×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • জীবনের মূল্য কম বলেই টিকায় পিছিয়ে নারী

    সোনালী দত্ত | 07-07-2021

    প্রতীকী ছবি।

    এক কিশোর পরীক্ষার্থী কৈ মাছের প্রাণ’ দিয়ে বাক্যরচনা করতে গিয়ে লিখেছিল, ‘মেয়েদের প্রাণ কৈ মাছের মতো। কিছুতেই যায় না।' আজকের দিনের কিশোররা এই ধরনের মত পোষণ করতে অভ্যস্ত নয়। বোঝাই যাচ্ছে, পরিজনের আবহ তাকে এমনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, তার এই শিক্ষা ভবিষ্যতে তাকেও এমন শিক্ষকে পরিণত করে ফেলতে পারে। সরকারি অ্যাপ কো-উইনে নাম নথিভুক্তির ভিত্তিতে টিকাপ্রাপকদের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, তাতে প্রতি 1,000 জন পুরুষ টিকা প্রাপকের অনুপাতে নারী টিকাপ্রাপকের সংখ্যাটা মাত্র 856! যা, সার্বিকভাবে দেশের জনসংখ্যায় নারী পুরুষের হারে যে বৈষম্য (প্রতি 1,000 জন পুরুষের অনুপাতে নারীদের সংখ্যা 924), তাকেও ছাপিয়ে যায়। এসব দেখেও আমরা খুব আশ্চর্য হই না। কারণ, নারীর সাংবিধানিক অধিকার যাই থাক, ভারতের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এমনকি সামরিক বাহিনীতেও মহিলারা যত কৃতিত্ব দেখান, অনেক ক্ষেত্রেই এই আধুনিক যুগেও তাঁদের সামাজিক এবং পারিবারিক পরিচয় হল, তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ’। কাজেই মানুষের প্রাপ্য জীবনের অধিকার’ নারীর থাকতেই পারে না

     

     

    সরকারি পরিসংখ্যান থেকেই জানা যাচ্ছে, গত 25 জুন পর্যন্ত সারা দেশে 3 কোটি 9 লক্ষ মানুষের টিকাকরণ হয়েছে। এর মধ্যে 1 কোটি 67 লক্ষ টিকাপ্রাপক পুরুষ। অন্যদিকে মাত্র 1 কোটি 43 লক্ষ ভ্যাকসিন মেয়েদের ভাগ্যে বরাদ্দ হয়েছে। সমীক্ষার অতলে ঢুকলে বৈষম্যের ফাটলটা আরও চওড়া হবে। ভারতের জনবহুলতম রাজ্য উত্তরপ্রদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে 2 কোটি 9 লক্ষ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। নজরুল যতই চিরকল্যাণকর সৃষ্টির পিছনে পুরুষ আর নারীর কৃতিত্বকে সমান মনে করুন না কেন, আরও অনেক কিছুর মতোই ভ্যাকসিনবণ্টন নারীর সমানাধিকার নেই। উত্তরপ্রদেশে এখনও পর্যন্ত মোট ভ্যাকসিনের42 শতাংশ মেয়েরা পেয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে কিঞ্চিৎ বেশি, 44 শতাংশ। দাদরা ও নগর হাভেলির মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এই সংখ্যাটা 30 শতাংশেরও কম! কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশের মতো হাতেগোনা দু'-তিনটে রাজ্যে টিকার পুরুষ প্রাপকদের তুলনায় মেয়ে প্রাপকদের সংখ্যা বেশি

     

     

    এখন প্রশ্ন হল, ভ্যাকসিনেও এই লিঙ্গবৈষম্য কেন? এই প্রসঙ্গে Asia Pacific and gender transformative policy and practice for Plan International-এর অধিকর্তা ভাগ্যশ্রী ডেঙ্গেলের মতে, ভারতের সমাজব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে যে লিঙ্গবৈষম্য এবং নারীদের প্রতি অবহেলা লক্ষ করা যায়, তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে কোভিডের টিকাকরণেও। বাস্তব অভিজ্ঞতায় ভাগ্যশ্রীর এই বক্তব্যকে সম্পূর্ণতউড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাংলায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হল, ‘পুড়ল মেয়ে উড়ল ছাই / তবে মেয়ের গুন গাই’। এতো কেবল ছড়া নয়, পিছিয়ে থাকা সামন্ততান্ত্রিক ভাবনার ভারতে নারীর সামাজিক অবস্থানের ছন্দবদ্ধবাস্তবতা। শুধু গ্রামীন ভারত নয়, শহুরে ভারতের হৃদয়ে আজও অন্তঃসলিলা হয়ে যে ধারণা বইছে তা বলে, মেয়েদের প্রাণের মূল্য ছেলেদের তুলনায় অবশ্যই কম। আলাদাভাবে পরিবারের মহিলাকে  গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা এখনও শহুরে, শিক্ষিত পরিমণ্ডলেও ব্যতিক্রম’ হিসাবেই পরিগণিত হবে। ভারতের মেয়েদের অর্ধাংশ যে রক্তাল্পতায় ভুগছেন, তাঁরা শুধু গ্রামের বাসিন্দা নন। শহরের পরিশীলিত গৃহকোণেও তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট। আর শিক্ষাহীন, পিছিয়ে থাকা পরিবেশে তাঁদের বেঁচে থাকাই যে মূল্যহীন, এ কথা অনস্বীকার্য। এমন পরিবেশ বদলানো কঠিন। কারণ নারীর সুরক্ষা এবং সুস্থ জীবনের জন্য যেখানে আইন প্রণয়ন হতে পারে, সেই আইনসভায় নারীর উপস্থিতি আণুবীক্ষণিক। এমনকি নারীর নেতৃত্বে চলা দলেও মহিলারা নির্বাচনে যথেষ্ট সংখ্যায় মনোনয়ন পান না। বামপন্থী দলগুলিতেও নয়। আর মেয়েদের প্রতি অন্যায় হলে হয় তা চিত্রনাট্য অনুসরণ করে হয়েছে, অথবা এমনই হওয়া উচিত ছিল। বটতলার খাপ পঞ্চায়েতে বসে থাকা মনু জ্যাঠামশাইরা নিদান হাঁকেন- নারীর জীবনের অধিকার নেই

     

     

    এই প্রসঙ্গে মুম্বই এবং পুণের জনস্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা গবেষক সোফিয়া ইমাদের বক্তব্য একটু আলাদা। মেয়েদের টিকাকরণে পিছিয়ে থাকার নেপথ্যে তিনি মূলত কিছু কুসংস্কার ও গুজবকে দায়ী করছেন। যেমন বলা হচ্ছে টিকা নিলে নাকি মেয়েদের ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যাবে, তারা নাকি কখনওই আর মাতৃত্বের স্বাদ পাবে না। বিবাহিত মহিলাদের একটা বড় অংশের ক্ষেত্রে আবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার স্বামীর হাতে। সবদিক খতিয়ে দেখে তিনিই ঠিক করবেন, তার ঘরনী টিকা নেবে কি নেবে না। এর সম্ভাব্য কারণটা স্ত্রীয়ের শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ নয়, তার সন্তানধারণে অক্ষমতার গুজবই স্বামীদের বিচলিত করার মুখ্য কারণ। সমস্যা আরও আছে। গ্রামীণ এলাকায় টিকাকরণ কেন্দ্রগুলি মূল জনবসতি অঞ্চলগুলি থেকে এতটাই দূরে যে, একা কোনও মেয়ের পক্ষে সেখানে যাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার। তাছাড়া সরকারি রিপোর্টই জানাচ্ছে দেশের 58 শতাংশ মহিলা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে জানেন না। তবু সরকারি প্রচারযন্ত্র নিয়ম করে বলে যাচ্ছে, টিকা নিতে গেলে কো-উইন অ্যাপে অনলাইনে নাম নথিভুক্ত করতে হবে!

     

     

    এটা ঠিক যে, ভারতের নারীর সম্ভাব্য আয়ু পুরুষের চেয়ে কিছুটা বেশি। কিন্তু সেটি যেন ভারী আশ্চর্যের বিষয়, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে দু:খেরই বিষয়। উল্টোটা হওয়াই যেন স্বাভাবিক ছিল। সংসার, স্ত্রী ধর্ম, সন্তান উৎপাদনের দায় পালনের পর মেয়েদের আর বেঁচে কী কাজ, এই প্রশ্ন পুরুষতান্ত্রিক ভারতের এক বিরাট অংশে আজও ছড়িয়ে রয়েছে। শুধু কোভিড টিকা কেন, অন্যান্য স্বাস্থ্য রক্ষাকারী টিকাও মেয়েরা কম পান, কেবল অবহেলার কারণেই নয়। এর সঙ্গে যোগ হয় কুসংস্কার। যেমন পোলিওর প্রতিষেধক নিলে সন্তানধারণে বাধা পড়বে। আর সেটাই তো মেয়েদের মূল কাজ? তাই এই মিথ্যা গুজবে অনেক ভারতীয় বিশ্বাস করে থাকেন। পোলিও রোগগ্রস্ত শারীরিক বিকৃতিও বরং গ্রহণীয়। তাই বলে সন্তানের জন্ম আটকাবে? তা হলে আর নারীর রইল কী?

     

     

    তবে এই আলোচনাকে নিছক নারীর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নিরিখে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। অর্ধেক আকাশ’-এর পাশে যে একটা অন্য আকাশআছে, তা আমরা অনেক সময়ই ভুলে যাই। নারীর বঞ্চনার চিত্র তবু কেঠো সরকারি যোগ-বিয়োগে ফুটে ওঠে। অথচ এই দেশের বৃহন্নলা সম্প্রদায় কতটা টিকাদানের আওতায় এসেছে, সরকারি রিপোর্ট তা আমাদের জানতে দেয় না। শুধু বৃহন্নলা নয়, বিশ্বের আদিম পেশার সঙ্গে যুক্ত যারা, সেই যৌন কর্মীরাও এই অপ্রাপ্তির তালিকাতেই থাকেন। এদের পরিচয় এরা অন্যান্যএদের খবর সরকার, অ-সরকার কেউই রাখে না

     

     

     
    কিন্তু নারীরা তো এই অন্যান্যদের দলে নেই। গালভরা কথায় পুরুষ আর নারী তো একে অপরের পরিপূরক। এই একবিংশ শতকেও তাকে কেন আপন ভাগ্য জয় করার জন্য, মারণ রোগের টিকার জন্য এতটা পথ হাঁটতে হবে? সিমোন দ্য বোভেয়ার, ইন্দিরা গান্ধী হয়ে, আজকের গ্রেটা থুনবার্গ, নারীর ক্রম উত্থানের ট্র্যাজেক্টরি কি আদতে পশ্চাৎমুখী? আসলে পুরুষতন্ত্রের তৈরি করে দেওয়া সামাজিকতায়, নারী কেবল একজন পুরুষের যৌনতার ব্যক্তিগত সহায়ক হবেন। তাই তাঁকে বোরখা বা ঘোমটায় মুখ ঢাকতে হবে। নারী সংসারে বিনা বেতনের কর্মচারী হবেন। তাই তাঁর শ্রম অর্থনীতির ভাষায় উৎপাদনমূলক নয়। তিনি লেখাপড়া জানলে সন্তানের প্রাইভেট টিউটর, চাকরি করলে স্বামীর সামাজিক অবস্থানের মই। তবু, নারীকে জন্মাতে দেওয়াই পাপ। তাঁর জীবনের অধিকার’ স্বীকার করা তো মহাপাপ! তাই কন্যাভ্রুণ হত্যায় এই দেশ রেকর্ড গড়ে। ভারতীয় নারী কেন কোভিডেরপ্রতিষেধক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এমন অনেক অপমান, অবহেলা আর বঞ্চনার অভ্যাসে। যাঁর জীবনই মূল্যহীন, তাঁর আবার জীবনদায়ী’ টিকার প্রয়োজন কী?


    সোনালী দত্ত - এর অন্যান্য লেখা


    কোভিডের টিকাকরণে মেয়েরা অনেক পিছিয়ে, লিঙ্গবৈষম্যের নয়া দিকটি নিয়ে কেউ কি কিছু ভাবছেন?

    সোশাল মিডিয়া, সরকারি প্রচার সর্বত্রই দেশপ্রেম শুধুই অস্ত্র হাতে একটি প্রতিবেশী দেশের উপর আস্ফালন

    জীবনের মূল্য কম বলেই টিকায় পিছিয়ে নারী-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested