×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ছাঁচে ঢালা দেশপ্রেম, ভাষা তার হিন্দি

    সোনালী দত্ত | 07-06-2021

    প্রতীকী ছবি

    কয়েকজন বাঙালি কিশোরকে জিজ্ঞাসা করা যাক, ‘দেশপ্রেমশব্দটি তাদের সামনে কোন ছবি ফুটিয়ে তোলেবেশিরভাগেরই মনশ্চক্ষে প্রতীয়মান হবে আধুনিক বন্দুক, যুদ্ধবিমান, সেনাবাহিনীর মার্চ এবং ভারতের জাতীয় পতাকাএরপর তাদের প্রশ্ন করা হোক, ‘দেশবলতে তারা কী বোঝেতেমন গুছিয়ে কিছু ভাবতে পারবে না তারাতবে ওই কামান, বন্দুক, জাতীয় পতাকা এইসবের বাইরে যাবে নাএদেশের কৃষিক্ষেত্র, বন্ধ কারখানা, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল এসব সেই তালিকায় কমই জায়গা পাবে আমাদের কিশোর ভারত, তরুণ ভারত একটা অতি সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে দেশবাদেশপ্রেম’-এর ধারণা গড়ে তুলতে পারছে নাবলা চলে, গড়ে তুলতে তাদের দেওয়াই হচ্ছে না

     

    লোকগুরুরামকৃষ্ণহিসাবে কাউকে ভাবতে গিয়ে দীর্ঘদিন আমাদের চোখে এক দক্ষ অভিনেতার মুখ ফুটে উঠতসত্যি বলতে কী, এখনও সিনেমা বা সিরিয়ালে ঐতিহাসিক সেই চরিত্রকে আমরা ওই অভিনেতার মতো করেই হাসতে বা কথা বলতে দেখিবিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাস্তব চরিত্রটির সঙ্গে অভিনীত চরিত্রটির আচরণ মোটেই খুব বেশি মিলত নাকিন্তু আমাদের চোখে ওটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছেযে অপু, দুর্গাকে আমরা কাশবনে ছুটতে দেখেছি, তারা পরিচালক সত্যজিতের নির্মাণলেখক বিভূতিভূষণ কি এই অপু, দুর্গাকেই এঁকেছিলেন? সম্ভবত পুরোপুরি নয়আসলে একটি ধারণাকে চিত্রায়িত করে বারবার যদি মানুষের সামনে উপস্থিত করা হয়, মানুষ নিজের চিন্তা বা কল্পনাশক্তিকে পাশে ঠেলে বহুক্ষেত্রেই সেই চিত্রকেইসত্যবলে মনে করতে থাকেনদেশপ্রেমের ক্ষেত্রেও ভারতীয় জনগণ, বিশেষত ভারতের কিশোর কিশোরী ওই রণাঙ্গনের ধারণাকেই মনের মধ্যে স্থিত করে ফেলছেতার বাইরে যেদেশবলতে কিছু আছে, সে বোধ তাদের যথার্থভাবে গড়েই উঠছে না

     

    পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ স্কুল, কলেজেস্বাধীনতা দিবসবাপ্রজাতন্ত্র দিবসপালনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিলে চিন্তাশীল মনে বেশ উদ্বেগই দেখা দেবেনাচ বা নাটকের জন্য যদি পাঁচটি গান বাছা হয়, তার চারটিই হবে হিন্দি গানযেন বাংলায়দেশপ্রেমতেমন আসে নাহিন্দি গান নিয়ে সংকীর্ণতা না রেখেও বলা যায়, বাংলা দেশাত্মবোধক গান কি কম পড়িয়াছে? ‘দেশবলতে কি রণনৃত্য, এক অতি পরিচিত টিকি-দাড়ি কম্বিনেশন এবং কোনও এক প্রতিবেশী দেশ থেকে আসাঘুসবয়ঠিদের শায়েস্তা করা ছাড়া আর কিছুই বোঝায় না? কোভিডকাল অতিবাহিত করতে দেখা হিন্দি ওয়েব সিরিজগুলোর অভিজ্ঞতা তো তাই বলে। টি-শার্টের পিছন থেকে পিস্তল বার করে আইনসিদ্ধ খুন করতে না পারলে আর নায়ক কীসে? এই ধরনের কটা অনুষ্ঠানে শহীদ প্রীতিলতা, রাজগুরু বাঘাযতীনের নামের উল্লেখ করা হয়? তরুণরা যে সোশাল সাইটে দিনরাত পড়ে থাকে, সেখানে ইদানীংদেশাত্মবোধ’-এর নামে একটি নির্দিষ্ট গান বাজে (সম্ভবত পাঞ্জাবি ভাষায়)অক্ষয় কুমার অভিনীত কেশরী ছবিতে তেরি মিট্টি মে মিল জানা

     

    আরও পড়ুন: কোভিডকে ছাপিয়ে হিংসা-দ্বেষের ভাইরাস পশ্চিম এশিয়ায়

     

    ইংরেজের অধীনে কাজ করা এক ভারতীয় সেনার বীরত্বপূর্ণ লড়াই এবং আত্মত্যাগের কাহিনী দেখাতে গিয়ে সেই গান ব্যবহার করা হয়েছিলভারতের অধিকাংশ মানুষের কাছেই দুর্বোধ্য শব্দমুখর সেই গান সুন্দর সুরের মায়াজালে আমাদেরদেশপ্রেম’-কে প্রায় জড়িয়ে ফেলেছে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হিন্দি)বিদেশি ইংরেজ শাসকের অধীনে লড়াইটাই দেশপ্রেমের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে স্থান পেল কী করে? এই প্রশ্নের একটা সম্ভাব্য উত্তর এই যে ছবিতে বিজিত পক্ষ হল, তারা যে মুসলিম প্রতিবেশী দেশটির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, এটাই এখন দেশাত্মবোধের একমাত্র স্বীকৃত সরকারি রূপ।

    এই গানটিতে এবং সাধারণভাবে সমধর্মী ভাবনায় দেশবোধটাই আসছে হিন্দি ভাষায়, যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে দিয়েবাংলায় গানেররিয়ালিটি শোগুলিতে কটা বাংলা গান গাওয়া হয়? আমরাভারতীয়হতে গিয়েবাঙালিবাওড়িয়াইত্যাদি পরিচয় হারিয়ে ফেলছিদক্ষিণ ভারত সম্ভবত এই প্রবণতা থেকে এখনও মুক্ত আছে উত্তরের হাল এমনই করুণ 

     

    আপাতদৃষ্টিতে সমস্যাটি কিছুই নয় কিন্তু এর শিকড় প্রবেশ করেছে আমাদের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক গভীর বিপন্নতায় আর সেই আবহে প্রথম থেকেই রয়েছে বলে আমাদের শিশু, কিশোর, তরুণরা এক অসম্পূর্ণ দেশাত্মবোধ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে তারাই তো ভারতের ভবিষ্যৎ নাগরিক? তাদেরদেশবোধ যদি সংকীর্ণতামুক্ত না হয়, তারা দেশের কাণ্ডারি হবে কেমন করে? কেন তারাস্বাধীনতার অর্থ কেবল রণাঙ্গনে সীমাবদ্ধ করে ফেলবে? কেন তারা ভুলে যাবে, ‘শত্রু' মানেই শুধু একটি দেশ নয়? কেনমিনি পাকিস্তানবলে তাদের চোখে একটি ধর্ম, এক ধরনের পোশাক বা খাদ্যাভ্যাসকে দাগিয়ে দেওয়া হবে? তারা শিখবে না তাদের মাতৃভূমি বৈচিত্র্যের মধ্যেইঐক্যভালোবাসে, বৈচিত্র্যকে দুমড়ে মুচড়েএকবানায় না?

    যে দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, তার রাজনৈতিক স্বাধীনতাকি এমনই নামসর্বস্ব হয়? অবশ্য মত প্রকাশের প্রসঙ্গ তো তখন আসবে, যখন মত পোষণের পরিবেশ তৈরি হবে। ওই যে শার্লট ব্রন্টির মুক্ত পাখিহওয়ার স্বপ্ন, সে তো টিকেই আছে মুক্ত চিন্তাবা স্বাধীন ইচ্ছাহৃদয়ে লালনের উপর, যা বিবেক আর বুদ্ধির যাথার্থ কম্বিনেশন। এই মিশেল ছাড়া স্বাধীনতা’, ‘দেশপ্রেমইত্যাদির বোধ কি সম্ভব? আমরা যখন গণেশের হাতিমুণ্ডে প্লাস্টিক সার্জারিদেখি, বিজ্ঞানকে জ্যোতিষের সামনে বামনহতে দেখি, গোমূত্রে সোনা থেকে শুরু করে কোভিড ভ্যাকসিন দেখি, লক্ষ লক্ষ সহনাগরিককে বিদেশিহয়ে যেতে দেখি, পরিযায়ী শ্রমিকের শরীরের টুকরোর সঙ্গে বাসি রুটির টুকরোকে মিশে যেতে দেখি, কামদুনি-হাথরসে সাজানো ঘটনাদেখি, ধর্ষণের পিছনে মেয়েদের আচরণের দোষদেখি, দাগি চোর ডাকাতকে শাসনদণ্ড ধরতে দেখি, মাটির গভীর তলে মহাকাব্যের আঁতুড়ঘর দেখি- তখনও এই সবকিছুকে স্বাভাবিকবলে মেনে নিয়ে থাকি। আমাদের পরের প্রজন্মকে অন্য কিছু দেখাতে আমরা শেখাব কী করে? আমরা যে কেবল শপিং মল আর সেলেবল প্রডাক্টে (বিক্রয়যোগ্য পণ্য)-র দাসত্ব বরণ করেছি, তা তো নয়? আমাদের চেতনাও ক্রীতদাস। আমাদের স্বাধীনতা আসলে ওই দাস মালিকের স্বাধীনতা

     

    আরও পড়ুন: বিপাকে পড়ে ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’

     

    সেনারা আমাদের গর্বআমাদেরস্বাধীনতার অন্যতম রক্ষককিন্তুস্বাধীনতাযাঁরা অগণিত প্রাণ আর কান্না-ঘাম-রক্তের বিনিময়ে আমাদের হাতে তুলে দিলেন, সেই সংগ্রামীদের কথা জানতে হবে না? আমরা তো তাঁদেরই উত্তরাধিকার? আমাদের সেনাবাহিনী আসলে সেই উত্তরাধিকারই বহন করে ভারতের কটা রাজ্যের অধিবাসী তাঁদের নিজেদের ইতিহাস ঠিকমতো জানেন? স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের পূর্ব প্রজন্মের অবদান সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? যাও বা জানতেন, তাও সুপরিকল্পিত ভাবে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছেনইলে কেউ আবার প্রশ্ন করে বসতে পারেন, ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’ নানাভাবে ভারতীয় রাজ্যগুলির ভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছেসম্প্রতি নির্বাচনে দিল্লির নেতারা এসে নির্বিকারে লম্বা লম্বা বক্তৃতা করে চলে গেলেনআমরাও তাই শুনলামক্রুদ্ধ বা আপ্লুত হলামএকবারও মনে হল না, এঁরা দোভাষী নিলেন না কেন? ‘কেন কিআমাদের হিন্দি ছাঁচেই ঢালা হচ্ছেহিন্দি-বলয় প্রসারিত হচ্ছে। তারপর আসবে হিন্দু এবং তথাকথিত হিন্দুস্থান (যা মোটেই ভারত নয়)। নির্বাচনে ফলাফল যাই হোক, আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলার অসুখটা কিন্তু ছড়িয়ে পড়ছে

     

    দিন আগে আমরা নদীতে সারি সারি লাশ ভেসে যেতে দেখলামঅক্সিজেনের অভাবে রোগীকে রাস্তায় পড়ে মরতে দেখলামঅপুষ্টিতে অগণিত নারী, শিশুকে তিল তিল করে ক্ষয়ে যেতে দেখছি প্রত্যহতবুশত্রুচিহ্নিত করতেপারছি নাআমরা গুজরাত দেখেছি, গোধরা দেখেছি, বাবরি দেখেছি, পাঞ্জাব দেখেছিদিল্লির পাবলিক বাস থেকে শুরু করে কামদুনি, উন্নাও, কাঠুয়া, হাথরস দেখেছিবিশ্ব তালিকায়আনন্দ’, ‘মানবাধিকার’, ‘গার্হস্থ্য হিংসা’, ‘দারিদ্র‍', ‘বেকারত্বইত্যাদির নিরিখে দেশকে তলানিতে ঠেকতে দেখছিতাও "শত্রুখুঁজে পাচ্ছি নাকোটি কোটি ভারতীয় নাগরিক বেকার হয়ে যাচ্ছেনকর্মহীন জীবনসঙ্গীর চিতায় স্ত্রীকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখছিপরিযায়ী শ্রমিকের টুকরো দেহের সঙ্গে রেললাইনে পড়ে থাকতে দেখছি পোড়া রুটির টুকরোতাও আমরা বুঝতে পারছি না, কোথায় আমাদের দেশ? কারা সে দেশের শত্রু?

     

    এই ভুলিয়ে দেওয়া আর গুলিয়ে দেওয়াদেশাত্মবোধথেকে আমাদের নিজেদেরদেশ’-এ ফেরা দরকারসেখানে প্রতীক্ষায় আছে আমাদের উত্তর প্রজন্মতারাদেশমানে হিন্দি গান, পতাকা আর মানচিত্রের পাশাপাশিমানুষএবংমানবাধিকারও বুঝুকসমস্ত নাগরিকের মতো সেইমানবাধিকারআমাদের সেনাদেরও আছে (যারা নিজেদের দূরবস্থার কথা প্রকাশ করলেই ভ্যানিশ হয়ে যান)খাওয়া, পড়া, চিন্তা করারদেশাত্মবোধ-কে রক্ষা করার দাবি উঠুকএমন দাবি তুলতে গেলে কালবুর্গি বা গৌরী লঙ্কেশ হতে হবে হয়তোকিন্তু ‘দেশ’ বড় বালাই!

     


    সোনালী দত্ত - এর অন্যান্য লেখা


    কোভিডের টিকাকরণে মেয়েরা অনেক পিছিয়ে, লিঙ্গবৈষম্যের নয়া দিকটি নিয়ে কেউ কি কিছু ভাবছেন?

    সোশাল মিডিয়া, সরকারি প্রচার সর্বত্রই দেশপ্রেম শুধুই অস্ত্র হাতে একটি প্রতিবেশী দেশের উপর আস্ফালন

    ছাঁচে ঢালা দেশপ্রেম, ভাষা তার হিন্দি-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested