×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • পদ্মকে হিন্দু প্রতীক বলতে শেখাল সাহেব শাসকরাই

    সোহেইল হাশমি | 16-06-2022

    স্থাপত্যের ধর্ম

    সারা বিশ্বেই মধ্যযুগীয় রাজারা তাঁদের ঈশ্বরের নামে এবং ‘ঐশ্বরিক আদেশে লব্ধ' অধিকারবলে শাসন করতেন। তাই, যখন তাঁরা অন্য মধ্যযুগীয় রাজার বিরুদ্ধে কোনও যুদ্ধে জয়ী হতেন, তখন তাঁরা পরাজিত রাজাদের উপাসনালয়গুলিকে নিজেদের আঘাত করে সেগুলোকে ধ্বংস করতেন। কারণ তাঁদের ঈশ্বর পরাজিত পক্ষের ঈশ্বরের থেকে বেশি শক্তিশালী এটা প্রতিষ্ঠা করে তাঁরা আধিপত্য কায়েম করতে চাইতেন।

    রোমান ক্যাথলিকরা ইহুদি, মুসলমান এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের ছাড়াও গ্রিক এবং রাশিয়ান অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের টার্গেট বানিয়েছিল। আবার ক্ষমতার চাকা উল্টে গেলে একদা বিজিত পক্ষ যখন চালকের আসনে তারা সমান সমান প্রতিশোধ নিয়েছিল। শৈব, শক্তির উপাসক এবং বৈষ্ণবরা একে অপরের প্রতি একই জিনিস করেছিল। সুযোগ পেলে বৌদ্ধরাও তা করতে ছাড়েনি।

    ভারতে সাধারণভাবে চর্চায় আমরা যেন শুধুমাত্র হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের পীড়নের কথাই বলে থাকি। ব্রাহ্মণ্যবাদের মধ্যে অভ্যন্তরিন সংঘাতের কথা আমরা বলি না। কীভাবে বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে কার্যত নির্মূল হয়েছিল সেই বিষয়েও কথা বলি না আমরা। এমনকি মুসলিম রাজারাও অন্যান্য মুসলিম রাজার সঙ্গে কী করেছিল তা বলি না।

    বেশিরভাগ সময় যুদ্ধগুলি প্রতিবেশীদের মধ্যে হত। তবে কখনও কখনও আবার বিবাদমান দুই পক্ষ একেবারে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিশ্বদর্শনের অধিকারী এমনও হত। এই দুই ধরনের যুদ্ধ হল একদিকে যেখানে যুদ্ধরত দুই পক্ষের সংস্কৃতি একই রকমের এবং অন্যদিকে সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। এই দুই ধরনের যুদ্ধের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক প্রভাব কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। 

    এই প্রতিবেদনে আমরা দুটি সাংস্কৃতিক এবং সামাজিকভাবে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলি দেখার চেষ্টা করব। এবং আমরা মূলত দেখব যে কীভাবে এই সংঘাত স্থাপত্যে তাদের ছাপ ফেলেছে। কেবল খিলান এবং গম্বুজই দেখব না আমরা, সেই খুঁটিনাটির দিকেও নজর দেব যা সাধারণত এড়িয়ে যাওয়া হয়।

    বর্তমান হরিয়ানার কারনালে অবস্থিত তরাইনে ঘুরি ও চৌহান বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের বিশদ বিবরণ লক্ষণীয়। পৃথ্বীরাজের রাজধানী আজমীর, এবং মোহাম্মদ ঘুরির এবং তাঁর উত্তরাধিকারী এবং প্রাক্তন কৃতদাস কুতুব-উদ-দিন আইবকের রাজধানী হল লাহোর। তবুও আইবক সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর বিজয় টাওয়ার তথা ভারতের প্রথম স্মৃতিসৌধ মসজিদ ‘কুতুব মিনার’ আজমীরে বা লাহোরে না বানিয়ে, দিল্লিতে বানাবেন। আশ্চর্যজনকভাবে, দিল্লি কিন্তু সেই সময়ে কোনও গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল না। পরবর্তী কালে শামস-উদ-দিন আলতামাশ বা ইলতুৎমিশের রাজত্বকালে দিল্লি রাজধানী হয়ে ওঠে।

    সে যাই হোক, আইবক মেহরাউলিতে একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণ করেন এবং এর নাম দেন জামি মসজিদ। সেই মসজিদ নির্মাণে 27টি জৈন ও হিন্দু মন্দিরের উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদটিকে প্রথম "কুওয়াত-উল-ইসলাম” (ইসলামের পরাক্রম) মসজিদ হিসাবে নামাঙ্কিত করা হয়েছিল অনেক পরে 19 শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে। এখানে দেখতে পাচ্ছেন যে কীভাবে বিভিন্ন ধর্মের উপাদান দিয়ে তৈরি হওয়া জমায়েত হওয়ার স্থান জামি মসজিদকে ইসলামের পরাক্রমের মসজিদে পরিণত করার পরই ধর্মীয় বিভাজনের আখ্যানটির জন্ম।

    আইবক কেন মন্দিরগুলির সামগ্রী ব্যবহার করেছিলেন? পরাজিতদের উপাসনালয়গুলি জয়ী পক্ষ  হয় ধ্বংস করে দিত অথবা যুদ্ধের বিজয় স্মারক হিসেবে লুঠ করে এনে তা পুনরায় ব্যবহার করত। মজার বিষয় হল যে কুতুব মিনার থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বের মধ্যেই যোগমায়া মন্দির ছিল, যা কিন্তু স্পর্শ করা হয়নি। এর থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে অন্য ধর্মের উপাসনালয়গুলো ধ্বংস করার উদ্দেশ্য ছিল একটি নতুন অর্জিত অঞ্চলের উপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। এটি একটি প্রতীকী ব্যাপার, একবার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে আর এই উপাসনালয়গুলির গায়ে হাত দেওয়া হত না।

    যখন দুটি সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন জনগোষ্ঠী একসঙ্গে থাকতে শুরু করে তখন স্থাপত্যে তার কী প্রভাব পড়ে তা বোঝার জন্য আমরা দিল্লিতে নির্মিত প্রাচীনতম কাঠামোগুলি কিছু নিবিড়ভাবে দেখব। আমরা জামা মসজিদ দিয়ে শুরু করি, আইবক যেটার নির্মাণ শুরু করেন এবং তার প্রাক্তন ক্রীতদাস এবং পরবর্তীতে তার জামাই শামস-উদ-দীন আলতামাশ শেষ করেন। এর অনেক খুঁটিনাটি রয়েছে যা নিয়ে অন্যত্র আলোচনা করা যায়। আমরা এই লেখায় মসজিদের নবনির্মিত পশ্চিমমুখী খিলানগুলি সম্পর্কে শুধু কিছু কথা বলব।

    খিলান নির্মাণ শুরু করার আগে, নকশাটি কাগজ বা পার্চমেন্টে আঁকা হত। খিলানগুলিকে অলঙ্কৃত করার জন্য কুরআনের নির্দিষ্ট কোন আয়াতগুলো খোদাই করা হবে তা একজন সম্মানিত পণ্ডিত বেছে দিতেন এবং একজন ক্যালিগ্রাফার তারপর সাবধানে সেই শব্দগুলি কাগজ বা পার্চমেন্টের টুকরোতে আঁকতেন। খিলানগুলির ভিতরের অংশটি পাথরকুচি দিয়ে তৈরি করা হত। ভিতরটি শুকাতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে তার উপর লাগানো হত বিশাল পাথরের টালিগুলো। এই টালিগুলো খিলানের আকারে মাটির উপর পাতা হত এবং ক্যালিগ্রাফার রঙ দিয়ে কুরআনের আয়াতগুলো তাতে যত্ন করে লিখে দিতেন। রাজমিস্ত্রিদের কাজ ছিল ওই রঙের অংশটা রেখে বাকি অংশগুলো ছেনি দিয়ে কেটে ফেলা, যাতে শেষ পর্যন্ত লেখাগুলো উঁচু রিলিফ আকারে জেগে থাকে।

    শব্দগুলি লেখার সময়ে ক্যালিগ্রাফার দেখতেন যে বিশাল টালির উপর শব্দগুলির চারপাশে অনেক চোখে পড়ার মতো খালি জায়গা রয়ে গিয়েছে, যেটা একই লেখা ছোট পার্চমেন্ট বা কাগজের টুকরোতে যা বোঝা যাচ্ছিল না। (চিত্র 1)

    Indian architecture of medieval India

    তারপর যা ঘটত তা হল এমন কিছু যা আমরা বেশিরভাগ সময়ই খেয়াল করি না। ক্যালিগ্রাফার (যিনি সম্ভবত একজন তুর্কি বা আফগান বা তাজিক বা উজবেক বা ইরানি ছিলেন) ভারতীয় রাজমিস্ত্রিকে বলতেন (সম্ভবত একজন দোভাষীর মাধ্যমে) যে সেই খালি জায়গাগুলোকে, শব্দ এবং অক্ষরের মধ্যে স্থানগুলিকে ভরিয়ে তুলতে।

    রাজমিস্ত্রি পাথরের উপর লেখা ভাষা জানেন না, তিনি শুধু জানেন যে এটি এই নতুন আগতদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অংশ এবং এঁরাই তাঁকে এই বিশাল প্রকল্পে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করেছে। তাই তিনি মনে করেন যা কিছু বিশুদ্ধতার প্রতীক এবং আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে যুক্ত একমাত্র তাই এখানে ব্যবহার করা যেতে পারে। রাজমিস্ত্রি সেই প্রতীকগুলিই ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন যা তাঁর কাছে প্রিয়, শ্রদ্ধেয় ও পবিত্র। আজ আমরা যা দেখছি চোখের সামনে , তা এই ভাবনারই ফল।

    দুর্ভাগ্যবশত, বেশিরভাগ সময়, আমরা মসজিদের সব থেকে আকর্ষণীয় এই বিবরণগুলি লক্ষ করি না। পরের বার যখন আপনি কুতুব মিনার বা জামা মসজিদে যাবেন, খিলানের কাছে যাবেন, শব্দগুলি দেখবেন, যা আপনি হয়তো আরবী না পড়তে পারার কারণে পড়তে পারবেন না, তবে আপনি দেখতে পাবেন শত শত পদ্ম, লতার আকর্ষ, কুঁড়ি, ফুল। লেখার মার্জিনে এবং আশেপাশে সমস্ত ফাঁকা জায়গা ভরাট করার জন্য অনেক যত্ন এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে এগুলো আঁকা হয়েছে।  একজন ধর্মবিশ্বাসীর উপাস্য পাঠ্যকে অলঙ্কৃত করার জন্য অন্য একজন ধর্মবিশ্বাসী তাঁর নিজের পূজার প্রতীক ব্যবহার করেছেন (চিত্র 2)

    Hindu symbols lotus and kalash

    প্রতিটি খিলানের গোড়ায় দেখুন একটি করে কলস (চিত্র 3) আছে। তার ভিত্তিটি পদ্মের পাপড়ি দিয়ে অলঙ্কৃত, গলায় সারিবদ্ধ সম্ভবত আমের পাতা, এবং একটি লতা কলস থেকে উঠে একদম উপরে উঠে খিলানের অপর পাশের কলসে নামছে। নাকি এই কলস থেকে উঠে অন্য কলসে নামছে? জীবন শক্তির অফুরন্ত প্রবাহের মতো, যে প্রবাহ চিরকালের জন্য।

    কলসের পাশে বিসমিল্লাহ শব্দটি রয়েছে - আল্লাহর নাম দিয়ে শুরু করুন (ছবি 4), অন্য দিকে একটি বিশাল ঢেউয়ের মতো দেখায় (চিত্র 5), গুজরাটের দিলওয়ারা মন্দিরে মার্বেলে খোদাই করা নিদর্শনের মতো।

    যখন দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির জনগোষ্ঠী মিলিত হয়, তখন তারা সর্বদাই লড়াই করে না এবং পরস্পরকে হত্যা করে না। এনকাউন্টারের শুরুতে তারা তা করতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে তারা একসঙ্গে কাজ করে, সৃষ্টি করে। এবং যখন তারা একসঙ্গে কিছু সৃষ্টি করে তখন ম্যাজিক ঘটে।

    স্থপতি অবশ্যই রাজমিস্ত্রিকে জিজ্ঞাসা করতেন, এই রূপগুলি কীসের প্রতীক? এবং রাজমিস্ত্রি উত্তর দিতেন, বিশুদ্ধতা, সুস্থতা, প্রাচুর্য এবং সুস্থিতির প্রতীক। কলস, পদ্ম, জলের ঢেউ এই সবেরই প্রতীক।

    কেউ এগুলো নিয়ে কখনও আপত্তি করেনি, করার কথাও নয়। এমনকি 27 টি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে নির্মিত প্রথম মসজিদেও নয়।

    এই অলঙ্করণগুলির মধ্যে আগে কেউ দোষ খুঁজে পায়নি। দোষ পাওয়া গেল যখন আমাদের ঔপনিবেশিক শাসকরা ইসলামিক এবং হিন্দু স্থাপত্য বলে একটা কৃত্রিম অনৈতিহাসিক বিভাজন তৈরি করল আর আমাদের বলল কলস আর পদ্ম হল হিন্দু প্রতীক। ব্রিটিশদের আগমনের আগে, পদ্ম এবং কলস ছিল ভারতীয় প্রতীক যাকে উপমহাদেশে বসবাসকারী প্রত্যেকেই নিজের বলে মনে করত আর ব্যবহারও করত।

    এই নিবন্ধের পরবর্তী অংশগুলিতে আমরা কলস, আম পাতা, ছয় কোণযুক্ত তারা, স্বস্তিক, গম্বুজের চূড়া ইত্যাদি বিষয়ে আরও কথা বলব।

    আরও পড়ুন : স্থাপত্যের ধর্ম

    #IslamicArchitecture #QutubMinar #LotusSymbol


    সোহেইল হাশমি - এর অন্যান্য লেখা


    হিন্দু বা ইসলামি বলে স্থাপত্যকে চিহ্নিত করা ঔপনিবেশিক মানসিকার পরিচয়, আজও স্বাধীন প্রশ্ন নেই আমাদের।

    পাঁকের মধ্যে জন্মানো পদ্ম অসুন্দরের মধ্যে সুন্দরের প্রতীক বলেই প্রাচীন যুগ থেকে তার আরাধনা

    প্রাচুর্য ও উর্বরতার প্রতীক হিসেবেই কলসের স্থান ভারতীয় স্থাপত্যে

    ঔপনিবেশিকরা যাকে ইসলামিক স্থাপত্য বলতে শিখিয়েছে সেই ভারতীয় স্থাপত্য আসলে দুটি সভ্যতার মিলনের সৃষ্টি

    পদ্মকে হিন্দু প্রতীক বলতে শেখাল সাহেব শাসকরাই-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested