একটা সময় ছিল যখন বিপ্লবীদের ধরে পুলিশ অত্যাচার করত খবর জানার জন্য। বিপ্লবীরা বলতেন, বলব না। দিন কাল বদলেছে। এখন সরকার বলে, বলব না। ডান, বাম, অতি ডান, সব সরকারেরই এই বিষয়ে মোটামুটি একই অবস্থান। তারা সবাই তথ্য প্রকাশের বিরুদ্ধে। ফলে এক হাস্যকর পরিস্থিতির জন্ম হয় প্রায়ই।
মিনি বাসে উঠলে কনডাক্টরকে বলতে শোনা যায়, পিছন দিকে এগিয়ে চলুন। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে আমরা বেশ খানিকটা পিছন দিকে এগিয়ে গিয়েছি। নবান্নে বসে করোনা নিয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দল সাংবাদিকদের একরকম তথ্য দিচ্ছেন। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে সেই তথ্য বদলে দেওয়া হচ্ছে। মৃত্যু কমলে তো ভালো। আনন্দের খবর। কিন্তু সংখ্যা যদি গোপন করা হয়, সেটা ভয়ের।
সংসদে পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, মহারাষ্ট্রে 14,500 জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন গত 2014 থেকে 2019-এর মধ্যে। শুধু 2019 সালেই মৃত্যুর সংখ্যা 1286 জন। এটা অবশ্য মহারাষ্ট্রের মাত্র 11টি জেলার তথ্য। পশ্চিমবঙ্গ, বিহারের মত কিছু রাজ্য 2012 সাল থেকে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোকে (এনসিআরবি) কৃষকের আত্মহত্যা সংক্রান্ত কোনও তথ্য দেয়নি। তাদের দাবি, এমন কোনও ঘটনা রাজ্যে ঘটেনি। যদিও 2001 থেকে 2010, এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে মোট 18,375 জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। 2011 সালে সংখ্যাটা ছিল 951। তার পর থেকেই শূন্য। বিশ্বভারতীর অ্যাগ্রো-ইকনমিক রিসার্চ সেন্টারের 2017 সালের একটি সমীক্ষা অবশ্য বলছে 2011 থেকে 2016, এই সময়ে 126 জন কৃষকের আত্মহত্যার তথ্য তারা সংগ্রহ করতে পেরেছে। বোঝাই যাচ্ছে রাজ্য সরকারের তথ্যে গোলমাল থাকার সম্ভাবনা প্রবল। পুরোনো রেকর্ড বলছে ছত্তিসগড়ে একসময় কৃষকের আত্মহত্যা বড় সমস্যা ছিল। এরপর ছত্তিসগড় হঠাৎ করে সংখ্যাটা কমিয়ে দেয়। এনসিআরবির সর্বশেষ রিপোর্টে ওই রাজ্যে সংখ্যাটা মাত্র 4 জন। ঠিকই, অন্য যে কোনও মৃত্যুর মতোই কৃষকের আত্মহত্যা-জনিত মৃত্যুর সংখ্যাও কমে যাওয়া খুবই আনন্দের খবর। কিন্তু এই কমে যাওয়ার তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সব মহলে সন্দেহ রয়েছে।
যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ
অস্বস্তিকর তথ্য নিয়ে সব সরকারেরই কম-বেশি মাথাব্যথা থাকে। যখন 2002-03 সালে চা-বাগানে খেতে না পেয়ে অপুষ্টিতে শ্রমিকের মৃত্যুর খবর হাতে গোনা তুলনায় অ-কুলিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছিল সেই সময়েও দেখা গিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার সেই সব অভিযোগকে স্রেফ বিধানসভায় আসনসংখ্যার জোরে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে। যখন 2004 সালে আমলাশোলে খেতে না পেয়ে কয়েকজন আদিবাসীর মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছিল, তখনও বাম সরকাররের বক্তব্য ছিল, ওরা কয়েক জন মদ খেয়ে এবং বাকিরা টিবিতে মারা গিয়েছেন। কিন্তু বামপন্থীরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন না, তখন কিন্তু তাঁরা কোনও রকম সরকারি প্রতিক্রিয়া ছাড়াই দিনের পর দিন এই ধরনের না-খেতে পেয়ে মৃত্যুর খবর রিপোর্ট করে গেছেন। অবশ্য এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে খবরগুলো ঠিক ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে ঠিক খবরেও তাঁদের আপত্তি প্রকট হয়ে উঠল। এখানে সিপিএমের সাপ্তাহিক দেশহিতৈশী পত্রিকার সেই সময়ের কিছু খবরের উল্লেখ, বিষয়টিকে বুঝতে সাহায্য করবে।
1965, 17 সেপ্টেম্বর- ‘বন্ধ্যা খাদ্যনীতির ফলে গ্রাম-গ্রামান্তরে অনাহারজনিত মৃত্যুর করাল ছায়া পড়িয়াছে।...অনাহারজনিত কতগুলো মৃত্যুর খবর জলপাইগুড়ির মঙ্গলঘাট হইতে পাওয়া গিয়াছে। 8 নং ইউনিয়নের রঘুনাথ রায় তাঁর পরিবারের পাঁচ শিশুর মুখে খাদ্য তুলিয়া দিতে না-পারায় পিতৃত্বের দুঃসহ জ্বালায় আত্মহত্যা করেন। সাকতির 10 নং ইউনিয়নের আর একজন কৃষক অভাবের জ্বালায় আত্মহত্যা করিয়া ক্ষুধার হাত হইতে রক্ষা পাইয়াছেন।’
1965, 29 অক্টোবর– ‘হাওড়া জেলার নিবিড়া গ্রামের মতিহার রহমান নামক 28 বৎসর বয়স্ক এক যুবক তিন দিন অনাহারে থাকিবার পর গত 20 অক্টোবর সকালে মাকড়দহে চাউল সংগ্রহ করিতে আসিয়া মাকড়দহ রেল স্টেশনে মূর্ছিত হইয়া পড়েন এবং মারা যান।’
1965, 5 নভেম্বর- ‘আলিপুরদুয়ার মহুকুমায় ইতিমধ্যে ক্ষুধার জ্বালায় 11 জন মানুষ মৃত্যু বরণ করিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে।’
1965, 19 নভেম্বর– ‘গত 5 নভেম্বর মাতলা অঞ্চলের অন্তর্গত আমড়াবেড়িয়া গ্রামের ইয়াদ আলি মোল্লা (40) অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন।’
1966, 13 মে– দীর্ঘকাল সপরিবারে অনাহারে থাকিয়া শেষ পর্যন্ত জোড়াবাগানের কারফরমা লেনে 70 বৎসর বয়স্ক কৃষ্ণকান্ত দাস 6 মে রাত্রিতে গলায় দড়ি দিয়া আত্মহত্যা করিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে।’
এমন অসংখ্য দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা যায়। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর অনাহারে মৃত্যুর প্রতিটি অভিযোগই অস্বীকার করেছেন বামপন্থী নেতৃত্ব এবং বাম সরকার। আবার উল্টো দিকে তৃণমূলের বর্তমান নেতৃত্ব আমলাশোল নিয়ে প্রচুর হৈচৈ এবং বিবৃতি দিলেও, 2011-এ ক্ষমতায় এসে একইভাবে সব অনাহারে মৃত্যুর অভিযোগ অস্বীকার করেছে। যদিও অনাহারে মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে একাধিকবার। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ উঠেছে এমনকি ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার তথ্য গোপনেরও। করোনাভাইরাস নিয়ে যে অভিযোগ ফের নতুন করে উঠল।
সাবধান! বড়দা কিন্তু সব দেখছে!
সমস্যাটা শুধু এই রাজ্যে, এমন নয়। কেন্দ্রীয় সরকার তো বটেই, দেশের বিভিন্ন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত এই অভিযোগ উঠছে। এদিকে বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যখন তথ্য গোপনের বা না-জানানোর অভিযোগ উঠছে, তখনই কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে না জানিয়ে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছে বেশ জোরালো ভাবে। তবে বিরোধী দল কংগ্রেস আসন সংখ্যায় অতি দুর্বল হওয়ায় ব্যাপারটায় সহজেই ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ‘নাইনন্টিন এইট্টি-ফোর’ বা 1984 জর্জ অরওয়েলের বহু পরিচিত ভয় ধরানো এক উপন্যাসের নাম। সেই উপন্যাসে আছে ‘মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ’, যেখানে লেখা থাকে ‘ওয়ার ইজ পিস’, ‘ফ্রিডম ইস স্লেভারি’ এবং ‘ইগনোরেন্স ইজ স্ট্রেংথ’। ‘মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ’-এর কাজ সংবাদ বিষয়টি দেখা-শোনা করা, যাতে কোনও অপছন্দের খবর বেরিয়ে না পড়ে। আছে ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’, যেখানে ঘরে একটাও জানলা নেই। তাদের আসল কাজ কঠোর ভাবে আইন শৃঙ্খলা দেখাশোনা করে। যেখানে সবাইকে সাবধান করে দিতে বিভিন্ন দেওয়ালে লেখা থাকে ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং’। আপনার উপর নজর রাখা হচ্ছে। আমরা কি সেরকম একটা দেশের দিকে এগোচ্ছি ধীরে ধীরে?
গত 8 মার্চ, কংগ্রেস মুখপাত্র মনীশ তিওয়ারি অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় সরকার কি দেশের মানুষের অজান্তে তাদের উপর গোপন নজরদারি চালিয়ে দেশটাকে জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনন্টিন এইট্টি-ফোর’-এর জগতে নিয়ে যেতে চাইছে? মনীশ তিওয়ারি বলেন, দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত পরিসরকে অগ্রাহ্য করে বিজেপি সরকার গণ-নজরদারি বা ‘মাস সারভেইল্যান্স’-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। যেখানে নজর রাখা হবে প্রতিটি নাগরিকের উপর। সে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে? কী ব্যবসা করছে? কোন রাজনীতি করছে? গত 18 মার্চ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবরে দাবি করা হয়, মোদী সরকার সব ক’টি টেলিকম কোম্পানিকে বলেছে, গত কয়েক মাসের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের, দেশের সব মোবাইল ব্যবহারকারীর ‘কল-ডেটা-রেকর্ড’ জমা দিতে। প্রশ্নটা উঠেছে এখান থেকেই। মনীশ বলেন, খুবই উদ্বেগের বিষয়, একটা গোপন ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এর আগে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি নিয়ে একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের 9 সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মত ভাবে রায় দিয়ে বলেছিল, ব্যক্তিগত পরিসর বা ‘প্রাইভেসি’ নাগরিকের স্বীকৃত অধিকার। কোনও সরকার তা কেড়ে নিতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টকে অস্বীকার করে নাগরিকের সেই অধিকারে মোদী সরকার হস্তক্ষেপ করতে চাইছে বলে মনীশ তিওয়ারি অভিযোগ করেছেন।
আরও গুরুতর অভিযোগ তুলেছে ‘হাফপোস্ট ইন্ডিয়া’। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে ‘হাফপোস্ট ইন্ডিয়া’ দাবি করেছে (দেশি-বিদেশি অন্য সংবাদমাধ্যমেও পরে সে খবর প্রকাশিত হয়েছে), কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের কর্মরত একজন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মনোরঞ্জন কুমার কেন্দ্রীয় সরকারকে নোট দিয়ে বলেছেন, সেন্ট্রালাইজড-ক্রসলিঙ্ক ডেটাবেস ব্যবহার করে যে ‘‘ন্যাশনাল সোশাল রেজিস্ট্রি’ তৈরি করা হচ্ছে তা ভবিষ্যতে আমাদের দেশের 130 কোটি জনসংখ্যার প্রাইভেসির পক্ষে বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। উচ্চপদস্থ সেই আমলার নোটের ফোটোকপি প্রকাশ করে ‘হাফপোস্ট ইন্ডিয়া’-র খবর, কেন্দ্রকে এই বার্তা দিলেও, কেন্দ্র এই বার্তা অগ্রাহ্য করেছে। সরকারের থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরনের আর্থিক সহায়তা যারা নিচ্ছেন, সেই সহায়তা যাতে তাঁরা যথাযথ ভাবে পান, যাতে সেই সহায়তা ভুল গ্রাহকের হাতে গিয়ে না পৌঁছোয়, তার উপর নজরদারির জন্যই এই ‘ন্যাশনাল সোশাল রেজিস্ট্রি’ তৈরি করা হয়েছে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার জানতে পারবে এবং মনিটর করতে পারবে এই সহয়তাপ্রাপ্তদের যাবতীয় তথ্য। এই কাজ যখন অনেকটা এগিয়ে গেছে, সেই সময় এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের তৎকালীন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মনোরঞ্জন কুমার সরকারকে নোট দিয়ে বলেছিলেন, এই ব্যবস্থার খুব সহজেই অপব্যবহার করা সম্ভব। মনোরঞ্জন কুমার পরামর্শ দেন, এই ব্যবস্থায় যথেষ্ট পরিমাণে সেফগার্ড থাকা দরকার যাতে নাগরিকদের ব্যক্তিগত পরিসর কখনও আক্রান্ত না হয়। যদিও মনোরঞ্জন কুমারের কথায়ও কোনও কাজ হয়নি। মনোরঞ্জন কুমার ইকনমিক অ্যাডভাইসরের পদ থেকে এখন অবসর নিয়েছেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, যে উদ্দেশ্যে ‘সোশাল রেজিস্ট্রি’ তৈরি হচ্ছে সেটা খুবই ভাল। কিন্তু তার ভুল ব্যবহার আটকানোর জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
স্বাধীন ভারতের প্রথম যুগে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের প্রভাব ছিল রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়েও
সাবধান! বড়দা কিন্তু সব দেখছে!
ছ’শো বছরের বাংলা পুঁথি, দলিল, দস্তাবেজ, বই, পত্র-পত্রিকা, নথি ইত্যাদি থেকে সংগৃহীত এই শব্দ সম্ভার।