দিল্লিতে নির্মিত প্রথম মসজিদের খিলানে খোদাই করা কুরআনের আরবি আয়াতগুলিকে অলঙ্কৃত করার জন্য ভারতীয় রাজমিস্ত্রিরা কীভাবে পদ্ম ফুল, কুঁড়ি এবং লতা ব্যবহার করেছিল সে সম্পর্কে আমরা আগেই বলেছি। (এখানে আগের স্টোরিটার লিঙ্ক যাবে)। এবার আমরা বিশদ অনুসন্ধান করে দেখব যে পদ্ম ফুলটি কীভাবে এক বিশেষ সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত হল।
আমরা যা বলতে যাচ্ছি তার ঐতিহাসিক প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। এটি একটি যুক্তিসঙ্গত অনুমান নির্ভর তত্ত্ব বা থিওরি। আমাদের কাছে এটা অর্থবহ, আশা করি এটি আপনার কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে। সমস্ত ধরণের বিশুদ্ধ কল্পনামূলক এবং সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাস্য ইতিহাস আজকাল বাজারে চালু রয়েছে! এই সব হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া গল্পকাহিনীর চেয়ে আমাদের থিওরি সম্ভবত অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত।
যেমন সকলেই নিজ নিজ আখ্যানকে বিশ্বাস করে, তেমনই আমরাও করি। আর এই হল আমাদের আখ্যান:
এই কাহিনির শুরু অনেক আগে, অনেক আগে, যে অতীত রহস্যময় কুয়াশাবৃত। সেই সময়ে শহর ও গ্রাম তৈরি হয়নি, মানুষ চাষ আবাদ শেখেনি, গৃহপালিত পশু বলেও কিছু ছিল না। সেই সময়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা এবং সারা বিশ্বের সমস্ত প্রাচীন মানুষ বিশ্বাস করত যে সব কিছুই জীবন্ত। তারা বিশ্বাস করত মানুষ, পশু, পাখি, মাছ এবং পোকামাকড়ের মতো প্রকৃতির অন্যান্য জিনিসেরও প্রাণ আছে। তারা বিশ্বাস করত যে শুধু নদী, পাহাড়, বন নয়, ছোট ছোট স্রোত, পাথর, গাছ, হ্রদ, পুকুর, পুকুর, নুড়ি, গাছপালা, গুল্ম, ফুল ইত্যাদি তারা যা কিছু চোখের সামনে দেখত তারই প্রাণ আছে। এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সারা বিশ্বকে চালনা করেন, এই ধারণার তখনও জন্ম হয়নি।
এই বিশ্বাসকে বলা হয় অ্যানিমিস্ট বা সর্বপ্রাণবাদী বিশ্বাস। আজও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রায় সমস্ত উপজাতি তাদের বিশ্বাসে এবং অনেক অনুশীলনে অ্যানিমিস্ট, যার মধ্যে রয়েছে আমাদের ভারতের নিজস্ব আদিবাসী সম্প্রদায়ের একটি বিশাল অংশ। তাদের মধ্যে অনেকেই ক্রমশ তথাকথিত 'শিক্ষিত' এবং 'সভ্য' হচ্ছেন এবং আমাদের মতো একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্বকে দেখতে শুরু করছেন।
যাই হোক, আমাদের আখ্যান যেখানে শুরু হয়েছিল সেখানে ফিরে যাওয়া যাক। অ্যানিমিস্ট বিশ্বাসের সেই সময়ে এমন কেউ ছিলেন যিনি প্রথমে স্থির জলের পুকুরে একটি সুন্দর পদ্ম বেড়ে উঠতে দেখেছিলেন। ছোট্ট পুকুরটিতে নানা ধরনের জলজ উদ্ভিদ ছিল, ছিল জলে ভেসে যাওয়া পাতার, ডালপালা, এবং ব্যাঙ, কেঁচো, শামুক ইত্যাদি। ছিল পচা গাছপালার অপ্রীতিকর গন্ধ, কাদা। আর এরই মাছে ফুটে ছিল একটি সুন্দর পদ্ম ফুল। একই পরিবেশে সুন্দর এবং অসুন্দরের কী বিচিত্র সহাবস্থান!
যিনি প্রথম এই ঘটনাটি লক্ষ করেছিলেন তিনি সম্ভবত একজন মহিলা ছিলেন। কারণ মহিলারাই সর্বদা এই ছোট জিনিসগুলি লক্ষ করেন। মহিলারা এই জিনিসগুলি নোট করেন এবং তাঁদের সন্তানদের বলেন। শিশুদের কাছে বিস্ময়কর এই ছোট ছোট গল্পগুলি পরবর্তী কালে লোককাহিনী, রীতিনীতি এবং সামাজিক অনুশীলনে পরিণত হয়। পুরুষ অনেক পরে এগুলি তাদের নিজেদের আবিষ্কার বলে দাবি করে।
যে মহিলাটি প্রথম পাঁকের মধ্যে জন্মানো পদ্ম এবং সুন্দর ও অসুন্দরের সহাবস্থান লক্ষ করেছিলেন, তিনি বোধহয় মনে মনে বলেছিলেন চাইলে আমিও ক্লেদাক্ত ও কুৎসিত থেকে উঠে পবিত্র ও সুন্দর হতে পারি। এইরকম একটি অতি সাধারণ পর্যবেক্ষণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ক্রমশ মানুষের মনে দৃঢ় জায়গা রে নেয়। এবং ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে ক্রমশ পদ্মটি পবিত্রতার প্রতীক হয়ে ওঠে। অবশেষে পদ্মের পূজা করা শুরু হয়।
এর পর হয়তো হাজার হাজার বছর কেটে গেছে, মানব সমাজ আরও জটিল হয়ে উঠেছে, আমরা পশুপালন করতে শিখেছি, কৃষি কাজ শুরু হয়েছে, মৃৎপাত্র উদ্ভাবিত হয়েছে। তারপর শ্রমের বিভাজন শুরু হয়েছে, আমাদের জীবন ও মৃত্যুর ধারণা বিকশিত হয়েছে, মানুষের কল্পনায় ঈশ্বর এসেছে। সেই ঈশ্বর আমাদের সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন। তিনি বৃষ্টি আনতে, প্রচুর ফসল দিতে, আমাদের গবাদি পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে, রোগ থেকে আমাদের রক্ষা করতে, আমাদের পরিবারকে বড় ও সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করতে পারেন।
মানুষ যে দেবতাদের কথা ভেবেছিল তারা এমন দেবতা যারা মানুষ যা করতে চায় কিন্তু করতে পারে না,তার সব কিছু করতে পারেন। তাই তো দেবতারা উড়তে পারেন, একই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় থাকতে পারেন, পাখি এবং প্রাণীদের ভাষা বুঝতে পারেন, পাহাড়কে সরিয়ে দিতে পারেন, তারা মৃতকে জীবিত করতে পারেন, দুরারোগ্য রোগ নিরাময় করতে পারেন, ইত্যাদি ইত্যাদি সব পারেন। আমরা যে ঈশ্বরের কল্পনা করেছি তা মানুষের আকাঙ্ক্ষার মূর্ত রূপ। এই ধরনের দেবতা সমস্ত প্রাচীন সমাজে বিদ্যমান এবং নৃতাত্ত্বিকরা তাদের মনুষ্যতুল্য ভগবান (anthropomorphic gods) হিসাবে বর্ণনা করেন।
এই দেবতাদের অনেকেরই একাধিক হাত ছিল, কারণ আমরা চেয়েছিলাম যে তারা একই সাথে অনেক কিছু করুক। অনেকেরই পশুপাখি মতো মাথা ছিল, যেমন মিশরীয়দের বাজপাখির মতো মাথাওয়ালা হোরাস দেবতা, যিনি স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতাল শাসন করতেন। আমাদের ভগবান গণেশ, যিনি যেন হাতির প্রজ্ঞার মূর্ত প্রতীক, যিনি সিদ্ধিদাতা এবং অন্য সমস্ত দেবতার আগে পূজা পান। সারা বিশ্বে এমন অগণ্য দেব-দেবী ছিলেন যাদের সঙ্গে প্রাণীদের সাযুজ্য আছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সমস্ত দেবতারই চারটি বৈশিষ্ট্য ছিল যা মানুষের মতো। তাঁদের সবারই দুটি করে পা এবং তাঁরা তাঁদের পিছনের পায়ে খাড়া হয়ে হাঁটতেন, তাঁদের প্রায় সকলেরই পরিবার ছিল, তাঁদের সবাইকে নিয়মিত সময়ে খাওয়াতে হত এবং তাঁরা যাতে রেগে না যান তার জন্য তাঁদের তুষ্ট করে রাখতে হত।
এবার আমরা দেখি এ সবের সঙ্গে পদ্মের সম্পর্ক কী?
এটা নিশ্চয়ই কারও মাথায় এসেছিল যে, আমাদের মতোই ওই দেবতাদেরও মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেওয়া দরকার। তাঁদের সর্বদাই দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখানোটা অসম্মানজনক। তাঁরা তাঁদের ভক্তদের মতো খালি মেঝেতে বসতে পারেন না। কারণ তাঁরা দেবতা এবং নিছক নশ্বরদের চেয়ে অনেক উচ্চতর এবং পবিত্র। তাঁরা কেবলমাত্র এমন কিছুর উপর উপবিষ্ট হতে পারেন যা অন্তর্নিহিতভাবে বিশুদ্ধ। তাই দীর্ঘকাল ধরে (অ্যানিমিস্ট সময় থেকেই) বিশুদ্ধতার প্রতীক পদ্মকে স্বাভাবিকভাবেই এর জন্য বেছে নেওয়া হল। লক্ষণীয় যে আমরা পদ্ম আকৃতির সিংহাসনে সমস্ত দেবতাকে স্থাপন করেছি। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক সকলেই পদ্মাসনে বসে আছেন। পরবর্তী কালে যে মানুষদের আমরা দেবতার মর্যাদায় উন্নীত করেছি - মহাবীর জৈন এবং বুদ্ধদেব – তাঁদেরও বসার ভঙ্গি পদ্মাসনের, এবং আমরা তাঁদেরও পদ্ম সিংহাসনে বসিয়েছি।
ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে দূর দূরান্তে, যে ভূখণ্ডগুলি এখন নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, ভিয়েতনাম কম্বোডিয়া, কোরিয়া, লাওস, চীন, মঙ্গোলিয়া, তাইওয়ান, তিব্বত, হংকং এবং জাপান বলে পরিচিত। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সর্বত্রই পদ্মের সিংহাসনে বসে থাকা বুদ্ধের মূর্তি এবং বোধিসত্ত্ব পদ্মপাণির মূর্তি (যাতে সর্বদা তার ডান হাতে একটি পদ্ম ধরা) তাঁদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এভাবেই পদ্মের আরাধনা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়ে এবং তার বাইরে মধ্য এশিয়া, চিন, জাপান এবং মঙ্গোলিয়া প্রভৃতি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
বৌদ্ধধর্মের আর একটি শাখা লাদাখ হয়ে সিকিম, ভুটান এবং তিব্বত হয়ে চিনে গিয়েছিল। এই যাত্রায়, বুদ্ধের নারী প্রতিরূপ তারা তিনি একটি পদ্মের উপর উপবিষ্ট। পদ্মপাণি ক্রমশ পদ্মের উপর উপবিষ্ট অবলোকিতেশ্বর হিসাবে পূজিত হতে শুরু করেন। যিনি বৌদ্ধধর্মকে সিকিমে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়, সেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী পদ্মসম্ভব পদ্মের উপর উপবিষ্ট ছিলেন। মৈত্রেয় বুদ্ধও তাই ছিলেন। এইভাবে পদ্মের পূজা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রাচীন চিনা, ইরানি এবং মিশরীয় সভ্যতায়ও পদ্মকে পূজা করার প্রচলন ছিল। এই বৃহৎ সংলগ্ন এলাকার অনেক সভ্যতার মধ্যে অ্যানিমিস্ট বিশ্বাসের সুবাদে পদ্মের আরাধনার সম্পর্ক থাকতে পারে।
আফগান এবং তুর্কিরা খাইবার গিরিপথের মধ্য দিয়ে পর্বত পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় এসেছিলেন এবং ভারতীয় রাজমিস্ত্রিদের দিল্লিতে নির্মিত প্রথম মসজিদে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন প্রথম 1193 সালে। তখন থেকেই তাঁরা পদ্ম ও কলস এবং তার তাৎপর্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। আমরা বিশ্বাস করি এভাবেই পাথরের বিশাল খণ্ডে কুরআনের আয়াতগুলির খোদাই করার পর চারপাশের শূন্য স্থানগুলি পূরণ করতে রাজমিস্ত্রিরা পদ্ম ব্যবহার করেছিলেন।
স্থপতি রাজমিস্ত্রিকে জিজ্ঞাসা করতেন যে ফুলটি কী বোঝায়? রাজমিস্ত্রি বলতেন, এটি বিশুদ্ধতা, সুস্থতা এবং পবিত্রতার প্রতীক। স্থপতিরা বলতেন, ভাল, চালিয়ে যান। বিশুদ্ধতা, সুস্থতা এবং পবিত্রতার প্রতীকে কেউই নিশ্চয়ই আপত্তি করতেন না। এভাবেই পদ্ম কুরআনের আয়াতগুলিকে অসঙ্কৃত করে।
পদ্ম এবং কলস ভারতে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত প্রতীক এবং দিল্লির প্রথম মসজিদ থেকেই তারা দুই সভ্যতার মিলনের স্থাপত্যের অংশ হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটি দ্বাদশ শতকের শেষ থেকে আরও জারদার হয়ে ওঠে এবং কখনও কেউ বলেনি এটা বহিরাগত কিছু।
খিলান, পদ্ম, কলস এবং কুরআনের আয়াত ছয় শতাব্দী ধরে দিব্যি সহাবস্থান করার পর ব্রিটিশরা এসে আমাদের বলল যে, খিলান হল মুসলমান এবং কলস ও পদ্ম হল হিন্দু! এর আগে পর্যন্ত কলস এবং পদ্ম ছিল ভারতীয় এবং আর্চ ছিল একটি সুমেরীয় আবিষ্কার যা রোমান এবং তুর্কিদের মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছিল। এইভাবে স্থাপত্যকে হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যে এবং আমাদের ইতিহাসকে হিন্দু ও মুসলিম যুগে বিভাজনই হল আমাদের মনের উপর উপনিবেশ স্থাপনের ভিত্তি। এর ফলেই আমাদের আদান-প্রদান ভিত্তিক সহাবস্থানের পরম্পরাটা ধ্বংস হয়ে গিল। আমরা বিভাজিত হয়ে গেলান, ওরা শাসকের আসনে বসল।
#LotusSymbol #Quran_and_lotus #IslamicArchitecture #IndianArchitecture
পাঁকের মধ্যে জন্মানো পদ্ম অসুন্দরের মধ্যে সুন্দরের প্রতীক বলেই প্রাচীন যুগ থেকে তার আরাধনা
প্রাচুর্য ও উর্বরতার প্রতীক হিসেবেই কলসের স্থান ভারতীয় স্থাপত্যে
ঔপনিবেশিকরা যাকে ইসলামিক স্থাপত্য বলতে শিখিয়েছে সেই ভারতীয় স্থাপত্য আসলে দুটি সভ্যতার মিলনের সৃষ্টি
হিন্দু বা ইসলামি বলে স্থাপত্যকে চিহ্নিত করা ঔপনিবেশিক মানসিকার পরিচয়, আজও স্বাধীন প্রশ্ন নেই আমাদের।