×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • পরলোকে লুচ মন্তেনিয়ে: নোবেলজয়ীর বিতর্কিত বিজ্ঞান

    সুস্মিতা ঘোষ | 17-02-2022

    প্রতীকী ছবি।

    লুচ মন্তেনিয়ে (Luc Montagnier) অন্য জগতে চলে গেলেন সম্প্রতি ভাবি, জীবনের শেষ দশ বারো বছর কী না কী বিতর্ক সৃষ্টি করে গেলেন- হয়তো করে গেলেন বলেই শেষ যাত্রার পর সব কাগজে এডিটোরিয়াল, হেডলাইন বা নিদেনপক্ষে প্রথম পাতায় ঠাঁই পেলেন না হলে এই জমানায় 89 বছরের এক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী, যাঁর নোবেল পাওয়াটাও দু‘দশক পুরনো হয়ে গেছে, তাঁর কথা আর কে মনে রাখে!

     

    বিতর্কের কথায় পরে আসব, কিন্তু তার আগে সবার জানা উচিত, তিনি কেন নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন তিনি আবিষ্কার করেছিলেন এইডস (AIDS)-এর সঠিক কারণ- একটি বিশেষ ভাইরাসের সংক্রমণে এই রোগটি হয়, যে ভাইরাসটি আজ সর্বসম্মতি ক্রমে human immunodeficiency virus বা HIV নামে পরিচিত কিন্তু সেই আবিষ্কারের ইতিহাস চমকপ্রদ, তাতে রাজনীতি, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অর্থ বা বানিজ্য কত কী যে জড়িয়ে আছে!

     

    সাতের দশকের গোড়ায় আমেরিকা সরকারের ধারণা হয়েছিল যে, ছোঁয়াচে মহামারী ইত্যাদি তৃতীয় বিশ্বে হয় আমেরিকা এতই উন্নত যে জীবাণু ঘটিত কোনও রোগ সেখানে হয় না ক্যানসার মারণ ব্যাধি বটে, কিন্তু ভাইরাস টাইরাস আবার ক্যানসার ঘটায় নাকি! কাজেই ভাইরাসের ওপর গবেষণা করে বাজে খরচ করতে হবে না আমরা জানি অনেক সময়েই অনেক দেশের বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক নেতার বিজ্ঞানের জ্ঞানের অভাব তাদের বিজ্ঞান বিরোধী করে তোলে এবং সেই সব নেতা যখন ক্ষমতায় আসে তখন বিজ্ঞানের জয়যাত্রা প্রতিহত হয় এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, আমেরিকাতেও ঘটে (এবং পৃথিবীর আরও অনেক দেশেই মাঝে মধ্যে ঘটে থাকে) এই অবস্থায় আমেরিকার ভাইরাস বিজ্ঞানীরা রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়েন

     

    ভাইরাস কি মানুষেওর ক্যানসার ঘটাতে পারে?

    বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই জানা গেছে নানা রকমের ভাইরাস মুরগি, ইঁদুর, বেড়াল ইত্যাদি প্রাণীতে টিউমার উৎপন্ন করে এবং অনেক সময়েই সেগুলি ক্যানসারে পর্যবসিত হয় আমরা কথায় বলি ‘গিনিপিগ’, কিন্তু মানুষের রোগ বিস্তার প্রক্রিয়ার মডেল হিসেবে এই ছোট প্রাণীগুলিই বেশি ব্যবহৃত হয় কাজেই এই প্রাণীগুলিতে যখন ভাইরাস সংক্রমণের সঙ্গে ক্যানসারের যোগসূত্র পাওয়া গেল, তখন মনে করা হতে লাগল মানুষের ক্যানসার ঘটায় এমন ভাইরাসও নিশ্চয়ই আছে শুধু তাই নয়, যদিও ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে মানুষের অনেকটাই তফাৎ, কিন্তু রোনাল্ড ডালবেকো, যিনি তার আগে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে যে সব ভাইরাস গজায়, অর্থাৎ ব্যাকটেরিওফেজ বা ফেজ-এর বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তিনি দেখালেন ফেজ যেভাবে টেস্ট টিউব বা প্লেটে গজানো যায়, এই ক্যানসার ভাইরাস গুলির কয়েকটিও এই একই ভাবে গজানো যায় ভাইরাস গবেষণায় জোয়ার এসেছে দেখে 60 -এর দশকে US Virus Cancer Program শুরু করা হয় 

     

    রেট্রোভাইরাসের আবিষ্কার 

    ষাটের দশকের শেষ, সত্তরের গোড়ায় একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার ঘটে এক নতুন ধরনের ভাইরাস আবিষ্কৃত হল এই সময়ে, যে ভাইরাসের জিনে RNA থাকলেও তারা কোষের মধ্যে সংক্রমণের পর সেই RNA থেকে প্রথম যে কপি বানায়, সেটি DNA এই ঘটনাটি জিনতত্ত্বের প্রধান মতবাদ বা সেন্ট্রাল ডগমার (Central Dogma)-র বিপরীত, অর্থাৎ retro এই কারণে এই বিশেষ জাতির ভাইরাসদের রেট্রোভাইরাস নাম দেওয়া হয় RNA থেকে DNA হওয়ার এই অভিনব ঘটনা আবিষ্কার এবং এই ঘটনার অনুঘটক যে  এনজাইম, reverse transcriptase, তার আবিষ্কারক হাওয়ার্ড টেমিন ও ডেভিড বল্টিমোরকে নোবেল প্রাইজও দেওয়া হল ডালবেকোর সঙ্গে ভাগ করে, 1975 সালে কিন্তু মানুষের ক্যানসার ঘটায় এমন কোনও রেট্রোভাইরাস খুঁজে পাওয়া গেল না এই সময়ে কাজেই সরকারের ধারণা হল এসব গবেষণা বাজে, এবং আমেরিকার ভাইরাস গবেষণার অনুদান তখন তলানিতে চলে গেল কিছু বিজ্ঞানী কিন্তু এই সব প্রতিকূলতার মধ্যেও ভাইরাস নিয়ে গবেষণা চালিয়ে গেলেন, তাদের একজন হলেন রবার্ট বা বব গ্যালো (Robert Gallo) (এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে covid এর RT-PCR এর RT রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ এর নামানুসারে - RNA ভাইরাসকে নির্ণয় করার আগে তাকে ডিএনএ-তে রূপান্তরিত করে নিতে হয় এবং সেই কাজে এত এনজাইমটি ব্যবহার করা হয়)

     

    আরও পড়ুন: আজকের করোনা আর শতবর্ষে হর গোবিন্দ খুরানা

     

    গ্যালোর ধারণা ছিল, মানুষের লিউকিমিয়া নিশ্চয়ই ভাইরাস জনিত এই ভাইরাস খোঁজার পথে তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন একটি বিশেষ প্রোটিন, যা রক্তের শ্বেতকোষের অন্তর্গত T কোষকে টেস্ট টিউবে গজাতে সাহায্য করে এই T কোষ আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বা immunity র কাজে বিরাট ভূমিকা পালন করে এই গজানোর পদ্ধতি আবিষ্কারের পরে পরেই মানুষের ক্যানসারে জড়িত প্রথম রেট্রোভাইরাসটি আবিষ্কৃত হল, যার নাম তিনি দিলেন HTLV (Human T-lymphocyte Virus) - পরে HTLV I নাম হল, কারণ তিনি এই গোত্রের একাধিক ভাইরাস আবিষ্কার করেন T কোষ গজানোতে সাহায্যকারী প্রোটিনটির তখনকার মতো একটি নামকরণ হলেও পরে নাম হল ইন্টারলিউকিন 2 (IL-2), যখন ইন্টারলিউকিন জাতীয় অনেক প্রোটিন আবিষ্কৃত হয়ে গেল 

     

    এই একই সময়ে ফ্রান্সের অবস্থা অনেকটা সন্তোষজনক- বিজ্ঞানমনস্কতার দিক থেকে তো বটেই 1972 সালে নোবেলজয়ী ভাইরাস বিজ্ঞানী জাক মনো (Jacques Monod) লুচ মন্তেনিয়েকে বললেন, পাস্তুর ইনস্টিটিউটে একটি নতুন ভাইরাস গবেষণার বিভাগ খুলতে মন্তেনিয়ে বিভাগটির নাম দিলেন viral oncology unit, কারণ তিনি বুঝলেন পৃথিবীর অন্যত্র যখন ভাইরাসের সঙ্গে ক্যান্সারের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, তখন ফ্রান্সকে পিছিয়ে থাকলে চলবে না মন্তেনিয়ে গ্যালোর সাফল্য দেখে তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে চাইলেন গ্যালোর কাছ থেকে তাঁর আবিষ্কৃত ভাইরাসের কালচার নিয়ে এসে শিখতে চাইলেন সেই পদ্ধতি প্রথমে অকৃতকার্য হলেন তারপর দেখলেন যে ল্যাবরেটরিতে T কোষ গজানোর সময়ে কোষের যে খাদ্য ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে ইন্টারফেরন (interferon) নামে এক ধরনের প্রোটিন রয়ে গেছে, যার কাজই ভাইরাসকে বাধা দেওয়া এবার তিনি নিজের মতো করে রেট্রোভাইরাস কালচার করার পদ্ধতি বানিয়ে নিলেন 

     

    এইডস এল রে!

    সাতের দশক শেষ হতে না হতে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ল এক অশ্রুতপূর্ব মারণ রোগ প্রথমে দেখা গেল সমকামী এবং ইনজেকশনের মারফৎ ড্রাগের নেশা করে এমন অনেকেরই শরীরে ক্ষয় হচ্ছে, নানা রকম ইনফেকশন হচ্ছে, সারছে না এবং এইভাবেই তারা মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে রোগটি শুধু আফ্রিকায় নয়, খোদ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেও ভাল রকম থাবা বসিয়েছে আমেরিকা সরকার নড়ে চড়ে বসাতে এই রোগটির পিছনে গবেষণাতে সব চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হল 1981 সালে প্রথম এই রোগটিকে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে নাম দেওয়া হল Acquired Immunodeficiency Syndrome (AIDS) কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল যে শুধু সমকামী পুরুষ ও ড্রাগ ব্যবহারকারী নয়, সদ্যোজাত শিশু এবং চিকিৎসার কারণে রক্ত নিয়েছে এমন লোকের মধ্যেও এইডসের ঘটনা প্রচুর তাহলে তো এটা ছোঁয়াচে, এবং মহামারীর রূপ নেওয়া তো শুরু হয়ে গেছে! রোগের কারণ হিসেবে একটা তথ্য জানা গেছে যে, এই রোগে রক্তের Tকোষের অন্তর্গত একটি বিশেষ প্রজাতি, যার নাম দেওয়া হয়েছে CD4, তার সংখ্যা অত্যন্ত কমে যায় যে কারণে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় 

     

    গ্যালো বললেন এটা ভাইরাস জনিত ক্যানসার না হয়ে যায় না, কারণ অনেক ক্যানসারেও ক্ষয় দেখা যায়, প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, নানা রকম ইনফেকশন হয় তিনি কয়েকজন এইডস রোগীর দেহে কোনও রেট্রোভাইরাস আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলেন কয়েকজনের মধ্যে পেলেন, সবার মধ্যে পেলেন না 

     

    সাগরপারে ফ্রান্সে যদিও তখন এইডস রোগটির তেমন প্রকোপ ছড়ায়নি, মন্তেনিয়েও ভাবলেন দেখি তো কোনোও ভাইরাস পাই কিনা তিনি যে সব গোষ্ঠীর মধ্যে এইডসের প্রকোপ বেশি, তাদের মধ্যে লিম্ফ্নোড ফুলে আছে এমন কয়েকজনের লিম্ফ্নোড কালচার করলেন যুক্তি ছিল সব এইডস রোগীরই পুরোপুরি ক্ষয় হওয়ার আগে এরকম একটা অবস্থা আসে কালচার করে ভাইরাস পেলেনও, কিন্তু অনেক কাঠ খড় পোড়ানোর পর যা বুঝলেন তা হল, এই ভাইরাসটি গ্যালোর আবিষ্কৃত ভাইরাস থেকে আলাদা কোভিডের সূত্রে এখন আমরা সবাই জেনে গেছি যে, অ্যান্টিবডি দিয়ে ভাইরাস তথা রোগ নির্ণয় করা যায় - একটি ভাইরাসের জন্যে নিৰ্দিষ্ট অ্যান্টিবডি অন্য ভাইরাস নির্ণয় করবে না মন্তেনিয়ে দেখলেন যে তাঁর নব আবিষ্কৃত ভাইরাসটির অ্যান্টিবডি কিন্তু গ্যালোর ভাইরাস গুলিকে চিনতে পারছে না মন্তেনিয়ে এই ভাইরাসটির নাম দিলেন Lymphadenoma Associated Virus (LAF) যদিও তাঁর এই সংক্রান্ত প্রথম প্রকাশনাতে তিনি বললেন যে, এইডসের এর ঠিক কী ভূমিকা, তা দেখা দরকার, তিনি সে বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে লাগলেন

     

    দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্ব

    এটা 1983 সালের ঘটনা এই আবিষ্কারের কথা যখন মন্তেনিয়ে আমেরিকায় এক বিখ্যাত কনফারেন্সে বললেন, গ্যালো অবজ্ঞা করে উড়িয়ে দিলেন বললেন, তোমার ভাইরাস আমায় পাঠাও দেখি, তারপর বিশ্বাস করব মন্তেনিয়ে সহযোগী বিজ্ঞানীকে অবিশ্বাস না করে পাঠিয়ে দিলেন ভাইরাস পরের বছর বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে আমেরিকা সরকার প্রচার করল যে, এইডস একটি ভাইরাস দ্বারা হয় সেই ভাইরাস HTLV গোত্রের একটি নতুন সদস্য, HTLVIII,  আবিষ্কর্তা বব গ্যালো, এবং এই ভাইরাস কারওর শরীরে আছে কিনা, তা নির্ণয় করার একটি টেস্টও তিনি আবিষ্কার করেছেন মন্তেনিয়ে এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না বললেন এক বছর আগেই আমি এটা আবিষ্কার করেছি, আর টেস্ট তো আমিও বানিয়েছি করোনা ভাইরাসের বাইরে যেমন কাঁটার মতো স্পাইক প্রোটিন থাকে, উনি LAV -র বাইরে এই রকম একটি প্রোটিন পেয়েছেন, যার নাম p24 যে সব মানুষের দেহে LAV পাওয়া যায়, তাদের শরীরে p24 -এর অ্যান্টিবডি দেখতে পাওয়া যায়- উনি একটি টেস্ট বানিয়েছেন, যা p24 নির্ণয় করে অপর পক্ষে গ্যালো যে টেস্ট বানিয়েছেন, তাতে তাঁর HTLVIII -র যে নিজস্ব রিভার্স ট্রানস্ক্রিপ্টেজ এনজাইম আছে, তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি নির্ণয় করা যায়

     

    অর্থমনর্থম; আন্তর্জাতিক বিতর্ক

    এই যে বিতর্ক বা দ্বন্দ্ব, এটা কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে গেল দ্বন্দ্বের দু’টো স্পষ্ট কারণ: একটা হল সম্মানের- কে আবিষ্কর্তা ? দ্বিতীয়টি বাণিজ্যিক প্রথমের খেতাবের সূত্রে পেটেন্ট কে পাবে টেস্ট বিক্রি হলে রয়্যালটি কার? সম্মানের প্রশ্ন দু’টি রাষ্ট্রেরও

     

    মন্তেনিয়ে ফ্রান্স সরকারের অধীন পাস্তুর ইনস্টিটিউটের কর্মী গ্যালো মার্কিন সরকারের ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট বা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথের কর্মী বিবাদের সূত্রে তদন্ত শুরু হতে তা কিন্তু গ্যালোর পক্ষে গেল না শোনা যায় তিনি স্বীকার করেছিলেন যে মুখে মন্তেনিয়ের আবিষ্কারকে তুচ্ছ করলেও ওঁর পাঠানো ভাইরাস স্যাম্পলই গ্যালোকে তাড়াতাড়ি টেস্ট কিট বানাতে সাহায্য করেছিল সেই টেস্ট কিট ব্যবহার করে তিনি নানা এইডস রোগীর শরীরে HTLVIII -র উপস্থিতি দেখেছেন তদন্তের স্বার্থে পরীক্ষা করে জানা গেল LAV এবং HTLVIII অভিন্ন তো বটেই, গ্যালোর পরীক্ষিত স্যাম্পলটি মন্তেনিয়ের পাঠানো স্যাম্পলটি ছাড়া আর কিছু নয়

     

    কিন্তু এই চাপানউতর চলতে দিলে তো এইডসের টেস্ট হবে না এইডস ভাইরাস কিনা জানা গেছে, কিন্তু সেই সব তথ্য ব্যবহার করা যাবে না ওষুধ বানাতে মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না তাই দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যথাক্রমে রোনাল্ড রেগান ও ফ্রঁসোয়া মিতেরঁ বৈঠকে বসে দু’জনকে যুগ্ম -আবিষ্কারকের আখ্যা দিতে সিদ্ধান্ত নিলেন টেস্ট কিট বিক্রির রয়্যালটি তিন ভাগ হল- দুই দেশের দুই ভাগ ছাড়াও তৃতীয় ভাগ আফ্রিকাতে এইডস নিয়ন্ত্রণ করার কাজে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল দুই বিজ্ঞানীকে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা মিটিয়ে নিতে পরামর্শ দেওয়া হল 1987 সালেই আবার দু’জনকে একসঙ্গে প্রবন্ধ লিখতে দেখা গেল

     

    গ্যালোর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে যে সমস্ত তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, তার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক ভ্রষ্টাচারের (scientific misconduct) অভিযোগ আনা হয় 1993 সালে ভ্রষ্টাচারের সংজ্ঞা বদলে যাওয়ায় গ্যালো অব্যাহতি পেয়ে যান

     

    HIV নামকরণ ও এইডস

    এই প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা বলা দরকার - 1984 সালেই মার্কিন বিজ্ঞানী লেভি (Levy)-ও ক্যালিফোর্নিয়াতে অনেক এইডস রোগীর দেহে একটিই ভাইরাস পেলেন, তিনি যার নাম দিয়েছিলেন Lymphocytopathic Retrovirus পরবর্তী কালে দেখা গেল এই ভাইরাসটি LAV বা HTLVIII-র সঙ্গে অভিন্ন আরও নানা তথ্য দেখাল যে, ভাইরাসটি কিন্তু রেট্রোভাইরাস হলেও লিউকিমিয়া সংক্রান্ত ভাইরাসগুলি অর্থাৎ HTLV I বা II -র সঙ্গে প্রজাতিগত ভাবে কোনও মিল নেই তখন সর্বসম্মতিক্রমে এইডস সৃষ্টিকারী ভাইরাসের নাম দেওয়া হল Human Immunodeficiency Virus (HIV) গ্যালো আফ্রিকার এইডস রোগীদের মধ্যে পেলেন HIV -র একটি নতুন গোষ্ঠী, যার তিনি নাম দিলেন HIV2

     

    নোবেল এবং হতাশা 

    2008 সালে নোবেল কমিটি শারীরবিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের পুরষ্কার দু’ভাগে ভাগ করে দেন - একভাগ পান জার্মান বিজ্ঞানী হারাল্ড জু হাউসান (Harald zur Hausen) জরায়ুমুখ ক্যানসারের কারণ human Papilloma Virus আবিষ্কারের জন্য বাকি অর্ধেকের যুগ্মবিজয়ী ঘোষিত হন মন্তেনিয়ে এবং না, গ্যালো নন, মন্তেনিয়ের এক কালের ছাত্রী এবং সহকর্মী ফ্রান্সোয়া বারে সিনুসি (Françoise Barré-Sinoussi) গ্যালোর নাম বাদ পড়ায় হতাশ হলেন আমেরিকান ভাইরাসবিদরা- আতঙ্কিত হলেন এই ভেবে যে, বিবাদ তাহলে আরও কতদিন চলবে? মন্তেনিয়ে অবশ্য গ্যালোর নাম বাদ পড়াতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন, এবং পরিষ্কার ভাবে বলেছেন যে, গ্যালো T কোষে আক্রমণকারী ভাইরাস গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতিগুলি আবিষ্কার না করলে সম্ভব হত না HIV আবিষ্কার এবং গ্যালোই প্রথম সরাসরি দেখিয়েছেন যে, এইডস রোগী মাত্রেই HIV সংক্রামিত

     

    বিতর্কের এপারে মন্তেনিয়ে

    2009 সালে মন্তেনিয়ে দু’টি অদ্ভুত প্রবন্ধ প্রকাশ করেন ডিএনএ, আরএনএ ইত্যাদি থেকে তিনি তড়িৎচুম্বকীয় সিগনালের অস্তিত্ব দেখেছেন তাঁর বক্তব্য ছিল যে, ডিএনএ, আরএনএ ইত্যাদিকে ধাপে ধাপে পাতলা (dilute ) করলে এই অণুগুলির চার পাশে যে জলের অণুর খাঁচা থাকে, তা শূন্য, তবু শূন্য নয় সেখানে ডিএনএ, আরএনএ ইত্যাদির প্রাক্তন অস্তিত্বের চিহ্নবাহী সিগনাল থেকে যায়

     

    ঘোরতর আপত্তি ওঠে এই সব কারণে:

        1) যা বলেছেন তার সাথে কোনো পরীক্ষিত প্রমাণ ছিল না

    2) যে পত্রিকায় প্রবন্ধগুলি বেরোয়, তিনি তার সম্পাদক এবং এই পত্রিকায় কোনও বিজ্ঞানীকে দিয়ে রিভিউ করানো হয় না

     

    আপত্তি ওঠার পর মন্তেনিয়ে নাকি আর একটি আপত্তিকর মন্তব্য করেন- ‘আমি নোবেল জয়ী, আমি যা বলি সেটাই ঠিক’ বলাই বাহুল্য, ওনার ‘ঠিক’-কে অন্য বৈজ্ঞানিকরা ঠিক হিসেবে নেননি অপবিজ্ঞানের প্রচারক হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে কলঙ্ক রটে

     

    আরও পড়ুন: ভাইরাসের মিউটেশন স্বাভাবিক ধর্ম, ভাল-মন্দ দু’দিকেই যেতে পারে

     

    নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী অপবিজ্ঞান প্রচার করলে অবশ্যই মানব সমাজের প্রভূত ক্ষতি হতে পারে, কারণ পৃথিবীতে এখনও প্রচুর লোক আছে, যাদের ব্যবসাই হল অপবিজ্ঞান বেচে খাওয়া এই অপবাদটি মন্তেনিয়ের নামেও লেগেছিল 2012 সালে অটিজম ওয়ান নামে একটি গোষ্ঠীর কনফারেন্সে তাঁকে দেখা যায় এই কনফারেন্সটি সম্বন্ধে বলা হয় যে, এখানে অটিস্টিক বাচ্চাদের বাবা মায়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অপবিজ্ঞান বেচা হয় উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ভ্যাকসিন নেওয়ার কারণে অটিজম হয় এই ধারণাটি ছড়িয়ে কেউ ভ্যাকসিনের বিকল্প বেচে, কেউ বা আইনি পরামর্শ বেচে, কী করে বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিনকে এড়ানো যায় মন্তেনিয়ে এখানে বলেছিলেন যে, অটিজম, পার্কিনসন্স ডিজিজ ইত্যাদি দুরারোগ্য রোগ ঘটে ব্যাকটেরিয়া থেকে নির্গত ডিএনএ সিগনাল থেকে- এবং তাঁর নবনির্মিত সংস্থা এই নতুন তথ্যের ভিত্তিতে অভিনব চিকিৎসা উদ্ভাবন করছে 

     

    দু’বছর আগেই কোভিড সম্বন্ধে বলেন SARS-CoV2 ভাইরাসটি আসলে মানুষের বানানো- এইডসের ভ্যাকসিন বানাতে গিয়ে গণ্ডগোলের ফলে এই রকম ভাইরাস উৎপন্ন হয়েছে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীরা অবশ্যই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীকে উদ্ধৃত করার সুযোগ ছাড়েনি, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও পরীক্ষাই প্রমাণ করতে পারেনি SARS-CoV2 ভাইরাসটি মানুষের বানানো এ ছাড়া তিনি বলেন, ভ্যাকসিন নিলেই নাকি শরীরের মধ্যে দিয়ে নানা নতুন প্রজাতির SARS-CoV2  উৎপন্ন হবে, যা আর কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, SARS-CoV2 -র কিছু ভ্যারিয়েন্ট কিন্তু ভ্যাকসিন উৎপাদনের আগেই হয়েছে - যা মন্তেনিয়েকে আবারও ভ্রান্ত প্রমাণ করে

     

    দেখা যাক ভাবীকাল মন্তেনিয়ের কী বিচার করে, তাঁকে কী ভাবে মনে রাখে 

     

    (ড: সুস্মিতা ঘোষ ডায়াগনোরাইট-এর প্রতিষ্ঠাত্রী এবং জৈব-রসায়নবিদ হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের প্রাক্তন পোস্ট ডক্টরাল ফেলো সুস্মিতার ডায়াগনোরাইট একটি সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত স্টার্ট-আপ সংস্থা, যার লক্ষ্য সকলের জন্য সুলভে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ডায়গনস্টিক্স)

     


    সুস্মিতা ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    Covid-19 টেস্ট নিয়ে যা হচ্ছে তা কিন্তু কতটা বিজ্ঞানসম্মত তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

    পালস এবং অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গেলেই সাবধান হওয়া জরুরি।

    আত্মনির্ভর ভারত রাজনৈতিক স্লোগান মাত্র, বাস্তব চিত্র বলে দেশের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিদেশ থেকে আমদান

    আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আত্মচরিত: একটি বিস্মৃত বই যা আজও প্রাসঙ্গিক

    তিনটির মধ্যে একটি ভ্যাকসিন নিয়ে বহু প্রশ্ন

    স্মল পক্স বা গুটি বসন্তের টিকা 1970-এর আগে নেওয়া থাকলে মাঙ্কি পক্সের ভয় নেই।

    পরলোকে লুচ মন্তেনিয়ে: নোবেলজয়ীর বিতর্কিত বিজ্ঞান-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested