×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • সিনেমা:জয় ভীম

    সুদীপ্ত চ্যাটার্জী | 19-11-2021

    জয় ভীমের পোস্টার

    হাড় জিরজিরে চেহারায় ওঁরা ইঁদুরের মাংসে সন্তুষ্ট কিন্তু বুক ভরা বেচেঁ থাকার স্বপ্ন। মাথার উপর স্থায়ী  ছাদ নেই, পেটে খাবার নেই। নেই কোনও আইনি সুরক্ষা। তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের ক্ষত চাপা পড়ে থাকে মেকি গণতন্ত্রের প্রলেপে। এই গণতন্ত্রের ‘গণ’ তাঁরা কোনও দিন ছিলেন না, আজও নেই! তাঁদের ‘অনুচ্ছেদ 21’ অবহেলার কবরে গুমরে কাঁদে।

     

    পরিচালক জ্ঞানভেলের হাত ধরে জয় ভিম’-এ উঠে এসেছে আদিবাসীদের জরাজীর্ণ দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের জ্বলন্ত চিত্র,যা সাজানো-গোছানো ‘ইন্ডিয়া’র গালে পিছিয়ে থাকা ‘ভারত’-এর  সজোরে থাপ্পড়!

     

    গত 2রা নভেম্বর অ্যামাজন প্রাইমে  মুক্তিপ্রাপ্ত তামিল ছবি ‘জয় ভিম’-এর প্রেক্ষাপট ১৯৯৫ সালে তামিলনাড়ুর এক পুলিশ লকআপ থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ইরুলু' সম্প্রদায়ের তিন যুবকের করুণ পরিণতি। ছবির প্রারম্ভিক দৃশ্যে দেখা যায় তামিলনাড়ুর কোনও এক কারাগারের বাইরে অপেক্ষারত কিছু মানুষ, অন্য দিকে জেল থেকে মুক্তি পাওয়া কিছু মানুষ লাইন দিয়ে বের হচ্ছেন। কিন্তু বের হওয়ার আগেই এক গার্ড তাঁদের জাতিগত পরিচয় জিজ্ঞেস করছেন, যাঁরা সমাজব্যবস্থায় তথাকথিত নিচু' তাঁদের একপাশে দাঁড়াতে বললেন আর নাইডু'-দের ছেড়ে দেওয়া হল। এর পর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় বিভিন্ন থানার পুলিশকর্মীদের সঙ্গে ওই এক পাশে দাঁড়ানো মানুষগুলিকে নিয়ে চলতে থাকে দর কষাকষি, টাকার বিনিময়ে ওই পুলিশ অফিসারদের অমীমাংসিত মামলার নতুন অপরাধী হিসেবে হস্তান্তরিত হন তাঁরা। জেল থেকে নিতে আসা স্ব্জনদের সামনে দিয়ে নতুন মামলায় ফাঁসানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের!

     

    এই দৃশ্য দর্শককে বুঝিয়ে দেয় জাতিগত বৈষম্যর অভিশাপে শোষিত ইরুলু' জনজাতির মানুষের প্রতি হওয়া অবিচারই এই ছবির মলাট চরিত্র। পরের দৃশ্য নিচুজাত বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা মানুষগুলির জীবনযাত্ৰার ছবি যখন পর্দায় উঠে এল তখন দেখা গেল তাঁরা কেবল সামাজিক ভাবে অবহেলিত নন, বরং তাঁদের নেই কোনও স্থায়ী ভূমি, স্থায়ী আবাস। সহায়সম্বলহীন ভাবে গ্রামের এক প্রান্তে তাঁদের মাথা গোঁজার আস্তানা। এমনকি দেখা যায়, সরকার প্রদত্ত কোনও পরিচয়পত্রই তাঁদের কপালে জোটেনি। অর্থাৎ তাঁরা স্বাধীন ভারতের ‘পরিচয়হীন’ নাগরিক।

     

    এই সম্প্রদায়ের এক বিশেষ দম্পতি এ বার প্রকাশ্য আসেন, রাজাকান্নু ও সেঙ্গিনি। মূলত তাঁদেরকে কেন্দ্র করেই গল্পের বুনন। দেখা যায় এক বৃষ্টির রাতে তাঁদের একান্ত সময়ে তাঁদের ছোট্ট কুঁড়ের দেওয়াল ভেঙে পড়ে, রাজাকান্নুর বড় শখ, মরার আগে তিনি তাঁর সেঙ্গিনিকে একটি পাকাবাড়ির মালকিন বানাবেন, আর সেই স্বপ্ন সত্যি করতেই তাঁদের অমানুষিক পরিশ্রম, তবু তাঁরা সুখী! ইতিমধ্যেই সেঙ্গিনি দ্বিতীয় বার অন্তঃসত্ত্বা, তাই বেশি রোজগারের আশায় রাজাকান্নু অন্যত্র ইটভাটায় কাজে লেগেছেন। দারিদ্রতা-আক্ষেপ-প্রেম সব মিলিয়ে তাঁরা যখন এক পা এক পা করে নিজেদের স্বপ্নপূরণের পথে এগোচ্ছেন তখনই ঘটে ছন্দপতন।

     

    জানা যায়,পাশের গ্রামের সরপঞ্জের বাড়িতে বড়সড় চুরি হয়েছে, আর যেহেতু গ্রাম ছাড়ার আগে রাজাকান্নুই অপরিচিত একমাত্র ব্যক্তি যিনি সাপ ধরতে সরপঞ্জের বাড়িতে গিয়েছিলেন আর তাঁর জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে বিনা প্রমাণে তিনি চোর সাব্যস্ত হলেন, পুলিশও হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করল। রাজাকান্নুর খোঁজ বের করার জন্য অন্তঃসত্ত্বা সেঙ্গিনিকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে থানায় নিয়ে গেলেন দারোগা গুরুস্বামী। এর পর একে একে রাজাকান্নুর আরও দুই আত্মীয়কে তুলে এনে চলল অকথ্য অত্যাচার। হঠাৎই পুরো ঘটনাক্রমের কিছুই না  জানা রাজাকান্নু গ্রামে ফিরে আসেন, পুলিশ পেয়ে যায় তাঁদের ‘ফেরার আসামি’কে। পুলিশি নির্যাতন নিয়ে বহু ছবি তৈরি হলেও এই ছবিতে ক্ষণে ক্ষণে উঠে আসা পুলিশি পাশবিকতায় রীতিমতো আঁতকে উঠতে হয়৷

     

    অত্যাচারের এক পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়া হয় বাকিদের, তবে রাজাকান্নু ও তাঁর দুই পুরুষ আত্মীয় ইরুটাপ্পন ও মাসাকুট্টেকে আটকে চলে  পৈশাচিক অত্যাচার। এর পর এক ভোরে হঠাৎই জানা যায়, তিন জনই পুলিশ লকআপ থেকে ফেরার। কিন্তু সেঙ্গিনি বিষয়টিকে সহজে মানতে পারে না। গ্রামের শিক্ষিকা ও স্থানীয় বামপন্থী নেতাদের সহায়তায় সে শরণাপন্ন হয় মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্র্যাকটিসরত আইনজীবী চন্দ্রুর। চন্দ্রু এক জন সত্যনিষ্ঠ লড়াকু উকিল, যিনি মানবাধিকার সংক্রান্ত কোনও কেসের ফি নেন না। সেঙ্গিনির মুখে পুলিশি বর্বরতার সমস্ত কথা শুনতে শুনতে ভাষা হারিয়ে যায় চন্দ্রুর। এর পর শুরু হয় চন্দ্রুর আইনি লড়াই সেই হঠাৎই উবে যাওয়া তিন জনকে খুঁজে পাওয়ার জন্য। হাইকোর্টে ‘হেবিয়াস কর্পাস’ রিট ফাইল করা হয়। গল্প ক্রমশই এগোতে থাকে 'কী হয় কী হয়' গতিতে।

     

    জয় ভীম' প্রথমেই মুগ্ধ করেছে টানটান চিত্রনাট্য। একের পর এক বাস্তবভিত্তিক সংলাপ ও অসাধারণ অভিনয়। ছবির প্রারম্ভেই ইরুলু' জনজাতির দৈনন্দিন জীবনযাত্ৰা দেখিয়ে  পরিচালক সুনিপুণ ভাবে ব্যাকস্টোরি বলে দিয়েছেন, যার ফলে পরবর্তী সময়ে মানুষগুলোর উপর হয়ে চলা অন্যায়-অত্যাচারের সঙ্গে দর্শক সহজেই একাত্ম হয়ে উঠতে পারেন। আইনজীবী চন্দ্রুর ভূমিকায় দক্ষিণী সুপারস্টার সুরয়া এককথায় অনবদ্য! তবে নিজের স্টারডাম ও 'হিরো' সত্তা বজায় রাখতে অহেতুক মশালা ডায়লগ ব্যবহারের পথে হাঁটেননি পরিচালক বা অভিনেতা কেউই। প্রতিটি সিনে তিনি নিজেকে নতুন ভাবে তুলে ধরেছেন। এই চরিত্র তাঁর কেরিয়ারে নিঃসন্দেহে একটি ল্যান্ডমার্ক হয়ে থাকবে। তাঁর পাশাপাশি সেঙ্গিনি চরিত্রে লিজোর যথাযথ অভিনয় সত্যিই স্বামীহারা আদিবাসী মহিলার যন্ত্রণাকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে সফল হয়েছে। আইজি পেরুমলস্বামী চরিত্রে প্রকাশ রাজ দুর্দান্ত। সব মিলিয়ে জয় ভীম' ছবিতে অভিনেতা বাছাইয়ে ক্ষেত্রে পরিচালক নিজের বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন।

     

    আরও পড়ুন:করোনা, রাজনীতি, ওটিটি: তিনের গেরোয় বাংলা ছবি

     

    ’90-এর দশকের শেষ ভাগের সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই ছবি যেমন এক দিকে সমাজ ও মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী এবং পরে বিচারপতি চন্দ্রুর আইনি লড়াইকে তুলে ধরে, যিনি নিজের জীবদ্দশায় অসংখ্য মামলা সামলেছেন। যার মধ্যে অধিকাংশই মানবাধিকার সংক্রান্ত। এই ছবির চরিত্রগুলির মতো হাজার হাজার সেঙ্গিনি-রাজাকান্নু আজও তুচ্ছতাচ্ছিল্য, চূড়ান্ত অবহেলা নিয়ে যুঝছেন এই ‘ভারত’-এর কোণে কোণে, ‘ইন্ডিয়া’র নজর কবে পড়বে ওঁদের দিকে?

     

    রেটিং – 4.5/5


    সুদীপ্ত চ্যাটার্জী - এর অন্যান্য লেখা


    আড়াই দশক আগে তামিলনাড়ুর এক প্রত্যন্ত গ্রামের স্থানীয় ইরুলু জনজাতির এক দম্পতির উপর পুলিশি নির্মমতার

    আইনি স্বীকৃতি পেলেও সমকামিতা নিয়ে সমাজের নেতিবাচক ভাবনার বদল এখনও হয়নি।

    সিনেমা:জয় ভীম-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested