×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • জাতীয় শিক্ষানীতি 5 : অভিরূপ সরকার

    4thPillars ব্যুরো | 07-08-2020

    নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে (NEP 2020) শিক্ষার মান উন্নয়ন নিয়ে কতটা ভাবনা চিন্তা আছে? বিশ্বের শিক্ষা মানচিত্রে কি উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে পারবে ভারত? এ নিয়ে www.4thPillars.com ধারাবাহিক আলোচনা করছে। শুক্রবার আলোচনার পঞ্চম দিনে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক অভিরূপ সরকার। তাঁর বক্তব্যের নির্যাস, শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে নয়া নীতিতে বেশ কিছু ইতিবাচক দিকের কথা বললেও, চূড়ান্ত বিচারে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই শেষ কথা।

     


    1) প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত শিক্ষার গুণগত মানের যে অধোগতি হয়েছে, সে সম্পর্কে বর্তমান শিক্ষানীতির নির্ধারকরা ওয়াকিবহাল। অন্তত কাগজে কলমে সমস্যাগুলোর কিছু সমাধানসূত্র দেওয়া হয়েছে। 3 বছর বয়স থেকেই পড়ুয়াদের জন্য প্রি-স্কুল এবং অঙ্গনওয়ারি খোলার কথা বলা হচ্ছে।

     

    2) গ্রামের দিকে অনেক জায়গাতেই পড়ুয়ারা 'ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার'। সেক্ষেত্রে শহরের একজন পড়ুয়া লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বাড়ির সাহায্য পেলেও, গ্রামের পড়ুয়ারা সেটা পাচ্ছে না।

     

    3) বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা একদম নিম্নস্তর থেকে পড়ুয়াদের সেই অনুশীলন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি, যাতে তার বাড়ির কাজটাও স্কুলে করে দেওয়া সম্ভব। দক্ষিণ ভারতের ছোট একটা অংশে সেই চেষ্টাটা হয়েছিল। সেখানে বুনিয়াদি স্তর থেকেই বোর্ডিং স্কুল গড়া হয়েছিল। তাই অনেক পড়ুয়া শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে স্কুলের মতোই বাড়ির সাহচর্য পেয়েছিল।

     

    4) এখনকার বাবা মায়েরা মনে করেন ইংরাজি মাধ্যমে পড়লে সন্তানের উন্নতি হবে। কিন্তু সেটা তো অনেকের কাছেই যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ।

     

    5) সাক্ষরতার হার কিংবা নতুন ক্লাসে কতজন ছাত্র ভর্তি হচ্ছেন, তা দেখে কিছু ধারণা করা যায় না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখা, প্রাথমিক স্কুলে দু'জন মাত্র শিক্ষক 4টে ক্লাসের পড়ুয়াদের পড়াচ্ছেন, একই ঘরে। সুতরাং, এই রকম পরিবেশে গুণগত মানের আশা করা ভুল। আমার মতে, পড়ুয়ারা ধীরে ধীরে শিখুক, কিন্তু ভাল করে শিখুক।

     

    6) আমি ব্যক্তিগত ভাবে পাশ-ফেল প্রথার পক্ষে। না হলে পড়ুয়াদের মধ্যে উদ্যোগ তৈরি হবে না। কিন্তু, এটাও ভাবতে হবে ক্লাসে পুরনো পড়ুয়ারা রয়ে গেলে নতুন পড়ুয়ারা যাবে কোথায়? আবার পড়ুয়া কিছু যে শিখেছে, তারও একটা মূল্যায়ন হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও একটা মূল্যায়ন হয়ে যাবে। সরকার বুঝতে পারবে, তাঁরা যে অর্থ ব্যয় করছেন তার সদ্ব্যবহার হচ্ছে কিনা।

     

    7) ক্লাসে পিছিয়ে পড়া পড়ুয়াদের জন্য বিশেষ ক্লাসের দরকার। কিন্তু, তার জন্য তো লোকবল দরকার। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই পিছিয়ে পড়া পড়ুয়াদের মধ্যে অধিকাংশই এমন পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, যে পরিবারে পড়ুয়াটিকে এ ব্যাপারে সাহায্য করার মতো কেউ নেই।

     

    8) প্রাথমিকের শিক্ষকদের কিন্তু অনেকরকম কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। মিড ডে মিল প্রকল্পের দেখভাল থেকে প্রশাসনিক কাজকর্ম— সবই তাঁদের দেখতে হয়। তাই, প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য এঁদেরও কিছুটা কর্মভার লাঘব করতে হবে।

     

    9) বহুক্ষেত্রেই টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউটগুলো মোটা টাকা নিয়ে সার্টিফিকেট দিচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীকে প্রায় কিছুই শেখাচ্ছে না। নয়া নীতিতে অবশ্য এই ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু নয়া নীতিতে শুধু কিছু উচ্চ আদর্শের কথা বললেই তো হবে না, বাস্তবটাকেও স্বীকার করতে হবে।

     

    10) ইংরাজি ভাষা ছোট থেকে শেখা ভাল। উচ্চশিক্ষার জন্য ইংরাজি জানা খুবই প্রয়োজন। চিন-জাপানের মতো এই দেশে বিপুল পরিমাণ পাঠ্যবইকে স্থানীয় বা দেশীয় ভাষায় অনুবাদ করা যায়নি। তাই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এখনই অন্তত ইংরাজির বিকল্প কিছু হবে বলে মনে হয় না।


    11) ইংরাজিও তো একটা ভারতীয় ভাষা। ভারতীয় ইংরাজি বলেও একটা পরিষ্কার ইংরাজি আছে, যেটা মূলত ভারতীয়রা বলেন। ঔপনিবেশিক ভাষা বলে ইংরাজি নিয়ে ওজর-আপত্তি থাকা উচিত না। মাথায় রাখতে হবে, দেশের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে ভাষা নিয়ে বিবাদ আছে। তাই আপাতত ইংরাজিকে দরকার।


    12) 'মাল্টিডিসিপ্লিনারি' আর 'হোলিস্টিক' শব্দদু'টি নয়া নীতিতে সবচেয়ে বেশিবার ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু, একজন পড়ুয়ার ইতিহাস ভাল লাগলেও অঙ্কটা তার ভাল নাও লাগতে পারে। আবার উল্টোটাও সত্যি। পড়ুয়ারা যখন কলেজে পৌঁছায়, তখনই বুঝে নেয় তাদের পছন্দের বিষয়টা কী। অন্য দেশে অবশ্য ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেও পরে অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেছেন এমনটা হয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কি তেমনটা সম্ভব? একসময় জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীও কত সুন্দর বাংলা গদ্য লিখেছেন।

     

    13) নতুন ব্যবস্থায় মেজর-মাইনর বিভাজন থাকলে পড়ুয়াকে হয়তো মাইনরে পছন্দের বিষয়ের বাইরে অন্য কোনও বিষয় পড়তে হতে পারে। রাজ্যের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ব্যবস্থা চালু আছে। তবে আমার প্রশ্ন, পড়ুয়ার ভেতর থেকে কোনও বিষয়ের প্রতি আগ্রহ না এলে কেন তাকে জোর করে সেই বিষয় পড়তে বাধ্য করা হবে?

     

    14) মাতৃভাষা হিসাবে পড়ুয়ারা বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করলেও, পাশাপাশি ইংরাজিটাও শিখুক। এতে কোনও বিরোধ নেই। তবে ইংরাজি কিন্তু পরবর্তী জীবনে দিগন্ত খুলে দিতে পারে।

     

    15) পাঠক্রমের মাঝে 'হাফ-সার্টিফিকেট' নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না। একটা ধারাবাহিক পাঠক্রমে বিভাজন যখন নেই, তখন মাঝপথে ছেড়ে বেরিয়ে এলে পড়ুয়ার আদৌ কোনও লাভ হবে?

     

    16) একটা গুরুতর প্রশ্ন এই যে, কলেজগুলিকে কি এবার 3 বার করে প্রবেশিকা পরীক্ষা নিতে হবে? পাঠক্রমের মাঝে কেউ বেরিয়ে গিয়ে পরে আবার ঢুকতে চাইলে, তাকে কি আবার প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়েই ক্লাস করার সুযোগ দেওয়া হবে? এসবের ফলে কিন্তু অপ্রয়োজনীয় জটিলতা বাড়বে। 4 বছরের স্নাতক পাঠক্রম করতে হলে সেখানে 4 বছর পড়াটা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।

     

    17) মার্কিন বা অন্যান্য অনেক দেশে স্নাতক স্তরেই ধারাবাহিক পাঠক্রম তৈরি করে পড়ুয়াকে গবেষণার জন্য উপযোগী করে তোলা হয়। তারপরেও পড়ুয়াকে একটা জটিল পরীক্ষা দিতে হয়, যেখানে খুব কম পড়ুয়াই উত্তীর্ণ হয়। উত্তীর্ণ পড়ুয়ারা পিএইচডি-র জন্য যোগ্য বিবেচিত হন। কিন্তু নয়া নীতিতে তো স্নাতকের পরেই পিএইচডি— একটা বড়সড় লাফ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।

     

    18) 4 বছরের স্নাতকের পর, 2 বছরের স্নাতকোত্তর করিয়ে পিএইচডি করার অনুমোদন দেওয়া যেতে পারত। কিন্তু 4 বছরের স্নাতক পাঠ্যক্রমের পরই পড়ুয়াকে পিএইচডি করার সুযোগ দেওয়া— এটা মানা যায় না।

     

    19) আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলিতে 'টিচিং' এবং 'রিসার্চ' একসঙ্গে হয়। রাশিয়ায় আবার এই দু'টো আলাদা দু'টো প্রতিষ্ঠানে হয়। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু পড়াশোনা হলে, গবেষণার কাজকর্ম না হলে, সেই প্রতিষ্ঠান বিশেষ উন্নতি করতে পারবে না। তাই, 'টিচিং' এবং 'রিসার্চ'-কে একসঙ্গে রাখা হোক।

     

    20) বি-এডে পয়সা দিয়ে ডিগ্রি কেনার যে সিস্টেম— সেটা বদলানোর একটা ইঙ্গিত এই নীতিতে আছে। অন্তত সমস্যাটা নিয়ে তারা ওয়াকিবহাল। পরীক্ষা বা অন্যান্য কিছুর মাধ্যমে এটাকে নিশ্চিত করা সম্ভব।

     

    21) শিক্ষক, এমনকী উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে। নীতিতে জনগণের টাকায় জনগণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বার করা যাবে কীকরে, তার উত্তর নীতিতে নেই।

     

    22) বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের মান খুব ভাল। কিন্তু সেখানে খরচ আকাশছোঁয়া। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি আর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্থ, এর মধ্যে পড়ুয়ারা যাবে কোথায়? রাজনৈতিক সদিচ্ছাটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রদের রাজনীতি মনস্ক হতে হবে ঠিকই, কিন্তু তাদের ব্যবহার করে রাজনীতি করা কাম্য নয়।

     

    23) বিদেশি যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আছে, তারা কিন্তু শিক্ষার প্রসারের জন্য এ দেশে ক্যাম্পাস খোলেনি। টাকা রোজগারের জন্যই খুলেছে। অথচ এরা নিজেদের হোম ক্যাম্পাসে ভাল পড়াচ্ছে। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মধ্য-প্রাচ্যে ক্যাম্পাস খুলে কিন্তু নিজেদের সেই মান বজায় রাখতে পারেনি।

     

    24) আমাদের সমাজে শিক্ষিত যে হচ্ছেন, তাঁর কাজ অন্যকেও শিক্ষিত করা। মুনাফা-নির্ভর ব্যবস্থায় এই শিক্ষার বিষয়টি উপকৃত হবে না। তাই, এই ব্যাপারে বিদেশি বিনিয়োগে কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না।

     

    25) রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাদ দিলেও আইআইটি, আইআইএম কিন্তু সরকারি উদ্যোগেই তৈরি হয়েছে। এগুলো তো আমাদের গর্ব। বেসরকারি ভাবে কেউ এগিয়ে আসতেই পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে উদ্যোক্তাকে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হতে হবে।

     

    26) আশঙ্কার কথা, বোম্বে আইআইটিতে এখন জ্যোতিষশাস্ত্র এবং বৈদিক অঙ্ক শেখানোর কথা বলা হচ্ছে। শীর্ষস্তরের সদিচ্ছার অভাব এবং ধারণায় অস্পষ্টতাও শিক্ষার বিস্তারে অন্যতম অন্তরায়।

     

    27) নয়া নীতিতে শিক্ষক এবং পড়ুয়াদের স্বাধীনতা (ফ্রি হ্যান্ড) দেওয়ার কথা বলা আছে। সত্যিই কি তা হবে? বাস্তব পরিস্থিতি দেখে এই বিষয়ে সন্দেহ হয়।


    4thpillars ব্যুরো - এর অন্যান্য লেখা


    পশ্চিমবঙ্গে এবারের ভোটে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে অজস্র প্রশ্ন।

    2020-র বিহার বিধানসভ ভোটের শিক্ষার দিকে নজর থাকবে আগামী দিনেও।

    ফোর্থপিলার্সের ক্যামেরায় ধরা পড়ল এবং বারাসাতের ‘আনলকড’ চিত্র।

    বিজেপির প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হতেই আদি নব্য বিরোধ তুঙ্গে।

    গত সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনও আন্দোলনকে কেন্দ্রীয় সরকার দেশবিরোধী তকমা দিতে পারল না।

    করোনায় দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়েছে। তবু রাজনীতিক ও জনতার মধ্যে সচেতনতার বালাই নেই।

    জাতীয় শিক্ষানীতি 5 : অভিরূপ সরকার-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested