×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • রায়ের সমালোচনা মানেই আদালতের অবমাননা নয়

    তপন দাস | 15-02-2020

    কলকাতা হাই কোর্ট

    বিচার  বিভাগের স্বাতন্ত্র্য  ভারতের সংবিধানের  কাঠামোর আবশ্যক অংশ। কিন্তু বিচারব্যবস্থা বা বিচারপতি কেউই সমালোচনার উর্ধ্বে নন। আমরা ভারতের জনগণ আমাদের সংবিধান বিচারব্যবস্থাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছি ঠিকই, কিন্তু তাকে সমাজবিচ্ছিন্ন ভাবে গজদন্তমিনারে প্রতিষ্ঠা করিনি।

     

    যে কোন সচেতন মানুষ সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহে নজরে রাখলে লক্ষ্য করবেন সাধারণ মানুষ এবং সংবাদমাধ্যম আইন বিভাগের দুর্বলতার বিষয়ে সংবাদপত্র এবং বৈদুতিন মাধ্যম দেখব না, শুনব না, বলব না-র নীতি অনুসরণ করে নিঃসন্দেহে আদালত অবমাননার ভয়ে।

     

    মতপ্রকাশের স্বাধীনতা  মৌলিক অধিকার। এই স্বাধীনতা অবশ্য আদালত অবমাননার ক্ষেত্রে খর্ব করা যায়।

     

    আদালত অবমাননার সংজ্ঞা কী, এই আলোচনার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি কী কী থেকে আদালত অবমাননা হয় না সেই বিষয়ে আলোচনা।

     

    ১৯৭১ সালে প্রণীত আদালত অবমাননা আইনে অবমানানর সংজ্ঞা অস্পষ্ট, অস্বচ্ছ এবং অনিয়ন্ত্রিত। অপযশকারক বলতে আসলে কী বোঝায় সেটা নির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলতঃ বিচারক তার নিজের প্রয়োজন মতো শব্দের অর্থ প্রসারিত করতে পারেন। তবে ওই আইনেই এটা বলা হয়েছে যে কোনও রায়ের যথাযথ সমালোচনা আদালতের অবমাননা নয়।

     

    সময়ের সাথে সাথে অবমাননার ধারণা পরিবর্তিত হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের দুটো রায়ের তুলনামূলক আলোচনায় এটা পরিষ্কার হতে পারে।

     

    প্রথম মামলা ই-এম্ এস্ নাম্বুদিরিপাদ বনাম টি নারায়ানন। ( এ, আই, আর ১৯৭০, সুপ্রিম কোর্ট ২০১৫)

     

    কমিউনিস্ট নেতা এবং কেরলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নাম্বুদিরিপাদ এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন মার্কস এবং এঙ্গেলস বিচার বিভাগকে উৎপীড়নের যন্ত্র বলে মনে করতেন। একথা আজও সত্য। এখনও বিচারপতিরা তাদের শ্রেণী ঘৃণা এবং শ্রেণী চেতনা দ্বারা পরিচালিত হন। একজন পেটমোটা ধনী এবং গরীব মানুষের মধ্যে মামলায় যদি দু’জনে সমান আইনি অবস্থানে থাকেন, তবে বিচারের রায় আবশ্যিকভাবে ধনীর পক্ষে যাবে।

     

    আদালত অবমাননার মামলার নাম্বুদিরিপাদ দোষী সাব্যস্ত হন। সুপ্রিম কোর্ট তাঁর সাজা বহাল রাখেন।

     

    এই মামলা অবশ্য ১৯৫২ সালে প্রণীত আইন অনুযায়ী হয়েছিল, বর্তমান আইনে নয়। দ্বিতীয় মামলা ১৯৮৮ সালে। এটি  পি. এন দুদা বনাম পি শিবশংকরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মামলা (এন আই আর ১৯৮৮ সুপ্রিম কোর্ট ২০০৮)।

     

    কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি শিবশংকর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন বিচারপতিরা অভিজাত শ্রেণীভুক্ত, তাদের গোপন সহমর্মিতা অর্থবান শ্রেণী এবং জমিদারদের প্রতি। অর্থাৎ পি শিবশংকরের বক্তব্য প্রায় নাম্বুদিরিপাদের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। এবার কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত এই বক্তব্যকে অবমাননা বলে গণ্য করেননি।

     

    এই মামলার রায়দানের সময় সুপ্রিম কোর্ট অবমাননা বিষয়ক আইনের বিস্তারিত আলোচনা করেন। লর্ড অ্যাটকিনকে উদ্ধৃত করে সুপ্রিম কোর্ট বলেন, ‘Justice is not a cloistered virtue. She must be allowed to suffer the scrutiny and respectful, even though outspoken comments of ordinary men. ’

     

    বিচারপতিরা সমাজের কাছে, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। গণতন্ত্রে জনগণই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। সমস্ত সরকারি পদাধিকারী, এমনকী বিচারপতিরাও জনগণের সেবক। তাই ব্যক্তি বিচারক এবং বিচারব্যবস্থা কোনওটাই সমালোচনার ঊর্দ্ধে নয়।

     

    এটা ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে যে আদালত অবমাননার আইন ব্যক্তি বিচারকের মর্যাদা রক্ষার হাতিয়ার নয়, তাঁর অন্যায় গোপন করার ঢালও নয়। অবমাননার হাতিয়ার শুধুমাত্র বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা রক্ষার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হওযার কথা, অন্যথায় নয়।

     

    তা হলে কি বিচারব্যবস্থা বা বিচারপতি সম্পর্কে যা ইচ্ছে বলবার বা লেখবার অনিয়ন্ত্রিত লাইসেন্স আছে? না, তা নয়। কোন সমালোচনা যথার্থ বা কোনটা বিচারব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকারক, সেটা বিচারপতিকেই স্থির করতে হয়, তিনি নিজে তাঁর মামলার বিচারক। সুতরং অবমাননা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিচারপতির সর্বোচ্চ স্তরের সংযম প্রদর্শন আবশ্যিক।

     

    সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু তাঁর ""Whither Indian Judiciary'' বইতে ইংল্যান্ডের এক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। এক মামলায় সে দেশের বিচারক দেশের নিরাপত্তার যুক্তিতে একটি বইয়ের প্রকাশ নিষিদ্ধ করেন। সংবাদমাধ্যম এই রায়ের তীব্র সমালোচনা করে। The Mirror পত্রিকায় বিচারকদের ছবি উল্টো করে ছাপিয়ে লেখা হয় "" YOU FOOLS '' ভারতের প্রখ্যাত আইনজীবি ফলি নরিম্যান তখন সেদেশে ছিলেন। তিনি জানতে চান এতে আদালত অবমাননা হলো কিনা। একজন বরিষ্ঠ বিচারপতি বলেন যে, ইংল্যান্ডের বিচারপতিরা ব্যক্তিগত অপমান গ্রাহ্যের মধ্যে আনেন না। তাঁরা জানেন, তাঁরা বোকা নন। কেউ যদি বোকা বলে সেটা তার মত, এতে ওঁরা মোটেই বিচলিত নন।

     

    বিচারবিভাগের স্বার্থেই এই প্রতিষ্ঠানের ত্রুটি এবং দুর্বলতা সাধারণের গোচরে আসা আবশ্যিক। অনেকেরই একটা সাধারণ ধারণা আছে যে, বিচারবিভাগের ত্রুটি-বিচ্যুতি বাইরে প্রকাশিত হলে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। তাই যখন সুপ্রিম কোর্টের চার বিচারপতি সামগ্রীক ব্যবস্থার দুর্বলতা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করেন, তখন অনেকেই স্তম্ভিত হয়েছিলেন। গণতন্ত্রে মানুষকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ভাববার সঙ্গত কোনও কারণ নেই। মানুষ জানে বিচারকেরাও মানুষ, তাঁদেরও মানবিক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। থাকাই স্বাভাবিক। উল্টোদিকে যদি ত্রুটি-বিচ্যুতি গোপন রাখা হয়, তবে সেটা গোপনেই বিস্তৃত হয় বিনা চিকিৎসায়। সুতরাং, অবাধ সমালোচনার পরিসর উন্মুক্ত হতে হবে।

     

    ভিত্তিহীন নোংরা কুৎসা ছাড়া আর কোনও কিছু অবমাননাকর নয়। যথাযথ সমালোচনা বিচারবিভাগের ভিত শক্ত করে, বিচারপথ রুদ্ধ করে না।

     

    বিচারপতিরা অনেকেই আজও ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র অহমিকাবোধ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অরুন্ধতি রায়ের সাজা বিচারবিভাগের মর্যাদা বাড়ায়নি।

     

    এই ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় সমালোচনার দায়িত্ব নিতে হবে বিচারবিভাগের কার্যকারিতার স্বার্থেই। সূর্যের আলো সবচেয়ে কার্যকরী জীবাণুনাশক। তাই সমালোচনার আলো পড়ুক বিচারবিভাগের প্রতিটি অন্ধকার কোণে।

     

    (লেখক প্রাক্তন বিচারক)


    তপন দাস - এর অন্যান্য লেখা


    পশ্চিমবঙ্গে প্রণীত এই আইনের নাম হয় ‘The West Bengal restoration of alienated land act, 1973’।

    অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির যাবতীয় শারীরিক তথ্য সংগ্রহ করে তা 75 বছর সংরক্ষণ করতে পারবে সরকার

    আদালত অবমাননা কথাটাই মানুষের মনে এমন ভয় জাগায় যে কোর্টের রায় ও বিচার নিয়ে ন্যায্য সমালোচনাও হয় না।

    কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত বা আইন সম্মত?

    রায়ের সমালোচনা মানেই আদালতের অবমাননা নয়-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested