অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পরই তাঁর মৃত্যুর কারণ এবং আনুষঙ্গিক নানা বিষয় নিয়ে "রহস্য' ঘনীভূত হয়ে ওঠে। পরস্পর বিরোধী দু'টো শিবিরে বিভক্ত হয়ে যান মানুষ। কিন্তু মিডিয়ার একটা বড় অংশ সুশান্তের মৃত্যুর জন্য তাঁর বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীকে প্রকারান্তরে অভিযুক্ত হিসাবে দেখাতে থাকে। সোশাল মিডিয়াতেও জনরোষ আছড়ে পড়তে থাকে রিয়ার বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যেই একাধিক তদন্তকারী সংস্থা সুশান্ত-মৃত্যুর তদন্তে নেমেছে। কিন্তু তদন্তের ফলাফল হাতে আসার আগেই মিডিয়ার বিচারসভায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে গেছেন রিয়া চক্রবর্তী। মিডিয়া কি এমন বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে? এই নিয়েই www.4thpillars.com 29 আগস্ট সন্ধে 7টায় "মিডিয়ায় খাপ পঞ্চায়েত' শীর্ষক একটি লাইভ আলোচনার আয়োজন করেছিল। এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী অরুণাংশু চক্রবর্তী এবং সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র।
1) মিডিয়ায় এই খাপ-পঞ্চায়েতি সংস্কৃতিটা খুব পুরনো। আগেও মিডিয়া এমন বিচারকের ভূমিকা নিয়েছে। অনেকেরই মনে থাকবে, উদয়ন-কাণ্ডের মধ্যে মিডিয়ার একাংশ রবিনসন স্ট্রিট কাণ্ডের ছায়া দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু আমরা জানি রবিনসন স্ট্রিট কাণ্ডে কোনও হত্যার ঘটনা ঘটেনি, যা উদয়ন কাণ্ডে ঘটেছিল।
2) মিডিয়া নিজেই নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে নষ্ট করেছে। আশঙ্কার ব্যাপার এই যে, মেধাবী ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যতে আর এই পেশায় আসবে না। সম্মানজনক পেশা হিসাবেও এটা আর স্বীকৃতি পাবে না। এমনিতেই খবরের কাগজের বিক্রি অনেক কমে গিয়েছে। এমন নয় যে কোভিড পরিস্থিতি কমলে সেই বিক্রি আবার বাড়বে। কিছু ওয়েব পোর্টাল আর দু-তিনটে ইংরাজি সংবাদপত্র ভাল কাজ করছে। বাকি 90 শতাংশ একপেশে সাংবাদিকতা করছে।
3) খাপ পঞ্চায়েতে একপেশে রায় দেওয়া হলেও দু'পক্ষের মতামতই নেওয়া হয়। মিডিয়ায় তো সেটুকুও করা হচ্ছে না। বেশিরভাগ টেলিভিশন সঞ্চালকের দেশের আইন সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। দেশের মূল সমস্যাগুলোকে নিয়ে খবর না করে কিছু মিডিয়া বিকৃত এবং বাছাই করা কিছু খবর দেখাচ্ছে। আর বাকি মিডিয়া সেগুলোই অনুসরণ করছে।
4) রিয়া চক্রবর্তী, সুশান্ত সিং রাজুপুতের টাকা নিয়েছে এমন কোনও তথ্যপ্রমাণ এখনও পর্যন্ত সিবিআই-এর হাতে নেই। সুশান্তের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে 15 কোটি টাকা তোলা হয়েছে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা যে রিয়ার অ্যাকাউন্টেই গেছে এমন প্রমাণ নেই। সুপ্রিম কোর্ট দু'জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষকে একসঙ্গে থাকার অধিকার দিয়েছে। সেক্ষেত্রে রিয়া যদি সুশান্তের 15 কোটি টাকা নিয়েও থাকেন, তাকে আর্থিক তছরুপের অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় না। বিবাহিত না হলেও তাঁরা দু'জন লাইফ-পার্টনার। আর পার্টনারের সম্পত্তিতে তাঁর সঙ্গীর অধিকার রয়েছে।
5) মিডিয়ার উপর রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টিও অস্বীকার করা যায় না। খড়গপুর আইআইটির অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে, তাঁর খোলা চিঠিতে বলেছিলেন, হঠাৎ হয়তো বলা হবে অমুকের কম্পিউটারে তমুক অভিযুক্তের সঙ্গে আপনার যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে। মিডিয়াও সত্যাসত্য বিচার না করে ফলাও করে সেটা প্রচার করবে। হয়তো আমি একসময় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারব, কিন্তু আমার জীবন থেকে 5-10 বছর নষ্ট হয়ে যাবে। এভাবেই মিডিয়া এবং রাজনীতি হাত ধরাধরি করে চলছে। তবে এটা বলব, এই ট্রেন্ড নতুন কিছু নয়।
6) বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং এবং জনতা দলের তরফ থেকে স্লোগান তোলা হয়েছিল, "অলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়।' বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের মেয়াদকালে রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি। রাজীবও বলেছিলেন, তাঁর পরিবারের কেউ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। তবুও মানুষের স্মৃতি থেকে এই স্লোগান মোছেনি। মিডিয়াতেও এই নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছিল। মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে রাজনীতিকরা অনেক সময়ই এমন কোনও চটকদার ঘটনার সূত্রপাত ঘটান।
7) সুপ্রিম কোর্ট এই নিয়ে 142 নং ধারায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে এবং মহারাষ্ট্র পুলিশের তদন্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। কিন্তু সুশান্তের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের টাকা কোথায় গেল কিংবা তিনি কীভাবে মারা গেলেন, সেটা তো এখন খুব কম সময়ে জানা সম্ভব। সিবিআই, ইডি, নারকোটিক্স ব্রাঞ্চ— একটা আত্মহত্যার তদন্তে আর কত এজেন্সিকে কাজে লাগানো হবে? আসন্ন বিহার ভোটে রাজপুত ভোটব্যাঙ্ককে সুসংহত করতেই কি এত আয়োজন?
8) কয়েকটি হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের বাছাই অংশ কখনও কোনও তদন্তের তথ্যপ্রমাণ হতে পারে না। 18 ঘণ্টা জেরা করেও তদন্তকারী সংস্থা কেন রিয়া চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করতে পারল না? আসলে তারা জানে কোর্টে এই মামলা উঠলে তাদের যুক্তিগুলো ধোপে টিকবে না। সিবিআই-এর অতি সক্রিয়তা দেখে মনে হচ্ছে, তাদের কাছে তদন্তের থেকে রাজনীতিই মুখ্য।
9) বিশ্বের বহু দেশে মিডিয়া এথিক্সের জায়গাটা বেশ শক্তপোক্ত। সেখানে ব্যক্তির একটা ব্যক্তিগত পরিসর আছে, যেখানে মিডিয়া নাক গলায় না। কিন্তু আমাদের দেশে মিডিয়া এথিক্সের জায়গাটা বড় দুর্বল। ব্যক্তির প্রতি সম্মানের বোধটা এখানকার সাংবাদিকতায় বিরল।
10) স্ত্রী পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা বা চর্চা করলে টিআরপি বাড়ে। মানুষ তাদের পছন্দের খবরগুলোই মিডিয়ার কাছে শুনতে চায়। অবশ্য এর একটা রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। তাই মিডিয়াও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছেড়ে তাদের 70 শতাংশ সময় সুশান্ত সিং-এর মৃত্যু "রহস্য'-এর জন্য ব্যয় করছে।
11) সংবিধানের 21 নং ধারায় ব্যক্তির যে জীবনধারণের অধিকার, সেটা খর্ব হচ্ছে। মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে তো বটেই। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ রয়েছে।
12) বিশেষ রাজনৈতিক পক্ষ নিয়ে কাজ করার রীতি মিডিয়াতে আগেও ছিল। তবে এখন এটা কমবেশি সব মিডিয়াই অনুসরণ করে চলছে।
13) রিয়ার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে সে হয়তো মানহানির মামলা করত। রিয়ার কাছে এখনও এই পথ খোলা রয়েছে। সেক্ষেত্রে ওর সঙ্গে যে একপাক্ষিক অসভ্যতা চলছে, তাতে কিছুটা লাগাম পরানো যেতে পারে। রিয়ার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ দাখিল করেছেন, তারা সেই অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে, অভিযুক্তের সমান তাদের শাস্তি হতে পারে।
বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ মোর্চার রবিবারের ব্রিগেডের বিপুল জন সমাবেশ ভোটে কি দাগ কাটতে পারবে?
সামাজিক বার্তা দেওয়া আদালত বা সরকারের কাজ নয়।
মুসলিম পরিবারে হিন্দু মেয়ের বিয়ে নাকি লাভ জিহাদ - প্রেমের নামে ধর্ম প্রচার!
ফোর্থপিলার্সের ক্যামেরায় ধরা পড়ল এবং বারাসাতের ‘আনলকড’ চিত্র।
বিদ্বেষ আর হিংসার রাজনীতির বিরুদ্ধে একটা সাদা রুমাল নিয়েও তাদের কেউ পথে নামেনি।
Covid-19 নিয়ে আলোচনায় ডা: কৌশিক মজুমদার