×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • বাংলাকে কি দাবায়ে রাখা যায়?

    উদয়ন নাম্বুদিরি | 21-02-2022

    নিজস্ব ছবি

    বাংলা এখনও লড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জীবিত ভাষা বাংলা, আজও বিশাল উপমহাদেশের ছোট বড় ভাষা উপভাষার বেঁচে থাকার কারণও প্রেরণাবাংলা ভাষা বলে সবচেয়ে বেশিসংখ্যকমানুষ, হিন্দি-উর্দু-হিন্দুস্তানি নয়। হিন্দি ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা ভাষা, যা গ্রাস করছে শত শত এক সময়কার পূর্ণবুলিকে। যেমন ব্রজভাষামৈথিলি। বাংলা ভাষা কোনও ছোট ভাষাকে নাশ করে সমৃদ্ধ হয়েছে, এর প্রমাণ ইতিহাসে নেইউল্টোটা সত্যি। বাংলা এই উপমহাদেশের ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ জোগানের মাধ্যমে — সেটি হল ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে



    আজ সারা ভারতে চলছে হিন্দির আগ্রাসন। ভারতবর্ষে লিখিত ভাবে চলে আসা 5000 বছরে যত না গৃহযুদ্ধ হয়েছে, তার থেকে আরও বড় জাতীয় সংঘাতের আগাম লক্ষণ বেশ প্রকটভাবে আজ দেখা যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি ভাবে এক বিশাল চক্রান্তকে সাজানো হয়েছে, শুধু বাংলাকে নয়, ভারতের যত ঐতিহ্যসমৃদ্ধসুপ্রাচীন (যেমন তামিল, মালয়লম, কন্নড়, কোঙ্কনী, মরাঠী ভাষা) ভাষা এবং ভাষীদেরখর্বকরার জন্য। এই পরিকল্পনার যারা কাণ্ডারী তারা 1952-এর বাংলাকেন্দ্রিক এবং 1965-এর তামিলকেন্দ্রিক ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি মাথায় রেখে আর সরকারি ভাবে কোনও আইন বা নীতি তৈরি করে আর সেটিকে ঢাল তরোয়াল বানিয়ে এগোনোর বোকামি করছে না। এবারের অস্ত্রগুলো অনেক সূক্ষ্ম।মুখে এক, বাস্তবে আর এক এই রকম কৌশলে সাজানোদৈনন্দিন জীবনে বাঙালি, তামিল, মালয়ালিদের হিন্দি সম্বন্ধে একটা অবাস্তব মর্যাদার বোধ নির্মাণের চেষ্টা করেছে। তাদের বোঝানো হচ্ছে যে হিন্দিই একমাত্র জাতীয় ভাষা, আমাদের পিতৃপরিচয়, অন্যটা আমাদের মাতৃভাষা মাত্র। তলায় তলায় আছে বিষাক্ত পুরুষার্থ। আরও জড়িয়ে আছে হিন্দু মৌলবাদীদের মূল বানী— একটি ভারত, একটি পন্থা, একটি ভাষার আধিপত্য


    বাংলা এবং বাঙালিয়ানাকে হীন প্রতিপন্ন করতে যে বিগ বাজেট প্রকল্প দরকার, তা এই চক্রান্তের নায়করা বুঝেছে। এটা রাতারাতি সফল হবে না, লাগবে কয়েক প্রজন্মব্যাপী একটি রণনীতি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সব থেকে বেশি প্রয়োজন বাঙালির সংস্কৃতিকে নিজে রক্ষা করার



    হিন্দির আগ্রাসন প্রতিহত করতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনও সহযোগিতা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বিগত 40-50 বছর ধরে বাংলার সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও গভীরতা বৃদ্ধির প্রতি সরকারি উদাসীনতার অনেক উদাহরণ আছে। ওপর ওপর কিছু কাজ হচ্ছে না, তা নয়, যেমন বিভিন্ন সম্মাননা প্রদানের আনুষ্ঠানিক আয়োজন নেওয়া হচ্ছেকিন্তু এই সব হচ্ছে সংস্কৃতি দফতরের বাজেট খরচা করার জন্য প্রকল্প, আসলে কিছুই হয় নাতাই তিন দশক ধরে চলে আসা এবং বহু কোটি টাকা ব্যয় করে আয়োজিত কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এবং সেগুলোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসেন বলিউডের রথী-মহারথীরা



    এক সময় 1970-এর দশকে বাংলা ছবি বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশেষ বিশেষ ছবিকে করমুক্ত ঘোষণা করা হত। কিন্তু সে যুগ কবে চলে গেছে। মহারাষ্ট্র সরকার মরাঠি ছবি যাতে সন্ধে বেলা মাল্টপ্লেক্সে দেখা যায়, তেমন আইন এনেছে। এমন পদক্ষেপ কি পশ্চিমবঙ্গে নেওয়া যায় না

     

    বাংলার সাধারণ মানুষ ভাষাগতস্ব-পরিচয় বজায় রাখতে যতটা সজাগ ততটা কিন্তু সরকার বা সেখানকার রাজনৈতিক নেতারা নয়। বাংলার তাবড়তাবড় রাজনৈতিক নেতারা কলকাতায় বসে হিন্দিতে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। তামিল রাজনীতিকরা কিন্তু দিল্লিতে এসেও প্রেস কনফারেন্সে হিন্দি বলেন না। তাঁদের বক্তব্য, হয় তামিল নয় ইংরেজিতে তাঁরা যা বলার বলবেন, হিন্দির আধিপত্য মানবেন না।

    কেরলে একটি বড় প্রবাসী বাঙালি সমাজ আছে। তাঁরা কিন্তু যে যেখানে পেরেছেনছেট ছোট টিউটোরিয়াল খুলে সেখানে ছোট বাচ্চাদের অ-আ-ক-খ, কিছু বাংলা ছড়া কবিতা শেখান। মল্লপুরম জেলার তানুর একটি ছোট শহর। সেখানকারপ্রাবাসীবাঙালিরা গর্বের সঙ্গে বলেন যে সেখানে একটিও বাংলা-নিরক্ষর শিশু নেই। বনগাঁ থেকে আসা ইলেক্ট্রিশিয়ান খোকন ঘোষ তাও দুঃখের সঙ্গে বললেন, ‘তাও আমরা যা করছি তা এই বাচ্চাদের বাঙালি জীবন সম্বন্ধে কোনও গুণগত ধারণা দেবে না। ভবিষ্যতে হয়তো এটাও ভুলে যাবে।’

     

    আরও পড়ুন: হেমন্ত মান্না প্রতিমা শ্যামল নেই, সন্ধ্যাও অনিশ্চিত

     

    কথাটা সত্যি। তা হলে সমাধান কি সেই সরকারি সহায়তা? কিন্তু সেখানেও তো সই সরকার ঢুকলেই তার সঙ্গে ঢুকবে রাজনীতি আর আমলাতান্ত্রিকখবরদারি। এক সরকার যদি আন্তিরকভাবে উদ্যোগ নিয়ে কাজটা করেও বটে, পরের সরকার এসে তা চালিয়ে নিয়ে যাবে তারই বা নিশ্চয়তা কি?

     

    সারা দেশে এই তানুরেরমতো অনেক ছোট ছোট প্রয়াস চলছে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু খাস বাংলার বুকে কলকাতা শুধু নয়, শিলিগুড়ি বর্ধমানেও গড়ে উঠেছে একটি বৃহৎ হিন্দি-মুগ্ধ সমাজ। সেখানে বঙ্গসন্তানরা স্কুলে প্রথম ভাষা হিসেবে ইংরেজি এবং দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা পড়ছে।

     

    তবে ভরসার কথা এই যে এই রকম একটি বাঙালি সমাজ কিন্তু নতুন নয়, রবীন্দ্রনাথের আমলেও ছিল। তাতে বাংলা ভাষার স্বতন্ত্রতা রক্ষার অভিযান থেমে থাকবে না। এই প্রসঙ্গে 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাঙালি হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের গালে যে বিশাল থাপ্পড়টা মেরেছে তার কথা বলতেই হয়। হারের পর পরাজিত দলের নেতা তথাগত রায় স্বীকার করেছিলেন যে, হিন্দিভাষী নেতাদের এনে জনসভায় হিন্দিতে ভাষণ দেওয়ানো তাঁদের পরাজয়ের একট বড় কারণ।

     

    অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইংরেজিই এখন এখমাত্র বিশ্ব-ভাষা। সেই অবস্থায় বাংলা না এগোলে কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর ভাষা আন্দোলনেরই ক্ষতি। কারণ বাংলা পৃথিবীর এই অংশে এতই শক্তিশালী ভাষা যে সে পথপ্রদর্শকের সম্মান পায়। বাংলা ভাষা আর আজকের বাঙালিকে তাই সেই দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।



    একুশের শহীদদের সার্বিক সম্মান দিতে হলে আমরা, মানে বাঙালিকে প্রথমে দিতে হবে সম্মান। বাংলা ভাষার উন্নয়ন কাজে যারা ঘরে বসে বা লাইব্রেরিতে বই তথ্য ঘেঁটে, বা বাংলা পড়ে জীবিকা অর্জন করেন, তাদের অবদানকে স্বীকার করা



    আর এই ভাষা আন্দোলনকে কেবল পশ্চিমবঙ্গে সীমিত রাখা মূর্খামি হবে, মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের কথা। আজকের বাংলাদেশের কথা বলছি না, রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে রাজনৈতিক গোঁড়ামি অগ্রাহ্য করে একটি অভিযান এখন খুব দরকার

     

    আরও পড়ুন: শিশুমনে বাংলাকে সরিয়ে জায়গা নিচ্ছে হিন্দি



    এই ব্যাপারটা যে বেশ কিছু বাঙালি অনুভব করেছেন আজকের দিনে। পরের পদক্ষেপগুলো ক্রমানুসারে ঠিকঠাক নিতে হবে। তাই বলি বাংলাকে দাবানো যাবে নাবিজয় চন্দ্র মজুমদারের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আর রাজা দীনেশচন্দ্র সেনের History of Bengali Language & Literature পড়লে বোঝা যায় আমাদের এখনকারসংকটের চেয়ে কত বড় বড় ঝড় বাংলা ভাষাকে সম্মুখীন হতে হয়েছে গত দেড় বছর বয়সে। তখন কিন্তু বাংলা ভাষার অগ্রগতিকে ঠেকানো যায়নি। 


    উদয়ন নাম্বুদিরি - এর অন্যান্য লেখা


    গৈরিক জেনারেল হয়ে নেতাজির দিল্লি-জয়!

    স্বাধীনতার পর দুই বাংলা নিয়ে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলে লাভবান হত সকলেই

    একুশের সত্তর পূর্তিতে ভাষা শহীদ ভাইদের এবং তাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত সারা বিশ্বের ভাষা আন্দোলনের শহীদ

    বাংলাকে কি দাবায়ে রাখা যায়?-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested