অতি সম্প্রতি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী অমিত শাহ ফৌজদারি কার্যবিধি বিষয়ে সংসদে এক বিল উত্থাপন করেন, যার নাম ""The Criminal Procedure (Identification) Bill 2022.''
এই বিল উত্থাপন করে তিনি বলেন যে, অভিযুক্তের শনাক্তকরণ সম্পর্কিত 1920 সালে প্রণীত Identification of Prisoners Act 1920 যুগোপযোগী নয়, এবং সেই আইনের অজস্র ত্রুটি সংশোধনের লক্ষ্যে নতুন আইনের প্রয়োজন। তিনি প্রস্তাবিত নতুন আইনে Identification of Prisoners Act 1920 বাতিলের প্রস্তাব করেন।
বিরোধীরা বিলের বিষয়ে তীব্র আপত্তি করেন মূলত চারটি কারণে:
•এই আইনের মাধ্যমে সরকার নাগরিকদের ব্যক্তিগত পরিসরে (privacy) প্রতিনিয়ত নজরদারি চালাবার আইনি স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
•মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে হস্তক্ষেপ করে মৌলিক অধিকার খর্ব করবার অপ্রতিহত ক্ষমতা পুলিশের হাতে তুলে নেওয়ার রাস্তা তৈরি হচ্ছে।
• তিন, এই আইন ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী, এবং পুলিশি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুনিশ্চিত পদক্ষেপ যা ভারতের প্রতিষ্ঠিত আইনের শাসনকে বিনষ্ট করবে।
• এই আইন প্রণীত হলে সংখ্যালঘু মানুষ এক ভয়ের বাতাবরণে বাস করতে বাধ্য হবে।
বিতর্কিত বিষয়ে আলোচনার আগে প্রস্তাবিত আইনের ধারাগুলি দেখে নেওয়া যাক, 1920 সালের আইনের প্রেক্ষাপটে।
এই আইনের ঘোষিত উদ্দেশ্য হল, ফৌজদারি তদন্ত, এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রয়োজনে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি এবং অন্যান্যদের পরিমাপ নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান। (to Authorize for taking measurements convict and other persons for the purpose of identification and investigation in criminal matters and to preserve records and for matters connected and incidental there too.)
1920সালে অর্থাৎ বিদেশি ইংরেজ শাসক প্রণীত আইনে ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল সাজাপ্রাপ্ত বন্দি এবং অন্যান্যদের পরিমাপ এবং ফটোগ্রাফ নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান। (an act to Authorize the taking of measurements and photographs convicts and others.) মূল পার্থক্য হল পরিমাপ বা measuremnets এর ধারণায়। পুরনো আইনে পরিমাপ বলতে বোঝাত হাতের আঙুলের ছাপ (fingure print) এবং পায়ের ছাপ (foot print)। লক্ষ্যনীয় এখানে ছবি বা ফটোগ্রাফ অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
প্রস্তাবিত আইনে পরিমাপের সংজ্ঞা পুরোপুরি পাল্টে দেওয়া হয়েছে। পরিমাপ (measurements) অর্থ আঙুলের ছাপ, হাতের ছাপ, পায়ের ছাপ, ফটোগ্রাফ, চোখের আইরিশ, এবং রেটিনা স্ক্যান, শারীরিক এবং শারীর বৃত্তীয় নমুনা এবং সেগুলোর বিশ্লেষণ, ব্যবহারিক প্রবণতা, হস্তাক্ষর এবং সই। এছাড়াও ফৌজদারি কার্যবিধির 53, 53A ধারায় উল্লেখিত বিষয় সমূহ (Measurements include fingure impressions, palm print impression, foot print impression, photographs, iris and retina scan, physical, biological samples and their analities, behavioural attributes including signature handwriting or any other examination referred to in section 53 and 53A of the code of criminal procedure 1973)
এবার ফৌজদারির কার্যবিধির 53A অনুযায়ী পরীক্ষা (examination) অর্থে Examination of Blood stains, semen, swab, sweat, hair samples, and fingure nail clippings by the use of modern techniques including DNA profiling ইত্যাদি সমস্ত কিছুর পরীক্ষা। অর্থাৎ মানুষের শরীরের প্রায় সব কিছু এই সমস্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করার ক্ষমতা পুলিশের হাতে। পুরনো আইনে পুলিশ অফিসার বলতে এসআই বা তার ঊর্ধ্বতন অফিসার বোঝাত। এখন হেড কনস্টেবলও এই আইনে পুলিশ অফিসার বলে পরিগণিত হবে।
এই পরিমাপ নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বাঁধা দিলে সেক্ষেত্রে পুলিশকে আইনি অধিকার দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।
কোন কোন ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহীত হবে?
1. যে কোনও অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি (এর মধ্যে সাধারণ ছোটখাটো অপরাধও অন্তর্ভুক্ত।
2. আইন শৃঙ্খলা না ভাঙবার মুজলেকা দেওয়া ব্যক্তি।
3. যে কোনও অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি।
এই তিন নম্বর বিষয়ে একটু ছাড় দেওয়া আছে। একজন অভিযুক্ত যদি না তিনি কোনও মহিলা বা শিশুর বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত না হন কিংবা সাত বছর বা তার বেশি কারাদণ্ড হয় এমন অপরাধে অভিযুক্ত না হন তবে তিনি অবশ্য শারীরিক নমুনা সংগ্রহে আপত্তি করতে পারেন।
নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে পুলিশের ক্ষমতা অপ্রতিহত। এক্ষেত্রে কোর্ট বা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি পরোয়া তাকে করতে হবে না।
সংগৃহীত সমস্ত তথ্য ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB) - র তথ্য ভাণ্ডারে জমা থাকবে পঁচাত্তর বছর পর্যন্ত। তাঁরা এই সমস্ত তথ্য বিনিময়ে প্রচার পর্যন্ত করতে পারবেন।
আরও পড়ুন:কোভিডের বর্ণমালা
এই আইনের যথার্থ্য বা উপযোগিতা আলোচনার আগে কয়েকটি আইনি ধারা স্পষ্ট হওয়া দরকার।
1. এদেশের কোনও আইন সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হবে না। (সংবিধানের 13 নম্বর ধারা)
2. আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোনও ভাবে কোনও ব্যক্তির জীবন বা ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার খর্ব করা যাবে না। (সংবিধানের 21 নম্বর ধারা)
3. জীবন বা ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার খর্ব করে যদি কোনও আইন থাকে তবে সেই আইন কে হতে হবে ন্যায় সংজত, যথাযথ এবং যুক্তি সংযত (just, fair and reasonable) । এটা সুপ্রিম কোর্ট স্থির করে দিয়েছেন (মেনোকা গান্ধী ভার্সেস ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া, AIR 1978 s.c 597) মামলায়।
4. ব্যক্তি পরিসর বা প্রাইভেসি জীবন বা ব্যক্তি স্বাধীনতার অঙ্গ। সেই কারণে মৌলিক অধিকার সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত AIR 2017 s.c 4161 জাস্টিস পুটুস্বামী 2 another ভার্সেস ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া।
5. রাইট টু প্রাইভেসি চূড়ান্ত বা অ্যাবসলিউট নয়। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এ অধিকার খর্ব করা যায়।
রাষ্ট্র সততই ব্যক্তি জীবনের নজরদারি চালায় এবং সে কারণে একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে আইনি বা বেআইনি পথে। প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নজরদারির নতুন নতুন কৌশল রাষ্ট্রের হস্তগত হয়েছে।
ব্যক্তিগত পরিসর বা প্রাইভেসি বলতে আসলে কী বোঝায়? দার্শনিক জেএস মিলের মতে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের যে অংশ অন্যকে প্রভাবিত করে সেগুলোর জন্য সে সমাজের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু যেটা একান্ত ভাবে তার নিজের এবং যে অন্য কারও সংযোগ নেই, সেক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বার্বভৌম। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই তত্ত্ব অবশ্য আজকের যুগে যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য নয়। সীমারেখা খুব স্পষ্ট নয়। ঠিক কোনখানে ব্যক্তি পরিসর সামাজিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করে সেটা খুব সহজে স্থির করা যায় না। সুতরাং একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ও। সামাজিক গুরুত্ব অর্জন করে। যদি সেই বিষয় অন্য কোনও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। তেমন ক্ষেত্র ছাড়া ব্যক্তিগত বিষয়ে রাষ্ট্রের নজরদারি কাম্য নয়। রাষ্ট্রের নজরদারি যুক্তিসংগত হয় যদি সেটা হয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং মানুষ নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না।
বর্তমান প্রস্তাবিত আইন, প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের হাতে অনিয়ন্ত্রিত নজরদারির অস্ত্র। এই আইনবলে পুলিশ তাদের পছন্দের (প্রকৃতপক্ষে অপছন্দের লোকেদের) বায়োমেট্রিক নমুনা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করবে।
একজন ব্যক্তি তিনি যদি অতি সাধারণ অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হন এবং তিনি শাসক দলের বিরোধী মতাবলম্বী হন, তবে তিনি পরবর্তী পঁচাত্তর বছর সরকারের নজরদারির শিকার হবেন।
এই আইন সাম্যের অধিকারের পরিপন্থী। এখন ব্যক্তি, যার সাজা হয়েছে তাকে আগামী পঁচাত্তর বছর আসামী হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে যেহেতু এখানে সব মানুষের নমুনা সংগৃহীত হচ্ছে না। তাই বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির হয়রানির সম্ভাবনা বড় হয়ে উঠেছে। বায়োমেট্রিক নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা অবশ্য ফৌজদারি কার্যবিধি তে অনেক আগেই ঢোকানো হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে পুলিশের অধিকার অনেকটা সীমিত।
এই আইনের সবচেয়ে বিপদজনক দিক হল সংগ্রহীত তথ্যের গোপনীয়তার ব্যবস্থা না রাখা। পুলিশ নমুনা সংগ্রহ করবে, NCRB সেই নমুনা তাদের হেফাজতে নেবে এবং সংরক্ষণ করবে। প্রয়োজনে আইন রক্ষাকারী যে কোনও সংস্থার কাছে সেই তথ্য সরবরাহ করবে।
অন্য আর কোনও ভাবে এই সংরক্ষিত তথ্য ব্যবহৃত হবে না। সেই আশ্বাস এই আইনে নেই। তার থেকেও বড় কথা বিজ্ঞান যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তাতে সংগৃহীত তথ্য ব্যক্তির চিন্তা জগতে অনুপ্রবেশ করে তাকে কলুষিত করবার (manupulation) কাজে ব্যবহৃত হবে না, সে নিশ্চয়তা নেই।
ব্রিটিশ শাসনে এদেশের কিছু কিছু উপজাতি অপরাধপ্রবণ উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত ছিল। সরকার তাদের উপর বিভিন্ন ভাবে নজরদারি চালাত। আবারও সেই আশঙ্কা জোরদার হচ্ছে। এবার লক্ষ্য আর উপজাতিরা নয়, সাজাপ্রাপ্ত মানুষের নামে সরকার বিরোধী কণ্ঠস্বর। সরকার ঘোষিত হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা এই আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে।
সর্বশেষে এটা বলা যায় যে, প্রাইভেসির অধিকার আসলে মানুষের মর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং এই আইন প্রকৃত প্রস্তাবে মানবাধিকার বিরোধী।
পুটুস্বামী মামলায় (justice Putuswami v/s U.O.I) সুপ্রিম কোর্ট বায়োমেট্রিক নমুনা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এখানে সে নিরাপত্তা নেই। এই মামলা আধার কার্ডের জন্য সংগৃহীত নমুনা বিষয়ে যেখানে বায়োমেট্রিক নমুনা শুধু মাত্র হাতের ছাপ এবং আইরিশ।
অন্যদিকে সেলভি স্টেট অফ কর্ণাটক মামলায় বলা হয়েছে পলিগ্রাফ টেস্ট করতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির লিখিত অনুমতি নিতে হবে। এবং সেই অনুমতি নিতে হবে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে। এমন কোনও সাবধানতার সুযোগ এই আইনে নেই। এই আইনের ঘোষিত উদ্দেশ্যের পিছনে এক ভয়াবহ চক্রান্তের ইঙ্গিত আছে। এই আইন এখনই প্রতিহত না করলে গণতন্ত্র ডুবে যাবে পুলিশি শাসনের তলে।
আদালত অবমাননা কথাটাই মানুষের মনে এমন ভয় জাগায় যে কোর্টের রায় ও বিচার নিয়ে ন্যায্য সমালোচনাও হয় না।
অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির যাবতীয় শারীরিক তথ্য সংগ্রহ করে তা 75 বছর সংরক্ষণ করতে পারবে সরকার
পশ্চিমবঙ্গে প্রণীত এই আইনের নাম হয় ‘The West Bengal restoration of alienated land act, 1973’।
কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত বা আইন সম্মত?