×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • কৃষক আন্দোলনের মোকাবিলায় সাম্প্রদায়িক কৌশল

    গৌতম রায় | 18-12-2020

    জনগণের প্রতিরোধের সম্মুখে সাম্প্রদায়িক বিভাজনই অস্ত্র শাসকের।

    রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’র প্রচার, প্রসার এবং প্রয়োগে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি আত্মনিবেদিত। গত ছয় বছরের কিছু বেশি সময় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আছে। এই সময়কালে ‘সাম্প্রদায়িকতা’র প্রসার ঘটিয়ে ভারতের সামাজিক পরিকাঠামোটিকে তছনছ করে দেওয়া বিজেপির অন্যতম প্রধান কাজ। সেই কাজটিকে পরিচালিত করতে যাবতীয় রাজনৈতিক পর্যায়ক্রমকে ধর্মীয় বিষয়ে সংযুক্ত করে, অরাজনৈতিক প্রেক্ষিতে পরিণত করা বিজেপির লক্ষ্য। মানুষ যাতে রাজনীতি বিমুখ হয়ে, অপরাজনীতিকেই রাজনীতি বলে ধরে নেয়, যাতে আরএসএস-এর রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’ প্রসারের কাজটি ত্বরান্বিত হয়, সেই দিকে লক্ষ্য রেখেই নরেন্দ্র মোদী তাঁর সরকার পরিচালনা করে চলেছেন।

     

    মানুষ রাজনীতি সচেতন হলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের কাজটি বিপন্ন হবে- এটা হিন্দুত্ববাদী নেতারা খুব ভালভাবেই জানেন এবং বোঝেন। তাই ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর, কোভিড-19 জনিত মহামারীর ভয়াবহকতার ভিতরেও তথাকথিত রাম মন্দিরের শিলান্যাস করতে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এত তৎপরতা ছিল। এই শিলান্যাসের ভিতর দিয়ে ভারতকে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতার পর্যায় থেকে, সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে রূপান্তরিত করতে সবরকম তৎপরতা চালিয়েছে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। কার্যত সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজ, 1947-এর ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তির এই অবমাননা দেখে একদম স্তম্ভিত। সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভারতের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করতে আরএসএস-এর ‘গুরুজী’ এমএস গোলওয়ালকর যে ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’-এর তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন, সেই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগের লক্ষ্যে এখন তৎপর বিজেপি। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে কেবল মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগই আরএসএস, বিজেপি নেয়নি। বহুত্ববাদী চিন্তা চেতনায় বিশ্বাস করেন, এমন মানুষ, ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনায় আস্থাবান মানুষ, এঁদের সবাইকেই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করবার লক্ষ্যে বিজেপির এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন।

     

    সেই লক্ষ্যকে আরও দ্রুত ফলপ্রসূ করতে ভারতের কৃষি বাজারকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট, বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাগুলির মুক্তাঞ্চলে পরিণত করতে চায় আরএসএস-বিজেপি। নয়া উদার অর্থনীতির প্রয়োগের ভিতর দিয়ে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক চেতনাকে আরও জোরদারভাবে ভারতের মাটিতে শিকড় বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়া বিজেপির কৃষি আইনের সংশোধনের অন্যতম রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। চুক্তিচাষের ভিতর দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচারের প্রথম যুগে নীলচাষকে কেন্দ্র করে ‘দাদন’ প্রক্রিয়ার যে ভয়াবহকতার কথা দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘নীলদর্পণ’-এ রেখে গিয়েছেন, তেমন পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগই সংশোধিত কৃষি আইনে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রেখেছে।

     

    এনআরসি-র বিরুদ্ধে যে জাগ্রত জনমত সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির টুটি টিপে ধরতে তৎপর হয়েছিল শাহিনবাগে, মহামারীজনিত পরিস্থিতির উদ্ভব না ঘটলে, সেই শাহিনবাগ কেন্দ্রের শাসক বিজেপির রাজনৈতিক অস্তিত্বকে হয়তো অনেকাংশে বিপন্ন করে তুলত। দিল্লির শাহিনবাগ আর সেই আদলে আসমুদ্রহিমাচলে হাজারোটা শাহিনবাগ, জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনের জনজাগরণের মতোই ভারতের বুকে এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে নতুন ভাবে জনজাগরণ তৈরি করেছিল। তাই কেন্দ্রীয় সরকার আর কেন্দ্রের শাসক বিজেপি যৌথভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের চরিত্রহনন করতে শুরু করে। তারা এই আন্দোলনটিকে কেবলমাত্র মুসলমানদের আন্দোলন হিসেবে মেলে ধরে, দেশের আপামর জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করবার পথে হেঁটেছিল। সেই পদ্ধতিতেও সাফল্য অর্জন করতে না পেরে জামিলা মিলিয়ায় পড়ুয়াদের ওপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল। সেখানেও সাফল্য বিশেষ না পেয়ে  দিল্লি গণহত্যার নারকীয়তায় স্তম্ভিত করেছিল সারা দেশকে।

     

    সংশোধিত কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকেরা আজ দিল্লিকে কার্যত অবরুদ্ধ করে ফেলেছেন। এই আন্দোলনের শুরুতে অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাতে চেষ্টা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। আন্দোলনরত কৃষকদের উপর দিল্লির প্রবল শীতে, গভীর রাতে জলকামান দাগার মতো অমানবিক কাজ করতেও পিছপা হয়নি কেন্দ্রের সরকার। তবু পিছু হটেননি আন্দোলনরত কৃষকেরা।

     

    তাঁদের আন্দোলনকে পাঞ্জাবের কিছু বিপথগামী লোকের কাজ বলে উপহাসের ভিতর দিয়ে এই আন্দোলনে বিভাজন তৈরির চেষ্টা প্রথম শুরু করে আরএসএস, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মাধ্যমে। তারপর সেই সুরে কথা বলতে শুরু করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বর্ষীয়ান সদস্যেরা। তাতেও এই আন্দোলনকে দমাতে না পেরে, আন্দোলনকারীদের প্রতি নানা রকমের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে যে নাগরিক সমাজ, তাদের সম্পর্কে ধর্ম আর জাতপাতের সুড়সুড়ি দিতে গোটা গোবলয় জুড়ে আরএসএস নিজেদের হাজার রকমের শাখা সংগঠনকে নামিয়ে দিয়েছে।

     

    অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের ভিতর আধুনিক শিক্ষা না পাওয়ার যে দুর্ভাগ্যজনক পটভূমিকা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থাকে, সেই ক্ষেত্রকে ব্যবহার করেই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি আরএসএস তাদের নানা পর্যায়ের শাখা সংগঠন এবং রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’-কে ফলপ্রসূ করে তোলার চেষ্টা করে। আর সেই চেষ্টার অঙ্গ হিসেবেই ধর্ম আর জাতপাতের বিভাজনকে তীব্র করে, নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথে তারা হাঁটে। ফলে গরিব মানুষকে খুব সহজেই তাদের আধ্যাত্মিক আকুলতাকে ধর্মীয় বিভাজনের বৃত্তে হিন্দুত্ববাদীরা টেনে আনে। এই কাজে তারা সাম্প্রতিক অতীতে বিশেষ ভাবে সফল হচ্ছে তার কারণ, হিন্দুত্ববাদীদের এই রাজনৈতিক কৌশল, যা তারা নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক আবরণে ঢেকে সামনে মেলে ধরে, তাকে প্রতিহত করতে বিরোধীদের তেমন কোনও উদ্যোগ আন্তরিক ভাবে দেখতে পাওয়া যায় না বলে। আরএসএস-বিজেপির এই সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মোকাবিলায় পাল্টা সামাজিক প্রযুক্তির কথা বামপন্থীরা তাঁদের দলিল দস্তাবেজে বলেন। কিন্তু দলিলে লেখা সেইসব আপ্তবাক্যের বাস্তবায়নে তাঁরা সেভাবে আন্তরিকতা দেখান না। কার্যত একটা পোষাকি লড়াইয়ের ভিতরেই তাঁরা তাঁদের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনকে সীমিত রাখেন। ফলে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন, সেভাবে সামাজিক আন্দোলনের রূপ পায় না।

     

    সাম্প্রদায়িক শক্তি, এর সুযোগটা খুব ভালভাবে নেয়। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের যে গণহিস্টিরিয়া আরএসএস, বিজেপি বা তাদের সঙ্গীসাথীরা রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে গুলিয়ে দিয়ে সেটাকেই রাজনীতির মুখ্য বিষয় হিসেবে তুলে ধরছে, সে সম্পর্কে অ-বিজেপি, বাম, অ-বাম, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান অনেকটাই ভোটমুখী। তাই সিপিআই(এম) ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রামমন্দিরের শিলান্যাস ঘিরে মন্তব্যের ভিতরেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখলেন। পাছে হিন্দু ভোট হারায়, তাই নিও-নর্মাল অবস্থায় নানা অর্থনেতিক, রাজনৈতিক প্রশ্নে নিজেদের দাবিকে মাঠে ময়দানে নামিয়ে আনলেও বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গে এখন তাঁরা রাস্তায় হিমশীতল নীরবতা পালন করছেন।

     

    সংখ্যালঘু প্রীতির প্রমাণ হিসেবে মোনাজাতের ভঙ্গিমায়, হিজাব পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফটোশ্যুট করে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করলেও, বাবরি মসজিদের জমি সংক্রান্ত দেওয়ানি মামলা ঘিরে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক মসজিদের জমি আরএসএস-এর ‘রামলালা’-কে হস্তান্তর ঘিরে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। সংখ্যালঘুর অধিকার সুনিশ্চিত করার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েই 1947-এ জাতীয় নেতারা ব্রিটিশের সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তি করেছিলেন। ইসলামে মসজিদ স্থানান্তরের কোনও বিধি বিধান নেই। অথচ, এই দেওয়ানি মামলার রায়ে বাবরি মসজিদ স্থানান্তরের মতো একটি ভয়ঙ্কর ইসলাম বিরোধী রায় সুপ্রিম কোর্ট দেওয়া সত্ত্বেও মমতা-সহ ভারতের অ-বিজেপি রাজনৈতিক নেতারা কোনও তাপোত্তাপ প্রকাশ করেননি। ভোটের বালাই কি সব থেকে বড় বালাই? সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রশ্নটি কি কেবলমাত্র কাগজ কলমেই সীমাবদ্ধ? আন্তর্জাতিক সংখ্যালঘু অধিকার দিবসে কয়েকটা সভা-সমিতি করলেই কি সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রশ্নে যথার্থ ভূমিকা পালন করা হল?

     

    সংশোধিত কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকদের আন্দোলনকে ধর্ম আর জাতপাতের নামে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টার কসুর করছে না আরএসএস, বিজেপি। আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও, জাতধর্ম নির্বিশেষে কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষদের তৈরি খাবার খেয়েই অবস্থানে অটল রয়েছেন। তাঁদের দেওয়া শীতবস্ত্রেই শীত নিবারণ করছেন। আরএসএস, তাদের সামাজিক প্রযুক্তি দিয়ে আন্দোলনরত কৃষকদের যাঁরা খাবার তৈরি করে দিচ্ছেন, সেইসব মানুষদের জাতধর্ম নিয়ে অত্যন্ত নোংরা প্রচার চালাচ্ছে। এই প্রচারের ভিতর দিয়ে আরএসএস আন্দোলনকারীদের ঠিক 1857 সালে, দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামকালে দাঁত দিয়ে টমবন্দুকের টোটা কাটা জনিত যে বিতর্ক, সেই আদলে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

     

    এনআরসি বিরোধী আন্দোলনেও এই ধরণের নোংরা প্রচার আরএসএস করেছিল। সেই প্রচার করেও তারা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। আন্দোলনকারীদের ভিতরে ধর্মের বিভাজন তৈরি করতে পারেনি। কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদেরও এইভাবে সাম্প্রদায়িক ভাবে বিভাজিত করবার যে নোংরা খেলায় আরএসএস, বিজেপি মেতেছে, সেই খেলাতেও তারা কোনও অবস্থাতেই সফল হবে না।


    গৌতম রায় - এর অন্যান্য লেখা


    প্রতিবাদ রুখতে ধর্মপরিচয়ে নাগরিকদের ভাগ করছে রাষ্ট্র।

    ভোটমুখী রাজ্যে শিল্প গড়ার ডাক দিলেও দেশে বড় শিল্প আনতে পারেননি মোদী।

    কৃষক আন্দোলনের মোকাবিলায় সাম্প্রদায়িক কৌশল-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested