নাসরিনের বন্ধুদের প্রকান্ড বাড়ি। পেল্লাই গাড়ি। বাহারের বাগান। ওর ঘরে নিজস্ব বলতে- একটুকরো জানালা। বাক্সজানালাটাই নাসরিনের জাদু গালিচা। ইচ্ছে হলেই সাঁই করে ঘুরে আসে শৈশব। টোকা মারে প্রথম কৈশোরের দিনগুলোর কপাটে। এই বছর মার্চে সে একুশের আগল ছুঁয়েছে। নিয়মমাফিক ভেসে চলছে- জীবনমুখী মোহনায়। কঠিন স্রোতের প্যাঁচপয়জার, অজান্তেই শিখিয়ে দিয়েছে- ঢেউ থেকে বাঁচার কারসাজি। ঢেউ তাকে শক্ত ও স্বাবলম্বী করেছে; কিন্তু কেড়ে নিয়েছে বহু কিছু। মাঝে মাঝেই নিজেকে উদভ্রান্ত মনে হয়। কত বড় বড় স্বপ্ন দেখত নাসরিন! আম্মুর কাছে এসবই প্রলাপ। বাজে বিলাসিতার গপ্পো। কিন্তু আব্বু তার মনে ইঁটের মতোই সাহসের স্তর গেঁথে একটা আত্মবিশ্বাসের ইমারত গড়েছিল। টানাপোড়েন বা অসহায়তায় বটগাছের ছায়ার মতোই প্রশান্তি জোগাত আব্বু। বিকেলে একমুখ হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরলে, বাইরের সোনালি আলো ওদের একটুকরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ত। আব্বুর বাড়ি ফিরতে না পারার বিগত আড়াই মাসের অসহায়তা, এসব বিকেলকে ছদ্মরাক্ষসীর মতো করে তুলেছে । সোনালি আলো, এসব রাক্ষসীদের ব্যঙ্গার্থক হাসি, এখন কেবলই বিষাদ বয়ে আনে- তার বাক্স জানালায়।
হায়দ্রাবাদের মীনপুরা শহরের এক কাপড় কোম্পানির টেলর মাস্টার আয়ূব সানা। পৈতৃক বাড়ি তারকেশ্বর, হুগলি। মেয়ে নাসরিন ও স্ত্রী রহেলাকে নিয়ে তার নির্ঝঞ্ঝাট ছোট্ট পরিবার। মিতব্যয়ী আয়ূব, ধীর ও স্থির স্বভাবের। চোখের সারল্যে অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। এমন ধারালো দৃষ্টিধারি মানুষেরা সাধারণত অহংকারী হন। কিন্তু আয়ূব আর অহংকার ছিল বিপরীতমুখী। নিজের পড়াশোনার ইচ্ছে থাকলেও পারিবারিক অনটনের কারণে হয়ে ওঠেনি; সর্বস্ব দিয়ে তাই মেয়েকে ভর্তি করেছে- কলকাতার নামী কলেজে। বাপ বেটির ইয়ারানার নজির পাড়ায় সর্বত্র। তা ছাড়া, যেসব এলাকায় ওরা থাকে- সেখানে মেয়েকে শিক্ষিত করতে এখনও বুকে ধক লাগে। পাড়ার বা বাড়ির লোক সামনে থেকে বাহবা দিলেও পিছনে মুখ বেঁকিয়ে মন্তব্য করতে ছাড়ে না প্রায় কেউই।
-"মেয়ে কে নিয়ে, বাপের বিস্তর গরব।’
এসব কথায় কান দেয়নি আয়ূব। প্রতি বড় পরীক্ষার শেষে, মেয়ের মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত করেছে।
সময়ের সঙ্গে জানালার চরিত্র বদলেছে। কিছু মাস আগেও ঐ জানালা ছিল নাসরিনের স্টেজ। বাপ বেটির ছুটির দিনে অবসর বিনোদন হত "মিমিক্রি’। নাসরিনের নামী কলেজের প্রিন্সিপাল দিদিমণির এলিগ্যান্ট ইংরেজি উচ্চারণ থেকে শুরু করে, পাড়ার টোটোনের তুতলে যাওয়ার অঙ্গ-ভঙ্গিমা; এমনকী বাড়ির বেড়াল- সাজুর হাই তোলা ও আদর খাওয়ার আদলও অবিকল ফুটে উঠতো নাসরিনের অভিব্যক্তিতে। যে কারও খুঁটিনাটি, অবলীলায় অনুবাদ করে দিতে পারত সে- চোখে, মুখে, চলনে বা কথার ভঙ্গিতে। সেই তালিকা থেকে আম্মুও বাদ পড়েনি। তার রাগের দৃশ্য বহুবারই মঞ্চস্থ হয়েছে, বাপ বেটির এই দোস্তানার দলিজে। এইতো... ঠিক এইখানেই। নাসরিনের কীর্তিতে হাসির চোটে চোখে পানি আসতো আয়ূব সানার।
-"আব্বু, তুমি কাঁদছ?’ কোনওরকমে হাসির ফোয়ারা সামলে; ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানাত। পিঠে আলতো আদরের চাপড় মেরে বলত-
-"খুব শয়তান হয়েছিস!’
এখন এসবই অতীত। হাসির হাওয়া বন্ধ হয়েছে- এই আড়াই মাসে। মঞ্চ এখন স্মৃতি রোমন্থনের মেশিন। ঘর জুড়ে গজিয়ে ওঠা অসহনীয় যাপনের আড়ালে, নাসরিনের নিজস্ব "নোম্যান্সল্যান্ড’। আব্বুর কি আর ফেরা হবে না? পাঁচদিন আগে শেষ ফোনে কথা হয়েছে তাদের। তারপর থেকে আর খবর নেই। একের পর এক দিন যাচ্ছে; অনিশ্চয়তার দানবিক বাষ্প জীনের মতোই গ্রাস করছে- ওদের খুপরি ঘরটাকে।
বাইশ তারিখ কলেজ থেকে অনির্দিষ্টকাল ছুটি ঘোষণার পরপরই নাসরিন অনবরত ফোন করেছে, আব্বুকে। আব্বু পাত্তা দেয়নি; হেসে বলেছে- "ওরে বেটা, খামোখা ভয় পাসনি। আমি হপ্তার শেষেই তো ফিরব।’ ফোন রাখার পরপর নিরন্তর ঘ্যানঘ্যানানি সুর বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল আম্মুকেও। আম্মু হুজুগ ভেবে শান্তিতে ছিল বহুদিন। তারপর শুরু হল, অপেক্ষার প্রহর।
ঘরের এক কোণের বোকাবাক্সে- প্রতিনিয়ত সম্প্রচার হয়ে চলেছে সমাজের মোড়লদের বাতেলা। একটা টিমটিমে জীবাণুর দমনে দূরত্বের ফতোয়া জারি করেছে তারা। এসব ভারি নামের মোড়লরা কেবলই যোজনা ও প্রকল্প বানায়, সুরক্ষার কাল্পনিক কাঠামো নির্মাণ করে। তাদের বাস্তব উপস্থিতি নেই। অন্যদিকে যেসব দূরত্ব সদ্যোজাতের টুঁটি চেপে ধরে, তার খাবার কেড়ে নেয়, দামি বুটে মসমসিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় ভবিষ্যৎ! তাদের কথা ভেবেছে এরা?
যেসব স্বপ্ন মেঠো পথ পেরিয়ে, মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, মনুমেন্টের অপর দিকে? মোড়লরা কেবলই হাহাকারের অভিনয় করে। অন্যদিকে রক্তস্রোতে বয়ে যায় মানুষ।
পেটের খিদের দামের বিজ্ঞাপন চলছে প্রতিনিয়ত। কে কত বড় দাতা তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আর জীবন? তার দাম দেবে কী দিয়ে? মোড়লদের কাছে, এসব মানুষ সস্তা। দাম নেই। বিশ্ব বাজারে বেচে লাভ নেই।
নাসরিনের, আব্বুর বলা কথাটা খুব মনে পড়ে-
"স্বপ্ন কারও বাপের সম্পত্তি নয়।’ ভুল বলত আব্বু। এই বিকিকিনির সংসারে স্বপ্নও গোলাম। সেও নিলামে ওঠে।
টিভির পর্দায় উঠে আসছে হরেক রকম খবর। মানুষের মরার গল্প, তাদের হার মানার দাস্তান- কেউ কয়েকশো কিলোমিটার হেঁটে ঘরে ফিরছে, কেউবা সাইকেল চালিয়ে; কেউ উপায় না পেয়ে ঝাঁপ মারছে ছাদ থেকে। ঘরের খোঁজে রওনা হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে- উদ্দেশ্যহীনতায় বুড়িয়ে যাওয়া, ঐতিহাসিক শতকে।
আর আব্বু? আব্বু কী করছে? সে তো হেরে যাওয়ার পর বারবার ফিরে আসার মন্ত্রণা দিত। তবে, সেও কি ফিরবে? বিষাদে শুকিয়ে যায় নাসরিনের ঠোঁট। জানালা দিয়ে এলোমেলো চুলের উপর অবান্তর বৃষ্টির ফোঁটা এসে লাগে। তার পাশে, টবে লাগান অর্ধমৃত গাছগুলোকে সে এগিয়ে দেয় গ্রিলের ধারে। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যায় শুকনো মাটি। আকাশ নীল ছেড়ে, হলুদ রং ধরে। বোকাবাক্সের সামনে বেবাকুফ পড়ে থাকে আম্মু; আর একটা সাঁই সাঁই শব্দ কানে তালা লাগিয়ে দেয় নাসরিনের- নিশ্চুপ, পরাস্ত বাড়ির উপর দিয়ে ডানায় আলো লাগিয়ে উড়ে যায়… নির্লজ্জ,গগনচুম্বী একটা এরোপ্লেন।
পরাজয়ের স্মৃতি সহ্য করা কঠিন
আমি অপেক্ষারত। কার? নিজেকে করা প্রশ্নের উত্তরের...
কিছু মাস আগেও ঐ জানালা ছিল নাসরিনের স্টেজ। বাপ বেটির ছুটির দিনে অবসর বিনোদন হত