×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • বিশুদাদা

    রাকিবা সুলতানা | 19-06-2020

    "বিশুদাদার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দাও

    গোমড়া মুখে, ফ্রকের ফিতে চিবোতে চিবোতে পরিষ্কার আর্জি জানালামঘর ঘর খেলার নিয়মে, একটা ইউনিভার্সাল বাচ্চা প্রয়োজন। বাড়ির ও পাড়ার দাদা দিদিরা কোনওরকম কুণ্ঠা ছাড়া আমাকেই খেলার পুতুল বানিয়ে দিতআসল জীবনেও বাবা মায়ের ধাতানি, খেলতে এসেও কাল্পনিক বাবা মার ধাতানি! একই গল্প আমার মানহানি ঘটাচ্ছিল। মনে হল, এই একমাত্র উপায়।

     

     দিদি চোখ বড় বড় করে ধমক দিল-

     "ছিঃ! বলতে নেই। সবার সঙ্গে সবার বিয়ে হয় না। বিশু আমাদের মুনিষ খাটে বিশুদাদা আমাদের সামনেই, গোয়ালের পাশে খড় কাটছিল 

    "কেন? হবে না কেন?’ ঠোঁট ফুলিয়ে প্রশ্ন করতেই, তাড়াতাড়ি এসে কাঁধে তুলে নিয়ে বলেছিল - "বুনু, তুমার জন্যি রাজপুত্তুর আসবে! পাল্টা প্রশ্ন করার আগে, আমায় দল থেকে ভাগিয়ে নিয়ে গেল- খিড়কির দরজা দিয়ে মেজো আব্বুর বাগানে নিয়ে এসে, জড়ো করা খড়ের উপর বসিয়ে রাখলখামার ঝাঁট দিতে দিতে আগডুম বাগডুম গল্পের ফাঁদ পাততেই সব প্রশ্ন মাথা থেকে উধাও। গল্পের সাপ, ফড়িং, ধুতরো ফুল আর পেতনি ভূতের মজলিশ আমায় বিয়ের প্রসঙ্গ থেকে দূরে রেখেছিল বহুদিন। ওদিকে, আমার বিচক্ষণ ও এঁচোড়ে পাকা দাদা দিদিরাও খেলা বদলে ফেলল

     

    দশ বছর বয়সে বিশুদাদা, মায়ের সঙ্গে এসে জোটে আমাদের বর্ধমানের বাড়িতে। দাদুর জিম্মায় রেখে, ওর মা চলে যায় অন্য বাড়ি; ক্ষেতমজুরি করতে। তিনবছর পর, দাদু সব দায় দায়িত্ব থেকে ছুটি নিলে, দাদুর উপর থেকে তা পাচার হয় বড় আব্বুর উপর। সারা বছর চাষের কাজ শেষ করে পাওনা ধান ও টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যেত বিশুদাদা। ধান রোয়ার সময় নিয়মমাফিক ফিরে আসত আমাদের বাড়ি। মাঠের সঙ্গে, গোয়ালঘরের কাজও ছিল তার জিম্মায়। গোয়ালঘরের কাজেই ওর বেশি মন ছিল; আর অবসর যাপন বলতে খড় কাটা। ধারালো বঁটির আঘাত থেকে আঙুল বাঁচিয়ে, খসখস আওয়াজ তুলে কয়েক গুচ্ছ খড় কেটে ফেলা- এই ছিল ওর প্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে একটা। তারপর বাড়তি দায়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলাম আমি। আমার বিকেল বাউন্ডুলেমির অন্যতম দোসর ছিল সে।

     

    দাদা-দিদিরা কখনও উপরমহল থেকে পুরো গ্রাম ঘোরার আইন পাশ করিয়ে আনলে, বিশুদাদা নিজেই কোলে নিয়ে ঘুরত একটানা। ও ছাড়া, কেই বা আঁশটে ফলের সন্ধান দেবে? কিংবা পাকা খেজুর? কোন বাগানে ফুটি ধরেছে, আম বাগানের মালিক দুপুরের কোন সময় ঘুমোচ্ছে, কোন পতিত জমিতে কাঁকুড়ের রমরমা, এসবই ছিল তার নখদর্পণে 

     

    বিশুদাদার দৌলতে আমার একটা নির্ভেজাল অনন্ত ছেলেবেলা ছিলকয়েক পা হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলেই কখনও কাঁধে বা কোলে- এখন ভাবলে মনে হয়, ঐ কাঁধই আমায় উচ্চাকাঙ্খী হতে শিখিয়েছিল      

     

    আমার জগতের একটা নিজস্বতা ছিল স্মৃতির তলানি থেকে খুঁজে এনে সাজিয়ে দেখলে... কতগুলো মার্বেল, চার আনা পয়সা, কুচো পাথর আর কিছু মরে যাওয়া ফুলের সন্ধান মিলবে। এখন আর তাদের মধ্যে যোগসাজশ  ঘটাতে পারব না। আদরের চাদর একটু গা থেকে খসেছে তো বিশুদাদা হাজির। 

    "চলো বনু, হাঁসছানা দেখবে

     

    সময়ের গন্ধ তুলে রাখা গেলে নিশ্চিত ব্যবস্থা নিতাম। তবু পুরনো দিনের সংজ্ঞা টানলে- ভিজে মাটি, সোনালি ধান, পুকুরে মাছের গন্ধ আর দাদির গায়ের সংমিশ্রণ মাঝে মাঝে ঝোড়ো বাতাস হয়ে ভেসে আসে। তার সঙ্গে দুএক টুকরো ছবিও- হাঁসছানার প্যাঁকপ্যাঁক, পাখির কিচিরমিচির, আর অবিশ্রান্ত ঝিঁঝি- হারিয়ে যাওয়া মেঠো সিম্ফনির রেকর্ড। বাঁশবাগান ছিল আমাদের সেই সময়ের সহজ ও সুলভ শৌচাগারবাথরুমে বড়দের লাইনের চোটে জায়গা না হলে মা, বড় মা বসিয়ে দিয়ে আসতো ঐ বাঁশঝাড়েই। পিছনে মস্ত ডোবা আর পাশে জটাধারী, অতিকায় বটগাছ। তার বুড়িয়ে যাওয়া শেকড় পরাবাস্তবীয় আবেশ তৈরি করতপাড়াগাঁয়ে জ্বীনের গল্প প্রচলিত ছিল- এতেই আমার ধারণা হয়েছিল, ডোবায় জ্বীন ঘুমিয়ে আছে; সুযোগ পেলে- একদিন এই অবস্থাতেই পিছন থেকে এসে গিলে খাবে!

     

    আর ছিল সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি খোঁজার ঝোঁক! কিন্তু জীবনে উটকো ঝামেলা ছিল না। ভরপুর স্নেহ ও প্রচণ্ড আস্কারা অর্জন করেছিলাম। বাড়িতে একমাত্র ছোট হওয়ার এই ছিল সুবিধা।

     

    গ্রামের বাড়িতে  সেই সময় আবার হাতচাপা কলের যুগ। তাকে ঘেরা ইঁটের গাথনির চত্বরে- মা, বড় মার কাপড় কাচার কড়চা; বাসনপত্রের ঝনঝনানিকলের পাশে নর্দমার এক কোণে জমে উঠত শ্যাওলা। পলক ফেলতে না ফেলতেই তা ছড়াত পুরো কলতলা জুড়েওই এলাকায় ছোটদের প্রবেশ নিষেধ আর সবার মতোই আমারও নিষেধাজ্ঞাতেই মন চলে যায়। গ্রীষ্মের এক কাঠফাটা দুপুরে, সীমারেখা অমান্য করে কল টিপে জল নিতে গেলাম। জলের তেষ্টা ছিল না। নিয়ম ভাঙার বুনো বীজ, মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল মনে। শ্যাওলার আখড়ায় পা হড়কাতে বেশি সময় লাগেনি। সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় চোট। পা ছোড়ে যাওয়া, হাতে ঘষা লাগা, ইত্যাদি। বাড়িতে, "ধর ধর করে ওঠা হৈ চৈ ঘণ্টা খানেকের মধ্যে শান্ত হলে, আমায় ছেড়ে সব্বাই পড়ল বিশুদাদাকে নিয়ে। শুরু হল তলব। কেন সে খেয়াল রাখেনি আমার? দুপুরে কি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিল? কেনই বা কলতলায় এত্ত শ্যাওলা? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব দায় ওর উপরেই দেওয়া হলবিশুদাদার দিকে তেড়ে গেল বড় আব্বু। ও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল এক কোণে; যন্ত্রণায় কাতর হওয়া আমি, বাড়ির লোকের হম্বিতম্বিতে, মনে মনে মেনে নিলাম ওদের মতোই- সব দোষ বিশুদাদার।

     

    তারপর,একটা অলিখিত অভিমানের খেলা শুরু হল

     

    বিকেলে ঘুরতে বের হওয়ার সময়ের আগেই দিদিদের সঙ্গে পাশের ঘরে, টেলিভিশন দেখতে চলে যেতাম। যদিও ওদের সঙ্গে থেকেও দলের একজন হতে পারতাম না। সবচেয়ে অসুবিধার বিষয় ছিল- ওরা অর্ধেক কথা বলত কানে কানে। আমার শিশুমনে এতে আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হত বৈকি! কিন্তু ছোট থেকেই আমি অভিমানকে অগ্রাধিকার দিয়েছি।

     

    ঘরে ঢোকার আগে, দলিজে বিশু দাদা দেখলে-

    "কি বুনু ঘুরতে যাবে না?’ বলে ডাক দিতআমি শুধুই মাথা নেড়ে অসম্মতি প্রকাশ করতাম। বিশুদাদা কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে থাকত আমার দিকে। ছুটে এসে জিজ্ঞেস করত, "বুনু, তুমিও রাগ করেছ আমার উপর?’

     

    রাগের আক্ষরিক সারমর্ম বুঝিনি তখনমাথা নামিয়ে দুদিক ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, "আমার রাগ হয় না

     

    কিছুদিন বাদে, বাবা ছুটিতে কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরলে আমার অভিমানের খেলা জোরালো হলবাবার সঙ্গেই কাটছিল সময়। উপরন্তু মামার বাড়ি ঘুরতে যাওয়ার জন্য জোরদার প্রস্তুতি শুরু হলঅনেক তাকবাক করে গাড়ি ছুটিয়ে চলে এলাম মামারবাড়ি। ততদিনে সবই ভুলে গেছি। মামাবাড়িতেও এক দঙ্গল বন্ধু পাতিয়ে, জুটে গেছি খেলায়। বাড়ি ফেরার পালা এল। মাকে নিয়ে চলল নানির নিয়মমাফিক কান্নার রেওয়াজ। বিদায়পর্ব গুটিয়ে বাড়ি ফিরতেই দেখি, আবহাওয়া শুনশান। উষাড়া ঝাঁট দিচ্ছে বড়মা। বিকেলের এই কাজটা বিশুদাদা করে। মা কৌতূহলী প্রশ্ন করল- "একি ভাবি! বিশু কই?’ বড় মা স্বভাববশে একটা লম্বা "হুঁ টেনে প্রশ্নটা দ্বিতীয় বার করার আর্জি জানাল। মা আবার জিজ্ঞেস করতেই যাচ্ছিল,এমন সময় বড় আব্বু পাশের ঘর থেকে বলে উঠল, "কাজ ছেড়ে দিয়েছে, সে বাড়ি চলে গেছে এরপর বাবা মার প্রশ্ন বড় আব্বুকে ঘিরে ধরলআমি প্রায় কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এক এক সময় বাবার বিস্ময় মিশে যাচ্ছিল এক একটা বাক্যে- "ভাই এটা কীকরে হতে পারে? এমন তো ও নয়! কোথাও ভুল হচ্ছে না তো!

     

    বাবা বিশুদাদাকে পছন্দ করতওর গ্রাম, পরিবার এ সব নিয়ে নানান গল্প করতদলিজে, একসঙ্গে বিড়ি খেতেও দেখেছি কখনওও চলে যাওয়ার পর বাবা প্রায়ই বড় আব্বুকে চাষ আর হিসেব নিয়ে নানান প্রশ্ন করতআমার ছোটো মাথায় বিশুদাদার অনুপস্থিতির কিছু ছবি ছিল মাত্র। কোনও পরিস্থিতি আঁচ করতে পারিনি। 

     

    বড় হয়ে দিদিদের মুখে শুনেছিলাম, বিশুদাদা বছরের চাল আর টাকা পাওয়া সত্ত্বেও অস্বীকার করেছিলমিথ্যে বলেই সে কাজ ছেড়েছে ও বদনামের স্বার্থেই এমন রটনা।

     

    বাবা প্রতিবারই হেঁয়ালি করত, "গরীব মানুষের, বদনাম করে কি আর পেট ভরে?

     

    তারপর কেটে গেছে বহু বছর। কলকাতায় স্কুলে ভর্তি হয়েছি ততদিনে। গরমের ছুটিতে, গ্রাম থেকে পুরনো অ্যালবাম বগলদাবা করে এনেছিল দিদিরা। সেখানেই বিশুদাদার সঙ্গে আমার একটা ছবি দেখিয়ে, রগড় করার ভঙ্গিতে বড়দি জিজ্ঞেস করলো, "চিনতে পেরেছিস? গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম, ছবির দিকে তাকিয়ে। 

     

    অভিমানে, পরাজয়ের স্মৃতি সহ্য করা কঠিন।

     

     


    রাকিবা সুলতানা - এর অন্যান্য লেখা


    কিছু মাস আগেও ঐ জানালা ছিল নাসরিনের স্টেজ। বাপ বেটির ছুটির দিনে অবসর বিনোদন হত

    পরাজয়ের স্মৃতি সহ্য করা কঠিন

    আমি অপেক্ষারত। কার? নিজেকে করা প্রশ্নের উত্তরের...

    বিশুদাদা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested