×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • বিকৃতি এভম প্রকৃতি

    সুদীপ্ত চ্যাটার্জী | 15-11-2021

    ‘সমকামিতা’ শব্দটি আশেপাশে কোথাও শুনলেই কি আপনার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে? মনে হয়,এসব অস্বাভাবিক বা প্রকৃতিবিরুদ্ধ? না এতে অবশ্য ভারতীয় তথা মধ্যবিত্ত বাঙালির দোষ দেওয়া যায় না। 1861 সালে ঔপনিবেশিক ভারতের ‘মন্থর গুপ্ত’রা খ্রিষ্টীয় প্রাচীনপন্থার অন্ধ উপাসনা হেতু যে অচলায়তন সৃষ্টি করেছিল 377 নং ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে এবং তা ভারতীয় সমাজব্যবস্থার অন্ত:স্থলে এমনভাবে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল যে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির পর ভারতীয় বিচারব্যবস্থার 71 বছর লেগে যায় সেই প্রাচীনপন্থী গোঁড়ামির জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষগুলিকে মুক্তি দিতে।

     

     

    তবে, 2018 সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের দ্বারা এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির সহনাগরিকদের সমকামের আইনসঙ্গত অধিকারকে মান্যতা দিয়ে, আইনি জটিলতা থেকে মুক্ত করা গেলেও, সমাজের তীর্যক দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মীয় চোখরাঙানি থেকে কি তাঁরা সুরক্ষিত রয়েছেন? মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ দীর্ঘদিন যাবৎ যত্ন সহকারে লালিত-পালিত রক্ষণশীল ধ্যানধারণা ভেঙে হঠাৎই বছর তিনেক আগের শীর্ষ আদালতের এক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা মুক্তমনা হয়ে উঠতে পেরেছে? আর এই প্রশ্নের উত্তরের উপরই নির্ভর করছে আগামী প্রজন্ম বিষয়টিকে কীভাবে দেখতে শিখবে! তাই পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে যাতে এই বিষ সঞ্চারিত না হয় সেজন্য অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে  ইউনিসেফ স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান প্রয়াসম' আগামী 3 ডিসেম্বর কলকাতার কলাঞ্জলী আর্ট স্পেসে আয়োজন করতে চলেছে অষ্টম ‘ব্যাড এন্ড বিউটিফুল ফিল্ম ফেস্টভ্যাল’ এবং এই চলচ্চিত্র উৎসবে মুক্তি পাবে আটটি শর্টফিল্ম সম্বলিত একটি সিরিজ, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘রেশ’, যা ভিন্ন ভিন্ন সমপ্রেমের গল্প বলবে। উদ্যোক্তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী,শহরের স্কুলগুলি খোলার পরে 60টি স্কুলে ওই শর্টফিল্ম গুলি দেখানো হবে ‘সমকামিতা’ বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে। পরিচালক সেলিম শেখ নির্দেশিত ‘দেখা’ এক বাবা ও তাঁর সমকামি ছেলের গল্প বলবে অন্যদিকে ‘দক্ষিণা’ এক সমকামী পুরুষ যৌনকর্মীর জীবনের গল্প তুলে ধরবে। আবার, ‘দূরবীন’ দর্শাবে এক সাংবাদিকের গল্প, যে নিজের বাবার মৃত্যুর পর জানতে পারে তাঁর বাবার সমকামী সম্পর্কের বিষয়ে। 

     

     

    এ প্রসঙ্গে পরিচালক সপ্তর্ষি রায়ের বক্তব্য, তাঁর স্ক্রিপ্ট শুনেই নাকি বহু অভিনেতা না করে দিয়েছিলেন। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এ বিষয়ে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে কোনও ট্যাবু না থাকে, সেই কারণেই এই ধরনের ফিল্ম আরও বেশি করে দেখানো প্রয়োজন। এখন দেখার বিষয়, এ শহরের মানুষ ঠিক কতটা পরিণত হয়েছেন! ইতিমধ্যেই সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে যে ‘এলজিবিটিকিউ প্রোপাগান্ডা’ ব্যবহার করে এই প্রতিষ্ঠানটি ছোটদের মগজধোলাই করতে চাইছে। যদিও ‘প্রয়াসম’- এর ডিরেক্টর প্রশান্ত রায়ের সাফ জবাব, তাঁরা বিষয়টিকে ‘জনপ্রিয়’ নয় বরং ‘স্বাভাবিক’ করে তুলতে চাইছেন আগামী প্রজন্মের মধ্যে। হয়তো বা দেখা যাবে বিদ্যালয়গুলি সম্মত হলেও অভিভাবকদের আপত্তিতে সংস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হল না। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবকের কথায়, ‘এইসমস্ত ছাইপাঁশ দেখাতে কি বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাচ্ছি? আর এসব দেখে যদি আমার ছেলেও গে হয়ে যায়..?’ এখান থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে যে সমকাম সম্পর্কে ভ্রান্তধারণার শিকড় ঠিক কতটা গভীরে বিস্তৃত। 

     

     

    ওই ব্যক্তির ধারণা, তাঁর ছেলে সমকাম নিয়ে সচেতনতামূলক শর্টফিল্ম দেখে ফেললেই সমকামী হয়ে উঠতে পারে! আদপে যদি একশো জন ছাত্রছাত্রীকে এই ফিল্মগুলি দেখানো যায় এবং এ বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে জড়তা মুক্ত হয়ে খোলামেলা আলোচনা করা যায়, তাহলে ওই একশো জনের মধ্যে যদি এক জনও সমকামী থেকে থাকে, যে হয়তো নিজেই নিজের সত্তা নিয়ে দ্বন্দ্বে ছিল, নানাবিধ হীনমন্যতায় ভুগত, সে নিজেকে চিনতে পারবে। নিজে যা তা সমাজের সামনে, তাঁর পরিবারের সামনে মেলে ধরার সাহস সঞ্চয় করবে। অন্যদিকে বাকি 99 জন যারা বিষমকামী তাঁরা ওই ফিল্মগুলি দেখে ও আলোচনায় অংশগ্রহন করে নিশ্চিতভাবে সমকামী হয়ে উঠবে না তবে এ বিষয়ে সঠিক তথ্য জেনে সমকামীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব বা ঘৃণামুক্ত হবে।

     

     

    সমাজকর্মী ও কৃষ্ণনগর উইমেন'স কলেজের অধ্যক্ষ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘যে কোন উদ্যোগই শুভ! তাই আমার শুভকামনা রইল, তবে আক্ষেপ এই উদ্যোগ মফস্বলের স্কুলগুলিতে নেওয়া হয় না। তবু রাজ্যে রাজধানী দিয়েই না হয় শুরু হোক। সিনেমা দেখার অবশ্যই একটা উপকারিতা রয়েছে, যা মনের ফ্যান্টাসিগুলিকে উদ্ধুদ্ধ করে।'

     

     

    সমাজের এক বড় অংশের এখনও ধারণা সমকামিতা নাকি প্রকৃতবিরুদ্ধ ক্রিয়াকলাপ। যদিও এ প্রসঙ্গে শীর্ষ আদালতের রায়ে বলা ছিল সমকামিতা কোনও ‘মানসিক ব্যাধি’ নয়; এমনকি সমকাম ‘প্রকৃতবিরুদ্ধ’ অপরাধও নয়। শীর্ষ আদালত আর বলে, টএলজিবিটি (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডার)-দের কাছে ইতিহাস ক্ষমাপ্রার্থী এবং ব্যক্তিগত পরিসরে সহমতের ভিত্তিতে সমলিঙ্গের মধ্যে যৌনসঙ্গম ক্ষতিকর বা সামাজিকভাবে সংক্রামক নয়। সেই যুক্তিতে শীতে ঠান্ডা, গ্রীষ্মে গরম এবং বর্ষার মরসুমে বৃষ্টি প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক আর আমদের শীত-কম্বল ব্যবহার, গ্রীষ্মে ফ্যান বা এসির ব্যবহার অথবা বর্ষায় ছাতা বা বর্ষাতি ব্যবহার প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ! দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক কী করবে, কার সঙ্গে থাকবে ইত্যাদি তাঁদের একান্তভাবেই ব্যক্তিগত বিষয় এবং সংবিধান প্রদত্ত ‘জীবনের অধিকার’। দীর্ঘ 71 বছর ধরে এই মৌলিক অধিকার ধারাবাহিক ভাবে খর্ব হয়ে এসেছে সামাজিক ও ধর্মীয় দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের নির্দেশে! 

     

     

    ভালবাসার কোনও লিঙ্গ হতে পারে না। কেউ যদি চিরায়ত যৌনাচারের বাইরে গিয়ে সমকামে তৃপ্ত হন, নিজেকে খুঁজে পান, তাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের মাথাব্যথার যৌক্তিকতা ঠিক কী? আইনি স্বীকৃতি পেলেও বছরের প্রথম দিকে কেন্দ্রীয় সরকার এক হলফনামায় জানায় যে, সমকামীরা একসঙ্গে থাকতে পারেন বটে, তবে তাঁদের বিয়ের বৈধতা দেওয়া যাবে না। কারণ তা ভারতীয় সংস্কৃতি বিরোধী এবং যেহেতু তাঁরা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম তাই তাঁদের বিবাহ পরিবারের ধারণাকে খর্ব করে। তাই যদি হয় তাহলে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ এক নারী-পুরুষ যখন প্রাকৃতিক কারণে সন্তান উৎপাদন করতে পারেন না, তখন কি তাঁদের বিবাহ অবৈধ হয়ে যায়? সন্তান উৎপাদনই কি দু'জন মানুষ লিঙ্গ নির্বিশেষে ‘এক সঙ্গে পথ চলা'–র অধিকার পাবে কিনা তার একমাত্র মাপকাঠি?

     

     

    আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাচীনপন্থার অন্ধ উপাসক যে মন্থর গুপ্তরা ‘সমকামিতা’কে অপরাধ বলে দাগিয়ে ছিলেন, তাঁরা কিন্তু নিজেদের ভুল 1967-তেই সংশোধন করে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের তা করতে আরও অর্ধশতক লেগে গিয়েছে! ওঁদের এ অন্তহীন লড়াই চলছে, আগামী দিনেও চলবে, যতদিন না সমাজ নিজের অচলায়তন ভেঙে মহাপঞ্চক সত্তা থেকে বেরিয়ে আসবে! আজকের সুভদ্ররা কিন্তু নিজেদের লড়াই লড়ে নিতে জানে!

     


    সুদীপ্ত চ্যাটার্জী - এর অন্যান্য লেখা


    আইনি স্বীকৃতি পেলেও সমকামিতা নিয়ে সমাজের নেতিবাচক ভাবনার বদল এখনও হয়নি।

    আড়াই দশক আগে তামিলনাড়ুর এক প্রত্যন্ত গ্রামের স্থানীয় ইরুলু জনজাতির এক দম্পতির উপর পুলিশি নির্মমতার

    বিকৃতি এভম প্রকৃতি-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested