×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • বাংলায় তাহলে ‘ভালবাসা’ ছিল না?

    শুভাশিস মৈত্র | 20-04-2020

    প্রতীকী ছবি

    সময়ের সাথে সব কিছুই বদলে যায়। কবীর সুমনের গানের কথায়, ‘পাল্টায় মন, পাল্টায় চারপাশ / রাস্তায় আসে নতুন রুটের বাস।সবে বাংলা নববর্ষ গেলো। সেই উপলক্ষে আমরা আলোচনা করব দুএকটি বাংলা শব্দের পাল্টে যাওয়া নিয়ে। কথাটা নতুন কিছু নয়। তবে নতুন করে গোলাম মুরশিদের সম্পাদনায় তিন খণ্ডে প্রায় সোয়া তিন লক্ষ বাংলা শব্দের ঢাকার বাংলা অ্যাকাডেমির বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’-এর পাতা ওল্টাতে গিয়ে ফের মনে এল কথাটা। প্রায় ছশো বছরের বাংলা পুঁথি, দলিল, দস্তাবেজ, বই, পত্র-পত্রিকা, নথি ইত্যাদি থেকে সংগৃহীত এই শব্দ সম্ভার। বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ অভিধান এখন এটাই।

     

    বাদ + অনুবাদ। বাদানুবাদ। মানে তর্ক-বিতর্ক। তার মানে তো অনুবাদমানে দাঁড়ায় বিতর্ক। অথচ আমরা তো অনুবাদ বলতে কেবল তর্জমাই বুঝি। যাকে ইংরেজিতে বলে ট্র্যানস্লেশন। বিবর্তনমূলক অভিধানে বিভিন্ন বাংলা বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখানো হয়েছে, অনুবাদের মানে যুগে যুগে কী ভাবে বদলেছে।

     

    ১৫৫০ সালে চণ্ডিদাস লিখছেন, ‘সাধ বহু করে, বিহি করে অনুবাদ’ (বিহি শব্দ বিধিঅর্থে ব্যবহৃত)। এখানে অনুবাদের অর্থ বাধা’, ‘প্রতিকূলতা। একশো বছর পরে, ১৬৫০ সালে মাধব আচার্য লিখছেন, ‘ধন্য ধন্য করিয়া, করিল অনুবাদ।এখানে আবার  অনুবাদের অর্থ প্রশংসা। ১৬৫০-এই কবি বিজয় গুপ্ত কিন্তু অনুবাদ শব্দটি ব্যবহার করেছেন অপরাধঅর্থে। তিনি লিখছেন, ‘নাহি দোষ অনুবাদ খেমা কর আমা। ১৬৭০-এ জ্ঞান দাস লিখছেন, ‘মনে ছিল অনুবাদ, পুরালো মনের সাধ।এখানে অনুবাদের মানে হয়ে গেল আকাঙ্ক্ষা। ১৭৮১ সালে মানিকরাম গাঙ্গুলির লেখায় অনুবাদের অর্থ বর্ণনা। তাঁর লেখায়, ‘তোমার গুণানুবাদ রচিব কর‍্যাচি সাধ।অনুবাদ বিতর্কঅর্থে ব্যবহার পাওয়া যাচ্ছে ১৮৪২ সালে অক্ষয়কুমার দত্তের লেখায়- সমাচারপত্র সম্পাদক মহাশয়রা বাদানুবাদ করিতেছেন।আবার অক্ষয়কুমার দত্তের লেখাতেই অনুবাদ শব্দ ট্র্যানস্লেশনঅর্থে ব্যবহার পাওয়া যাচ্ছে— ‘বহু বিদ্যার বৃদ্ধি নিমিত্ত নানা প্রকার গ্রন্থের অনুবাদ করা যাইবেক।মনে হয় তখনও অনুবাদ শব্দ একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হত। এখনও অবশ্য বাদানুবাদশব্দ আমরা ব্যবহার করি। কিন্তু অনেক সময়ই খেয়াল রাখি না যে শব্দটি মানে পাল্টে বিতর্কঅর্থে ব্যবহার হচ্ছে।

     

    কাউকে বেশি লাইদিতে নেই সবাই চড়ে মাথায়। সুকুমার রায়ের এই লাইবা নেইএকসময় বাংলা ভাষায় ভালোবাসাঅর্থে ব্যবহার হত। যার অপভ্রংশ নেহবা নেহা। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম বোঝাতে এই শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। শব্দ পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন কেমন করে শব্দের অর্থ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। তাঁর লেখায়- ইংরেজি ‘LOVE’-এর প্রতিশব্দ এখন যা বাংলায় জোরের সঙ্গে চলছে, সেটা হচ্ছে ভালোবাসা। ...কিন্তু ভালোবাসাশব্দটি দুশো বছর আগে বাংলা ভাষায় , ‘LOVE’, এই বিশিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হত না। তখন ভালো-বাসা’-র অর্থ, প্রেম, প্রণয়, স্নেহ, প্রীতি প্রভৃতি ছিল না; - ‘ভালো + বাসাএই মিলিত শব্দটি কতকটা যেন বর্ণ-বা রাগ-হীন নিষ্প্রাণ শব্দ ছিল; এর অর্থ ছিল তখন, ‘ভালো বলে অনুভব করা, ভালো মনে করা।ভালো-বাসা শব্দের বাসাবা বাসধাতু, ‘বোধ করাঅর্থে প্রযুক্ত হতএখন এই অর্থে ধাতুটি অপ্রচলিত হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা’-র পাশাপাশি মন্দ-বাসাশব্দটিও শোনা যায়। কিন্তু প্রাচীন বাংলাতে বাসধাতু বেশ জীবিত ধাতু। এই ধাতুর সহযোগে ভালো-বাসা’, ‘মন্দ-বাসার মতন পুরাতন বাঙলায় ভয়-বাসা’, ‘ঘৃণা-বাসা’, ‘লজ্জা-বাসা’, ‘দুঃখ-বাসাপ্রভৃতির প্রয়োগ খুবই মেলে; এমনকী, ‘বাসি ভাত ব্যঞ্জনে জিহ্বায় জল বাসেএও পাওয়া যায়। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ-কীর্তনকাব্যের মধ্যে দেখি, রাহী বা রাই আর কান বা কানু পরস্পরের প্রতি নেহবা নেহা’ (অর্থাৎ কিনা স্নেহ) করে। ভালোবাসাঅর্থে অন্য খাঁটি বাংলা শব্দ চৈতন্য-পূর্ব যুগের ভাষায়, সম্ভবত খ্রীষ্টীয় ১৫-র শতকে, অজ্ঞাত। এই নেহ’, ‘নেহাশব্দ পরবর্তীকালে, ১৬-র আর ১৭-র দশকে লেহ’, ‘লেহারূপ ধরে, আর আজকালকার বাঙলায় এর একটি রূপ হচ্ছে নেই’—যেমন কুকুরকে নেই দিলে মাথায় চড়ে বসে

     

    ১৬ শতকের শেষ দিকে বা ১৭ শতকের গোড়ায় নেহ’, ‘নেহাছেড়ে বাংলায় এল সংস্কৃত শব্দ প্রীতি। এসেই এই শব্দ কবিদের মন জয় করে নিল। তার থেকে এল পিরীতি, পিরীত। যেমন, চণ্ডিদাসের (সম্ভবত) ভাষায়, ‘পিরীতি বলিয়া এ তিন আখর ভূবনে আনিল কে?’ এখন অবশ্য প্রেম, প্রণয় বা ভালোবাসা বোঝাতে আর কেউ পিরীতশব্দ ব্যবহার করে না। শব্দটি এখন কৌলিন্য হারিয়েছে। পিরীতএখন তাচ্ছিল্য অর্থে ব্যবহার হয়। অমুকের সঙ্গে তমুকের পিরীত দেখে বাঁচি না! বা বেশি পিরীত দেখাতে হবে নাইত্যাদি।

     

    সচিবশব্দ দিয়ে আমরা এখন রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের সেক্রেটারি পদে আসীন আমলাদের বোঝাই। কিন্তু এই শব্দের সাংবিধানিক অর্থ সহায়। কথাসরিৎ সাগরে আছে-নন্দরাজের সাচিব্য গ্রহণ করিলেন। এখন নতুন করে সাচিব্যশব্দ কেউ ব্যবহার করলে, পাঠকের কী প্রতিক্রিয়া হবে সহজেই অনুমান করা যায়। অপূর্ব’, এই শব্দটিকে আমরা ব্যবহার করি খুব সুন্দরঅর্থে। বিউটিফুলঅর্থে। এক সময়ে অপূর্বশব্দের অর্থ ছিল, যা পূর্বে ঘটেনি বা হয়নি। কথাসরিৎসাগরে যেমন বলা হয়েছে, ‘আপনি যে আখ্যায়িকা বলিয়াছেন তাহাতে তো কোনই অপূর্ব নাই।

     

    শব্দ শুধু অর্থ বদলায় না, শব্দ হারিয়েও যায়। কখনও আবার পুরোনো হারিয়ে যাওয়া শব্দ অন্য মানে নিয়ে ফিরেও আসে। একটা পুরোনো শব্দ, যার ব্যবহার ইদানিং প্রায় উঠেই গিয়েছিল, ফের ফিরে এসেছে সন্ত্রাসবাদীদের হাত ধরে। সেটা হল লস্করলস্করবললে অবশ্য বোঝা যাবে না। লস্কর এতৈবাবলতে হবে। আমরা সন্ত্রাসবাদী হামলার কথা ছাড়া লস্করশব্দ এখন প্রায় ব্যবহারই করি না। ১৬০৩ সালে আকবরের বঙ্গদেশ জয়েসেনাবাহিনী পাঠানোর কথা ভারতচন্দ্র কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আগে পাছে দুই পাশে দুসারি লস্কর। চলেন মানসিংহ যশোহর নগর। লস্কর মানে ফৌজ, সেনা, সিপাই। ফারসি শব্দ। বাংলায় অবশ্য গদাই লস্করি চালবলে একটা কথা চালু আছে। গদা, হরিচরণ যার অর্থ লিখেছেন, লৌহময় অস্ত্র, যাহা মেঘবৎ শব্দ করে। সেই ভারি অস্ত্রটি নিয়ে তো আর হন হন করে বা টগবগিয়ে যাওয়া যায় না। গতি মৃদুমন্দই হয়ে পড়ে গদার ভারে। সেই গতি থেকেই সম্ভবত এসেছে গদাই লস্করি চাল’ , কুঁড়েমি, উদ্যমহীনতা বোঝাতে। তবে লস্করি চালমানে অবশ্য অভিধান বলছে, লস্করের ন্যায় নিয়ন্ত্রিতচলন। কলকাতার খুব নামী স্কুলের এক শিক্ষকের কাছে গল্প শুনেছিলাম, পরীক্ষায় গদাই লস্করি চালনিয়ে বাক্য রচনা লিখতে বলায় এক ছাত্র নাকি লিখেছিল, ‘বৃষ্টি কম হওয়ায় এ বছর বাজারে গদাই লস্করি চালের দাম আকাশ ছোঁয়া

     

    বাংলায় আর একটি নতুন রাজনৈতিক শব্দ দিদি। এই শব্দটি বাংলায় জাঁকিয়ে বসেছে গত সাত-আট বছরে।  অসম, বিহার, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ইত্যাদি রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু রাজনৈতিক শব্দ হিসেবে ভাষায় দিদির মতো শক্ত-পোক্ত জায়গা করে নেওয়া, সে শুধু এই রাজ্যেই হয়েছে।

     

    অভ্র বসুর বাংলা বুৎপত্তি অভিধান শব্দগল্পদ্রুম'। এই বই একটি অসাধারণ সংকলন, যেখানে লেখক শব্দের হারিয়ে যাওয়া অর্থ খুঁজে বের করেছেন। একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রানেশ হে, আনন্দবসন্তসমাগমে। এই লাবণ্যশব্দ অভ্র বসুর মতে এসেছে লবণথেকে। কোন পথে অর্থ পরিবর্তন করতে করতে লবণ লাবণ্য হয়েছে তা অবশ্য বলা নেই। তবে ভারতের ইতিহাসে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ লবণআন্দোলন নিয়ে লিখতে গিয়ে কেউ যদি লেখেন, ‘দেশ যেন জেগে উঠল লাবণ্য-রাজনীতির ফলে’, তাকে যে সবাই মিলে যে দেশ-ছাড়া করে ছাড়বে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

     

    লেখা শুরু করেছিলাম গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’-এর কথা দিয়ে। শেষ করি তাঁর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য দিয়ে। সেটা হল, গোলাম মুরশিদ অভিধানের ভূমিকায় লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সারা জীবনে একবারও গুরুত্বপূর্ণশব্দটি ব্যবহার করেননি। রবীন্দ্র রচনাবলীতে এই শব্দটি নেই।

     

     


    শুভাশিস মৈত্র - এর অন্যান্য লেখা


    ছ’শো বছরের বাংলা পুঁথি, দলিল, দস্তাবেজ, বই, পত্র-পত্রিকা, নথি ইত্যাদি থেকে সংগৃহীত এই শব্দ সম্ভার।

    সাবধান! বড়দা কিন্তু সব দেখছে!

    স্বাধীন ভারতের প্রথম যুগে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের প্রভাব ছিল রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়েও

    বাংলায় তাহলে ‘ভালবাসা’ ছিল না?-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested