×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • আমি সুভাষ কাঁদছি

    উদয়ন নাম্বুদিরি | 23-01-2022

    নিজস্ব ছবি

    দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনও জায়গায় অবস্থিত বেতারকেন্দ্র থেকে 1944-এ সুভাষচন্দ্র বসু (Netaji Subhash Chandra Bose) তাঁর প্রিয় ভারতবাসীর প্রতি 'দিল্লি চলো'-র ডাক দিয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু করতে চলেছিলেন তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তিযুদ্ধ। বেতার ভাষণের মাধ্যমে চেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর আশীর্বাদ। সুভাষ অহিংসার সমালোচক হলেও বিরোধী ছিলেন না। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর রাজনৈতিক কৌশল যে অহিংসায় সীমিত নয়, তার যে আরও অনেক প্রগতিশীল স্রোত ছিল সুভাষ তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সুভাষের সেই অনুভবের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় তাঁর বিভিন্ন লেখায়, বক্তৃতামালায়। এমনকি 1943-এ তাঁর আজাদ হিন্দ প্রাদেশিক সরকার যখন আত্মপ্রকাশ করল, তখন দেখা গেল সেটি মোটের ওপর গান্ধীর বিশ্বদর্শনের ওপরেই স্থাপন করা হয়েছে।

     

    নেতাজী স্বাধীন ভারতকে কখনও একটি হিন্দুপ্রধান দেশ হিসাবে কল্পনা করতেন না। হিন্দি নামক কোনও ভাষা চিনতেনই না। তাঁর সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা ছিল হিন্দুস্তানি, যা হিন্দি ও উর্দুর এক মিশ্রিত রূপ। তার অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পাশ্চাত্য এবং বৈদিক সমাজতন্ত্রের সংমিশ্রণে। যে কোনও সমাজে উন্নতির পথে নারীজাতির ভূমিকা প্রশ্নাতীত। সুভাষের কাছে যুগ যুগান্তরের মানবিক অবক্ষয়ের সব থেকে বড় উদাহরণ ছিল ভারতে হিন্দু-মুসলমান সমাজে নারীদের সামাজিক অধোগতি। তিনি তাই তাঁর প্রাদেশিক সরকারে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথনকে পূর্ণ মর্যাদায় সমগ্র নারীসমাজের পূর্ণাঙ্গ উন্নয়নের দায়িত্বভার দেন। অনুরূপভাবে গান্ধীও বারংবার তাঁর নানা লেখায় এই বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছিলেন।

     

    একটাই অমিল এই দুই মহাপুরুষের কৌশলে— স্বাধীনতা অর্জনের পদ্ধতি। সে আর নতুন কিছু নয়। ফরাসি বিপ্লব, ইতালি ও জার্মানির একত্রীকরণ থেকে শুরু করে রুশ বলশেভিক বিপ্লব এবং বিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ স্বাধীনতা সংগ্রাম— এই সবগুলোই দুই বা ততোধিক ধারার মধ্যে কখনও প্রতিযোগিতার, কখনও বা সহাবস্থানের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছিল, কার্যক্ষেত্রে ফলপ্রসূও হয়েছিল। ভারতবর্ষের মতো এত বিশাল এক মহাদেশে যে কেবল একটা রাজনৈতিক পথ থাকবে, সে কথা গান্ধী বা সুভাষের কোনও লেখায় পাওয়া যাবে না।

     

    তবে এই বিরোধের কথা আছে কাদের বইয়ে? সংঘ পরিবারের। আজ নেতাজী তাদের কাছে রণবেশধারী সেনাপতি, হিন্দু, মানে এক বিশেষ রকমের হিন্দু, যিনি পৌরুষে ভরপুর, মুসলিম বিতাড়নের মহাসৈনিক হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছেন— রাজধানী দিল্লির বিখ্যাত রাজপথে, ইন্ডিয়া গেটের ঠিক পাশে।

     

    শুধু এই নয়, এই বছর থেকে যতদিন ভারতবর্ষ থাকবে, দেশের সাধারণতন্ত্র দিবস উদযাপিত হবে, ততদিন সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্য করেই দেশের সাধারণতন্ত্র দিবসের নান্দীমুখ হবে। ঠিক যেমন দুর্গোৎসব শুরু হয় মহাসপ্তমীর ভোরে নবপত্রিকা স্নানের মধ্য দিয়ে!

     

    আরএসএস-এর বৌদ্ধিক মহলের মতে এটাই ছিল তাঁদের নেতাজির প্রাপ্য মর্যাদা। এবং নরেন্দ্র মোদী নাকি তা দিয়ে 75 বছর ধরে চলে আসা অসম্মানের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। তাদের আরও বক্তব্য, ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি হয়েছিল নাকি নেতাজির জন্য, গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নয়।

     

    এখন বাকি খালি নেতাজিকে রাষ্ট্রপিতা হিসাবে বসিয়ে, গান্ধীকে হটিয়ে সর্বব্যাপী এক পিতৃতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী, সংখ্যাগুরুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। সোশাল মিডিয়াতে খুঁজতে বসলে অ্যালগরিদমের সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে পাওয়া যাবে এই নিয়ে শত শত লেখা, ট্যুইট আর ভিডিও। সেখানে পড়া আর শোনা যাবে শুধুমাত্র ইতিহাস বিকৃতকরণের বিকট থেকে বিকটতর উপমা আর লজ্জাজনক উক্তি। "নেতাজিকে তাঁর যথার্থ সম্মান দিতে গেলে গান্ধীকে নামাতে হবেই", চন্দ্রচূড় ঘোষ নাম্নী জনৈক ঐতিহাসিক এমন কথাও বলছেন শোনা যাবে। আর একজন আছেন, যাঁর নাম অনুজ ধর, যিনি নাকি গত 15 বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে নেতাজির 1945 সালে উধাও হয়ে 'গুমনামী বাবা' নামক এক অতি-রহস্যময় ব্যক্তি হয়ে প্রত্যাবর্তন সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। তিনি ভয়ঙ্কর জনপ্রিয় একটি বিশেষ উন্মাদ জনসমষ্টির কাছে। যে সকল গুহ্য তথ্য উন্মোচনের জন্য এঁরা লোকপ্রিয়, তার মধ্যে কয়েকটি হল: "নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্র শিশিরকুমার বসুর পরিবার, নেহরুবাদী কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে নেতাজি রহস্যের সত্যটা চেপে দিয়েছে।" দুই, " আজাদ হিন্দ ফৌজের যত সোনা-দানা, অর্থ ছিল, সেই সব নেহরু পরিবার খেয়ে নিয়েছে।" তিন, "গান্ধী একজন ব্রিটিশ দালাল, সুভাষকে ঈর্ষা করতেন, মুসলমানদের মাথায় তুলে রাখতেন এবং দেশভাগের জন্য দায়ী।" এরকম আরও হাজার হাজার অনৈতিহাসিক ইতিবৃত্ত। কোনও কোনও চরমপন্থী আবার নেতাজির উর্দুভাষায় কথা বলা, "আজাদ হিন্দ ফৌজের নাম সংস্কৃত-ভিত্তিক হিন্দিতে 'ভারতীয় স্বাধীনতা সৈন্য বল' বা ওইরকম কিছু না রাখার জন্য কড়া শব্দে ধিক্কার জানায়। 'সঙ্গম টক' নামক একটি ইউটিউব চ্যানেলে ইদানীং কালে বেশ বড় একটি ঝড় তোলা হয়েছিল। সর্বেশ তিওয়ারি নামক এক ব্যক্তি তাতে নেতাজিকে 'ইসলামিস্ট' ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করেন। 'আমি সুভাষ বলছি' বলে সুভাষচন্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব থেকে তাঁর বেতার-বার্তা শুরু করতেন। এটা ইতিহাস।

     

    কিন্তু আজ মোদী অনুগামীদের দেখে তিনি কী বলতেন? সম্ভবত, 'আমি সুভাষ কাঁদছি'

     

     

    অনেক বঙ্গসন্তান যারা চিন্তাভাবনায় অগৈরিক-ও হতে পারেন, তাঁদের একাংশ মোদীর এসব পদক্ষেপকে মেনে নিয়েছেন, এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে তাঁদের মোদীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতেও দেখবেন। এ হেন বাঙালি প্রজন্মব্যাপী অন্য এক মৌলবাদী ঘরানার শিষ্য, যার নাম ঘেঁচু বাঙালিয়ানা। তাঁদের কাছে সুবুদ্ধি প্রত্যাশিতও নয়। সুভাষচন্দ্র ছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মুখ, রবীন্দ্রনাথের 'বঙ্গমাতা' কবিতা অনুসরণ করে 'An Indian Pilgrim' বইতে তিনি এসব কুচুটেমনস্ক বাঙালির অনেক তুলোধোনা করেছেন।

     

    একজন শিক্ষিত বাঙালির থেকে আশা করা যায় যে সুভাষকে রাজনৈতিক স্বার্থে এই আয়ত্তীকরণের বিরুদ্ধে, তাঁকে ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ পরিসরে আবদ্ধ করার বিরুদ্ধে তাঁরা সরব হবেন।

     

    গৈরিকরা ধারাবাহিক ভাবে স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ, বল্লভভাই প্যাটেলকে আত্মীকরণ করেছে। 'বন্দেমাতরম' মুখে নিয়ে এখন সংঘ পরিবারের ঠ্যাঙারে বাহিনী মুসলমান পীড়ন বেরোয়। এইভাবে বাঙালি মনীষী ও মনীষাকে  ছিনতাই করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ বাংলায় শোনা যায় না। ওই পূর্ববর্ণিত ঘেঁচু বাঙালিরাই হয়ে গেছেন বিশাল বাঙালি সভ্য সমাজের প্রতিনিধি। এই মনীষীহরণের বিরুদ্ধে কবে মুখ খুলবে বাঙালি মনীষা, বঙ্গের বুদ্ধিজীবী সমাজ? এবার কি শেষ সম্বল রবীন্দ্রনাথও ছিনতাই হবেন?

     

    আরও পড়ুন:নেতাজি-আবেগ আজকের শাসকের রাজনৈতিক পুঁজি

     

    নেতাজির জন্মদিবসের সঙ্গে সাধারণতন্ত্র দিবসের সন্ধিকরণ কি সুভাষের অপমান নয়? এটা কি ভারতের সবকটি নারী পুরুষের ব্যক্তিমর্যাদার উল্লঙ্ঘন নয়? 23 জানুয়ারি এক বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামীর জন্মতিথি। ঠিক আছে, তাঁকে স্মরণ করুন, সেটাই তো বিধেয়। কিন্তু তাঁর নাম দেশের সংবিধানের সঙ্গে জোড়াটা একটা অবমাননা। হোন না সে নেতাজি, হোন না সে গান্ধীজি, হোন না সে মোরারজি। একটি ব্যক্তিত্ব কখনও সমগ্র ভারতবাসীর সংবিধানের বিশ্বপিতা হতে পারে কি?

     

    এবার একটা ভবিষ্যৎ বাণীর পালা। সারা বিশ্ব এখন সব কিছুই দেখছে, পড়ছে আর বিশ্লেষণ করছে। ভারতবর্ষ এমন একটি দেশ, যে দেশ সারা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের এক ধরনের বৌদ্ধিক পীঠস্থান। এখন পর্যন্ত গান্ধীর মতো অহিংস ভাবধারার চরিত্র 'জাতির জনক' হিসাবে পরিচিত হচ্ছেন। কিন্তু এখন যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আর কিছুদিনের মধ্যেই নিউইয়র্ক টাইমস বা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে কিংবা টাইমস লন্ডনে একটি বিরাট অক্ষরের হেডলাইন, 'নাৎসীপ্রেমী বোস শান্তির মহামুনি গান্ধীকে হটিয়ে নতুন ভারতের জনক।' কী বলবেন তখন বুদ্ধিজীবীরা? কী বলবে তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তি?

     

    সারা পশ্চিম আজ নব নাৎসী আন্দোলনের ভয়াবহ সব কারসাজি নিয়ে চিন্তিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের নতুন নতুন চেহারা দেখছে। এতে সে দেশে সামাজিক মেরুকরণ ক্রমে প্রকটতর হচ্ছে। এই বাতাবরণে দরকার অহিংসা, আরও অহিংসা। কিন্তু ভারতবর্ষ— যে দেশকে ম্যাক্সমুলার সেই ঊনবিংশ শতকেই 'পৃথিবীর সভ্যতার আলো' বলে অভিহিত করে গেছেন, সেই দেশ আজ নতুন কোন অন্ধকারে? ব্যক্তিপূজোর আড়ম্বর ফুরোলে তা কি আমরা ভেবে দেখব না?


    উদয়ন নাম্বুদিরি - এর অন্যান্য লেখা


    একুশের সত্তর পূর্তিতে ভাষা শহীদ ভাইদের এবং তাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত সারা বিশ্বের ভাষা আন্দোলনের শহীদ

    স্বাধীনতার পর দুই বাংলা নিয়ে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলে লাভবান হত সকলেই

    গৈরিক জেনারেল হয়ে নেতাজির দিল্লি-জয়!

    আমি সুভাষ কাঁদছি -4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested