দেখলেন কয়েক দানা গমকিছু যব, একটু আধটু দানা এদিক সেদিক ছড়ানো ছিটনো, ফলের দানা, দু’টো বাদামতাই নিয়ে নোয়াহ পুডিং রাঁধতে বসে গেলেনপুডিং বা পিষ্টক সে যাই হোক না কেন, তিনি মহানন্দে সেই পুডিং বানিয়ে গিন্নি আর যে ক’টি প্রাণী তাঁদের সঙ্গে ছিল সব্বাইকে নিয়ে খেতে বসলেন। এর নাম আশুরেমধুসূদনের ভাঁড়ের মত সেই খাবারে বেশ কুলিয়ে গেল সব্বারখেয়েদেয়ে সেই বরফ তুলতুলে পাহাড়ের কোলে বসে খানিক বিশ্রাম নিলেন তিনি

    এই হল আরারত পাহাড়, আর্মেনিয়া আর তুরস্কের সীমানায়হিব্রু বাইবেলের জেনেসিসে এইসব গল্প লেখা হয়েছেআরমানি তুর্কিতে একেবারে সাপে নেউলে সম্পর্ক। এখন দু দেশের সীমান্ত বন্ধএদিকে মহরম মাসের দশ তারিখে মানে আশুরের দিন তুরস্কে বানানো হয় নোয়াহর আশুরে পুডিং। পরিমাণে অনেকটা করে। সবার মধ্যে ভাগ করে খাওয়া হয়প্যাকেটে প্যাকেটে বাক্সে বাক্সে বাড়ি বাড়ি পাঠানো হয়ইহুদি, আদি খ্রিষ্টান আর ইসলাম ধর্মের গোলোক ধাঁধায় দুই দেশের সীমানায় দাঁড়িয়ে আরারাত পাহাড় মুচকি মুচকি হাসে। সে তুরস্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে অথচ আরমানির জাতীয় প্রতীকে দিব্যি রয়ে গেছেন!

    বড় পবিত্র এই আশুরেএই দিনে নাকি বিধাতা আদমের রাশি রাশি পাপ ক্ষমা করে দেন, নোয়াহর জাহাজ মহাপ্লাবনের বিভীষিকা থেকে মুক্তি পায়, নোয়াহ মিষ্টি মিষ্টি আশুরে রাঁধেন আর জীবকূল আবার বাঁচতে শুরু করেআবার আকাশ হেসে ওঠে, ফুল ফোটে চাঁদ ওঠেছেলেটি বাঁশি বাজায়, মেয়েটি সুর তোলেছেলেটির কাঁধে টিয়া পাখি শিস্ দিয়ে ডেকে ওঠেজীবন রোপিত হয় আবার!

    আরও পড়ুন

    ঈশ্বরের প্রয়োজন হচ্ছে না

    সেই যে সব প্রাণ একটি একটি করে বেঁচে গেল, তার মধ্যে আমিও বাঁচলাম, বেঁচে রইলো আমার হীরামনও। সে এখন বেশ ডাগর ডোগরবাঁকানো লাল ঠোঁট, চকচকে সবুজ পালকআমার কাঁধে বসে থাকে। এখনও বসে আছে। তাকে কাঁধে নিয়েই আমি চলেছি। মেহরাউলির পথে। শুধু আমি একা নইগোটা শাহজাহানাবাদ আমার সঙ্গে চলেছেআমার সঙ্গে চলেছে বললে ভুল বলা হবে। চলেছে সব বাদশার সঙ্গেবলতে গেলে শাহজাহানাবাদ আজ ফাঁকাবাদশা সাজগোজ করে চতুর্দোলা সাজিয়ে মেহরাউলির পথে চলেছেন বাদশা চলেছেন তাঁর প্রিয় উৎসবেশুধু বাদশার নয়, তামাম শাহজাহানাবাদের বড় খুশির তেওহার। ফুলওয়ালো কি সয়ের। সয়ের এ গুল ফারো শাঁ। ফুল ব্যাবসায়ীদের মোচ্ছব। চারিদিকে শুধু রঙ আর রঙএই ফুলগুলো দিয়ে বড় বড় ঝালর দেওয়া লম্বা লম্বা পাখা বানানো হয়লাল হলুদ গোলাপি কমলা রঙের ফুলের বাহারে চোখ ঝলসে ওঠে পাখার চারদিকে সোনালি রুপুলি জরির ঝালর। শোভাযাত্রা করে এই রঙিন পথচলাবাদশা আর শাহজাদা শাহজাদিদের দোলা সবার আগে

    হীরামন বলল, না নাআ, ঠিক বলছ না, সবার আগে নফিরিওয়ালাতারা চলত তাদের নাকাড়া বা ডঙ্কা বাজিয়ে

    তারপর?

    হীরামন বলে, ভুলে গেছ সব? তারপর থাকত গাইয়ের দল আর সানাইকী রাগ বাজত মনে আছে? নাকি তাও ভুলে বসে আছো?

    আমি বললাম, না না মনে আছে, মনে আছে মল্লার, মল্লার

    আকাশে তখন শাওন ভাদোর নখরাএই ঝিরঝিরে বৃষ্টি, এই রোদ উঠে গেলভেজা পথে লটকে পড়ে থাকে অকাল গুলমোহরআর বাতাস পাগল করে উড়ে বেড়ায় গোলাপের পাপড়ির সুগন্ধতার সঙ্গে রংমিশালি পতঙ্গ, ঘুড়ি

    বাদশা জাফরের খুব প্রিয় উৎসবআমি মুখিয়ে থাকতাম কখন দেখব সেই প্যায়জনিয়া পরা টুকটুকে গোলাপি পা, মাটিতে তার নাজুক বুড়ো আঙুলের চাপঅমনি মাথায় হীরামন ঠুকরে দেয়, খুব লায়েক হয়েছ না? সব বুঝি আমি

    হীরামন এক দন্ড দাঁড়াতে দেয় নাতাকে চারদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে হয়। মেহরাউলির বাড়িগুলো একেবারে চমকাচ্ছে। ঝকঝক করছে সরাই খানা। কোথাও ফাঁকা নেইছন ছনানানা, ঘুঙরু বাজেহুঁকোর গলায় ফুলের মালা জড়ানো

    পান খেয়ে মুখ লাল। মিঠাইওয়ালা মিঠাই বানায়তন্দুর ভরতি খমিরি রুটি। বড় বড় মটকা ভর্তি ঠান্ডা জল

    মিয়াঁ, আব এ হায়াত পিলাউ?

    আব এ হায়াত, জীবনের জলবয়েই চলেছে, বয়েই চলেছে কত ঘাটে ঘাটে থামছে, কত গন্ধ মাখছে, কত রকম পাত্রে ঢুকছে, আবার মেঘ হয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে

    আমি আর হীরামন কেওড়া দেওয়া ঠান্ডা জল খাই। আবার হাঁটিসন্ধে বেলা বড় তালাও এ আতশ বাজি জ্বলবে হীরামন আবার বাজি দেখলে ভয় পায়!

    বাদশা জাফর প্রথমে থামবেন মা যোগমায়ার মন্দিরে। সেখানে ফুলের চাদর পেতে দেবেন। সক্কলে চাদর পেতে দেবেসেখানে প্রসাদ খাওয়া হবে সবাই মিলে। আমরাও খাব

    তিনদিন ধরে সারা মেহরাউলিতে আনন্দলহরীমা যোগমায়া মন্দিরের পরে ফুলের চাদর বিছিয়ে দেওয়া হবে কুতুবুদ্দিন বাখতিয়ার কাকি বা কুতুব সাহাবের দরগায়সুফিসন্ত কুতুব সাহাব আর মা যোগমায়ার প্রেমের আলোর সুতো গেঁথে তুলছে এক অপূর্ব ফুলের মালা। হীরামন বলে তুমি জানো এই মালার নাম কী?

    আমি বললুম, তুই বল না! তুই তো খুব ওস্তাদ! সব জানিস

    এর নাম গঙ্গা জমুনি তেহজিব। সব্বাই মিলেমিশে থাকা, সব ধর্ম সংস্কৃতির সুরভি মাখা এই মালা লম্বা হয়ে হয়ে গাঁথা হয়েই যাচ্ছেআওয়াধ ছিল এর সবচেয়ে বড় কেন্দ্র , জানো?

    আমি বললুম, এতো ভারি ভারি কথা বুঝতে পারি না রেচল ওইখানে যাই, রেশমি দড়ির ঝুলায় ফুলের দোলনায় পরিরা কেমন দোল খাচ্ছে, একটু দেখি গে যাইহীরামন, আমার মাথায় আলতো ঠোক্কর বলল, যার যেদিকে ধান্দা!

    আরও পড়ুন

    মুক্তমনে বিরোধী যুক্তি

    নবাব লখনউ ছাড়ার আগে তার মহল, ঝরোখা, দরজা, জলভরা চোখ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলেন আর তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল-

    যব ছোড় চলে লখনউ নগরি

    তব হাল আদম পর ক্যা গুজরি...।।

    চলে তো এলেনকিন্তু এমন এক শহরে এলেন যে তার হৃদয় উৎসারিত সেই নজম সেই শহরের এক অতি মনোরম কবির হাতে পড়ে কী হাল হল, সেই কবি লিখলেন তাঁর এক নাটকের জন্য

    “কত কাল রবে বল’ ভারত রে

    শুধু ডাল ভাত জল পথ্য ক’রে

    দেশে অন্নজলের হল ঘোর অনটন

    ধর’ হুইস্কি-সোডা আর মুর্গি-মটন

    যাও ঠাকুর চৈতন-চুট্‌কি নিয়া

    এস’ দাড়ি নাড়ি কলিমদ্দি মিয়া।''

    এখন আমার আর সব কথা ভাল মনে পড়ে নাঐ হীরামন মাঝে মাঝে সুতোয় মাঞ্জা লাগিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে দেয়, তখন হাওয়ায় হাওয়ায় বিজলি, মেঘ আর রাতের জোনাকি আর আমার দশ ইঞ্চি টবের দুটো অকালে ফোটা বেল ফুল সেইসব কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ধর্ম সংস্কৃতি নিয়ে কী কেবল চুলোচুলি, ঝগড়া করা আর রক্ত ঝরানো যায়? এ যেন এক উমদা খিচুড়ি বা ওই আশুরে পুডিং, সবাই মিলে জুলে ভাগ করে খেলে তবেই না আসল মজা! সেটা কেউ বুঝতেই শিখল না!


    ধর্ম সংস্কৃতি ‘আশুরে পুডিং’, মিলে জুলে খেতে হয়, কেউ বুঝতে শিখল না!-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested