গত বছর লকডাউনে যখন দেশ স্তব্ধ, তখন নরেন্দ্র মোদী সরকার দূরদর্শনকে বলল দেশবাসীকে গত নয়ের দশকের দু’টি জনপ্রিয় ধারাবাহিক মহাভারত আর রামায়ণ দেখাতে। বিভাগীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভরেকর বলেছিলেন, সাধারণ মানুষের দাবি মেনেই নাকি এই সিদ্ধান্ত। অচিরেই কিন্তু দেখা গেল, এই পুনঃপ্রচার নস্টালজিয়া ছাড়া আরও অনেক কিছু উস্কে দিল!
স্বঘোষিত দক্ষিণপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট, মুম্বইয়ের রমেশ সোলাঙ্কি দাবি করলেন ওই সম্প্রচারের ফলে "হিন্দু দেব-দেবীদের অসম্মান করা সোশাল মিডিয়া পেজ এবং হ্যান্ডেলের সুনামি দেখা গেল।’ তাই ঈশ্বরকে রক্ষা করার জন্য তাঁরা আইন এবং ইন্টারনেটের দ্বারস্থ হলেন! তাঁর মতো আরও 10 জন উদ্বিগ্ন হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক মিলে 2020 সালের মে মাসে গঠন করলেন ‘হিন্দু আইটিসেল'।
মিডিয়া 1: হিন্দু আইটি সেলের টুইটারের স্ক্রিনশট
https://twitter.com/hinduitcell?lang=en
হিন্দু আইটি সেলের টুইটারে ঘোষণা করা হয়েছিল, ‘হিন্দু বিদ্বেষীদের রেহাই দেওয়া হবে না। আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে তাদের বিরুদ্ধে। যদি আপনি এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কমপ্লেন করে তাদের আজীবনের জন্য একটা শিক্ষা দিতে চান তবে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।' তাদের আবেদন, ‘আপনি ক্ষমতাশীল কেউ হন বা সাধারণ কেউ, সেটা বড় কথা নয়, আপনি যদি ধর্মের জন্য অতিরিক্ত কিছু করতে চান তবে আপনি আমাদের সদস্য হতে পারেন।'
হিন্দু আইটি সেলের সদস্য হতে গেলে মতাদর্শগত ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে সংগঠনের প্রতি। সদস্য হতে গেলে তাকে অন্তত একটা কমপ্লেন বা কেস ফাইল করতে হবে ‘হিন্দু ধর্ম রক্ষার্থে’। অনলাইনে কোনওরকম গালিগালাজ ব্যবহার করা যাবে না, দক্ষিণপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী কোনও মানুষকে টার্গেট করা যাবে না।
এদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা সোশাল মিডিয়ায় হিন্দু বিরোধী কোনও মন্তব্য করেছে তাদের নামে পুলিশের কাছে কমপ্লেন করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ানো। এই কাজটির জন্য তারা আইনজীবীদের এবং ‘সাইবার স্বেচ্ছাসেবীদের’ সাহায্য নেয়।
এই বিবরণ অনুযায়ী আইটি সেলকে তেমন মন্দ কিছু মনে হবে না, তারা যা করে ভারতীয় আইন মেনেই করে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্য রকম। তারা আইনি পদক্ষেপের পাশপাশি তারা তাদের টার্গেটকে ট্রোল করতে শুরু করে। হয়রানি, হুমকির স্বীকার হতে হয় আইটি সেলের টার্গেটদের, তাদের সমস্ত তথ্য যেমন নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি সব ফাঁস করে দেওয়া হয় সোশাল মিডিয়ায়।
হিন্দু আইটি সেল তাদের সাইবার স্বেচ্ছাসেবীদের ব্যবহার করে আগামী টার্গেটকে খুঁজে বের করে। টার্গেটকে যারা ব্যক্তিগত ভাবে বা কাজের সূত্রে জানে বা চেনে এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে আইটি সেল যোগাযোগ করে হয় সামনাসামনি নয়তো ফোনে। তাদের মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে, বা ট্রোল করে বাধ্য করা হয় টার্গেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
আইটি সেলের প্রতিষ্ঠাতারা ব্যক্তিগতভাবে সাইবার ট্রোলিং থেকে দূরত্ব বজায় রাখলেও যে অনলাইন চক্রের সঙ্গে তারা যুক্ত সেটি এই ধরনের সাইবার ট্রোলিংকে শুধু প্রশ্রয়ই দেয়না, টার্গেটকে নিরন্তর আক্রমণ করে যায়।
শেষ পর্যন্ত যদি পুলিশও বাধ্য হয় আইটি সেলের করা কমপ্লেন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে, যেমনটা বহু কেসেই হয়েছে। একবার টার্গেটকে পুলিশি কেসে মামলায় ফাঁসিয়ে দিলে আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য বছরের পর তার ভোগান্তি হতে পারে।
26 বছর বয়সী দিল্লির সাংবাদিক সুস্মিতা সিনহার যেমন হয়েছে।
2020-র আগস্টে হিন্দুদের তিজ উৎসবের আগে তিনি তাঁর ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও দিয়েছিলেন। সুস্মিতা বলেছিলেন, উত্তর ভারতে এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় উৎসব যেখানে মহিলারা তাদের স্বামীদের দীর্ঘায়ু কামনা করে এই ব্রত পালনের সময় উপোস করে। তিনি দিল্লির এক প্রকাশক কমল পুরকায়স্থর হরতালিকাতিজ ব্রত কথা বইটি ধরে তিনি ভিডিওতে বলেন, ‘এই ব্রতটির সময় মহিলারা জল অবধি খেতে পারেন না। আমাকে গালিগালাজ করলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি এই উৎসবটা নারীবিদ্বেষী এবং তাদের অধিকার খর্ব করে। তবে আমি কিছু বলব না, এই বইটি থেকে একটি পাতা পড়ব শুধু বাকিটা আপনারা নিজেরাই ঠিক করে নেবেন।' এরপর তিনি সেই বইটি থেকে একটি পাতা পড়েন, যেখানে লেখা ছিল, যদি কোনও মহিলা তিজে উপোস না করে, তবে সে গরিব, অচ্ছুৎ, ঝগড়ুটে, কৃপণ এবং অসুখী হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, সেই মহিলা একটি পশু অবধি হয়ে যেতে পারে, তিজের দিন সে কী খাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। এটি পড়ার পর তিনি দর্শকদের বলেন বিচার করতে যে, এই ব্রতটি নারীবিদ্বেষী কিনা। সঙ্গে এও বলেন যে বইটি সম্পূর্ণভাবে মূল্যহীন নাকি টয়লেট পেপার হিসেবে ব্যবহারযোগ্য তা ভেবে দেখা হোক। সুস্মিতা জানান, ‘এই ভাবেই আমি আমার প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছি বইটা সম্পর্কে যে বই দাবি করে একজন মহিলা যদি তার স্বামীর মঙ্গলার্থে ব্রত পালন না করে, তাহলে সে নাকি পশু হয়ে যাবে!’ কিন্তু সুস্মিতার এই 2 মিনিট 20 সেকেন্ডের ভিডিওর মাত্র 17 সেকেন্ড কেটে আইটি সেল প্রচার করে ভাইরাল করেছে যেখানে তিনি বইটিকে টয়লেট পেপার হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলেছেন। এবং এরপরই তাঁকে ট্রোলিং-এর শিকার হতে হয়। মাত্র কিছু সময়ের মধ্যে এভাবেই সুস্মিতা আইটি সেলের স্বেচ্ছাসেবকদের একজন টার্গেটে পরিণত হয়।
মিডিয়া 2: সুস্মিতা সিনহার ভিডিও
https://www.instagram.com/tv/CEHNYCen81G/?igshid=19y58igzvzsjc
হিন্দু আইটি সেল সুস্মিতা সিনহার ভিডিওটি 2020-র 26 আগস্ট তাদের টেলিগ্রামে শেয়ার করে, যেখানে তাদের ফলোয়ার সংখ্যা 3.29 হাজার। এবং সকল ফলোয়ারদের অনুরোধ করা হয় ওই 17 সেকেন্ডের ভিডিওটি ছড়িয়ে দিতে। ইতিমধ্যে ভিডিওটির 204832 ভিউজ হয়েছে, সঙ্গে 16.9 হাজার মন্তব্য। সদস্যদের অনুরোধ করা হয় সুস্মিতার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কমপ্লেন করার জন্য। যারা এগিয়ে এসে ওঁর বিরুদ্ধে মামলা এবং কমপ্লেন রুজু করেন তাদের ‘যোদ্ধা’ হিসেবে তকমা দেওয়া হয় টুইটারে।
মিডিয়া 3: যারা পুলিশের কাছে কমপ্লেন করছেন তাদের সংবর্ধনা দিচ্ছে হিন্দু আইটি সেল
https://twitter.com/HinduITCell/status/1300289969076858881?s=20
দক্ষিণপন্থীরা আইটি সেল নির্মিত টুইট এবং সুস্মিতার বিরুদ্ধে আর্টিকেলগুলো নিয়ে তা আরও প্রচার করতে থাকে। শুধু তাই নয়, তাঁর ছবি, সম্পর্ক, ঠিকানা ইত্যাদিও ছড়িয়ে দিতে থাকে সোশাল মিডিয়ায়। একটি হিন্দি টিভি চ্যানেলে এক ঘণ্টার একটা তর্ক বিতর্ক অনুষ্ঠানও করে ফেলল সুস্মিতার ভিডিওর ভাইরাল হওয়া অংশটুকু নিয়ে।
মিডিয়া 4: সিনহার টুইট এবং তাঁর উত্তর
https://twitter.com/Sushmitasinhaa/status/1298887115678179330?s=20
এই ট্রোলিং বর্তমানে বেড়েই চলেছে। সুস্মিতাকে ধর্ষণ, খুন, অ্যাসিড অ্যাটাকের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাঁর পরিবারকে সামাজিক ভাবে বয়কটও করা হয়েছে।
মিডিয়া 5: মনমোহনের একটা ভিডিও যেখানে তিনি সুস্মিতাকে ট্রোল করছেন তা যুক্ত করা হয়েছে
সুস্মিতা জানান, ‘হিন্দু আইটি সেলের সদস্যরা আমার বন্ধুকে রীতিমত জোর করেছে আমার ঠিকানা প্রকাশ করার জন্য। আমি এতটাই আশঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম যে আমাকে দিল্লির বাড়ি ছাড়তে হল।'
মিডিয়া 6: হিন্দু আইটি সেল সুস্মিতা সিনহার তথ্য জানতে চাইছে
https://twitter.com/HinduITCell/status/1298347469357506561?s=20
আইটি সেল সুস্মিতার বিরুদ্ধে যে প্রচারটা চালাচ্ছিল, তাকে সাপোর্ট করেন বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র সম্বিত পাত্র। শুধু তাই নয় তিনি টুইটারে সুস্মিতাকে অ্যারেস্ট করার জন্য একটি হ্যাশট্যাগ চালু করেন। সুস্মিতা জানান, ‘ওই টুইটটির পর আমি রীতিমত ভয় পেয়ে যাই। মনে হচ্ছিল আমাকে বোধহয় এবার সত্যি অ্যারেস্ট করা হবে। ভীষণ একা হয়ে পড়েছিলাম।'
আরও পড়ুন: বেচারাম প্রধানমন্ত্রী রাজ্যে শিল্প-স্বপ্নের অবতার
এই ট্রোলিংটা চলতেই থাকে যতদিন না আইটিসেল তাদের পরবর্তী শিকারকে খুঁজে পায়। 7সেপ্টেম্বর ‘নাস্তিক প্রজাতন্ত্র গ্রুপের’ আর্মিন নভাবিকে টার্গেট করে আইটি সেল কারণ সে সকলের সামনে নাস্তিক হওয়ার কথা স্বীকার করেছিল। নভাবি একটি টুইট করেছিল যেখানে সে একজন হিন্দু দেবতার ক্যারিকেচার এঁকে যৌন ইঙ্গিতময় একটি বর্ণনা দিয়েছিল। এরপর একই ভাবে তার বিরুদ্ধে কমপ্লেন ফাইল করা হয়। যদিও সুস্মিতার বিরুদ্ধে যে কমপ্লেন করা হয়েছিল তার জল বেশি দূর গড়ায়নি। ছয় মাস অবধি কোনও এফআইআর করা হয়নি। কিন্তু তিনি একটি ফোন কলে জানান, "সেই ঘটনাটা আমার আত্মবিশ্বাসকে একদম চুরমার করে দিয়েছে। আমি আজও আতঙ্কিত হই ওই ঘটনার কথাভাবলে। সারাজীবন শিহরিত হব ঘটনাটা মনে পড়লেই।’
সুস্মিতা একা নয়, মে 2020 থেকে আইটিসেল প্রায় 500 কমপ্লেন ফাইল করেছে। এটি এখন ভারতীয় ট্রাস্ট অ্যাক্টের অধীনে একটি সংস্থা হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে। এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য 11 হলেও, বর্তমান সদস্য সংখ্যা 200 জন ছাড়িয়ে গেছে। তাদের টার্গেটের মধ্যে কখনও কোনও আইনজীবী পড়েছে তো কখনও সাংবাদিক বা সমাজকর্মী।
হিন্দু আইটি সেলের প্রতিষ্ঠাতারা হচ্ছেন রমেশ সোলাঙ্কি এবং বিকাশ পান্ডে। রমেশ নিজেকে তাঁর টুইটারে পরিচয় দিয়েছেন ‘একজন গর্বিত হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসেবে।' এছাড়া তিনি আরও একটি ব্লগ চালান, ভারতীয় রাজপুত নামে, যার মূল বক্তব্য হচ্ছে, ‘খুশির মূল মন্ত্র হচ্ছে স্বাধীনতা, এবং স্বাধীনতার মন্ত্র হচ্ছে সাহস।'
মিডিয়া 7: রমেশ সোলাঙ্কির ছবি
https://www.instagram.com/p/CDntoi-A1JF/?utm_source=ig_web_copy_link
রমেশ সোলাঙ্কি 1998 সালে শিবসেনায় যোগ দেয় এবং তার আইটি সেলের সঙ্গে বহু বছর যুক্ত। 2019 সালে তিনি শিবসেনা থেকে বেরিয়ে আসেন, যখন শিবসেনা তাদের বহুকালীন মতাদর্শগত বিরোধীপক্ষ কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধে মহারাষ্ট্রে সরকার গঠনের জন্য। তিনি বিকাশের সঙ্গে একটি ইন্টারভিউতে জানান হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্নের কথা। তিনি টুইটারে শিবসেনা থেকে কেন বেরিয়ে এসেছেন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘ইঁদুররাই প্রথমে ডুবন্ত জাহাজ থেকে ঝাঁপ মারে।‘ বিকাশ হচ্ছেন উত্তর প্রদেশের গোরখপুরের বিজেপির আইটি সেলের কর্মী। যিনি 2014 সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়ে সোশাল মিডিয়ায় প্রচার চালিয়েছিলেন। 17 নভেম্বর 2020-তে তিনি মোদীর সঙ্গে তাঁর ছেলের একটি ছবি পোস্ট করেন ফেসবুকে। তিনি মাঝে মধ্যেই সোশাল মিডিয়ায় তাঁর সঙ্গে মোদী এবং বিজেপির বিভিন্ন মন্ত্রীর যে কতটা সুসম্পর্ক আছে তা বুঝিয়ে দেন। বিজেপির আইটি সেল ছাড়াও তিনি টুইটারে একটি পেজ চালান মোদীকে সাপোর্ট করে।
মিডিয়া 8: মোদীর সঙ্গে বিকাশের ছবি
11147879_10153369518865560_7331841744670852205_n.jpg (624×624) (fbcdn.net)
একটি অনলাইন ইন্টারভিউ তে রমেশ জানিয়েছিলেন গোটা বিষয়টা কিভাবে শুরু হয়েছিল। তিনি জানান ‘লকডাউনের সময় রামায়ণ মহাভারত রিটেলিকাস্টের দরুন হিন্দু দেব-দেবীদের প্রতি অনলাইনে ভীষণ রকম অশ্রদ্ধা দেখা যাচ্ছিল নানা পোস্টে। এরপর বিকাশ আমায় ফোন করে এবং জানায় আমাদের এর বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে হবে।' রমেশ এও দাবি করেন যে, ‘আমি জানি মানুষ আমার থেকে অনেক বেশি কিছু আশা করে, কিন্তু আমারও কিছু লিমিটেশন আছে। আমি ইতিমধ্যেই প্রায় 100 কমপ্লেন ফাইল করেছি তাদের সম্পর্কে যারা আমার ধর্মকে অশ্রদ্ধা করে তার বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছে। এরপর আমি আর বিকাশ ঠিক করি যে সমমনস্ক মানুষদের একত্রে আনতে হবে আমাদের ধর্মকে বাঁচাতে গেলে। এভাবেই হিন্দু আইটি সেল তৈরি হয়।'
রমেশ বিভিন্ন টিকটক ব্যবহারকারী, নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়া এবং অভিনেতাদের নামে এফআইআর করেন যারা কোনও রকম এমন কন্টেন্ট বানিয়েছে, যা তাঁদের বিচারে হিন্দু বিরোধী। তিনি নেটফ্লিক্সের উদ্দেশে জানান, ‘আমার টার্গেট ছিল একদিনে 2500 টুইট করে বয়কট নেটফ্লিক্সকে ট্রেন্ড করে তুলতে। আমি সকাল 8টায় শুরু করি এবং তার মাত্র একঘণ্টার মধ্যে 70-80 হাজার টুইট হয়। এরপর গোটা বিশ্বে এটা ট্রেন্ডিং হয়ে যায়।‘
এই নেটওয়ার্ক কীভাবে কাজ করে?
রমেশ জানান যে তাঁদের এই নেটওয়ার্ক কীভাবে কাজ করে। তিনি বলেন, ‘যখনই কেউ হিন্দু বিরোধী কিছু পোস্ট দেখে তখনই আমাদের ট্যাগ করে। এরপর বিষয়টাকে আমাদের কোর টিম দেখে এবং রিসার্চ করে। আমাদের রিসার্চ পরবর্তীকালে আমরা যখন ঠিক করে নিই যে কী করা হবে, তখন সেই পোস্টকর্তার সমস্ত ডিটেইল চাওয়া হয় সোশাল মিডিয়াতে। এরপর আমাদের আইনজীবী পরবর্তী পদক্ষেপ নেন। তাঁরা আলোচনা করে পোস্টকর্তার বিরুদ্ধে কমপ্লেনের ড্রাফট তৈরি করে আমাদের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করেন। আমাদের সদস্যরা তখন গিয়ে কমপ্লেন ফাইল করে থানায়। পোস্টকর্তার সমস্ত কন্টাক্ট ডিটেল আমরা তাদের সঙ্গে শেয়ার করি। এরপর 20-30 সদস্য অনলাইনে বা সরাসরি থানায় গিয়ে কমপ্লেন করে। আমরা তখন সেই কমপ্লেনের স্ক্রিনশট টুইটারে শেয়ার করি এবং আমাদের ফলোয়ারদের আবেদন করি তারা যেন এই সদস্যদেরও ফলো করতে শুরু করে টুইটারে।'
মিডিয়া 9: টিমের সদস্যদের ওয়েবিনারের স্ক্রিনশট
https://twitter.com/HinduITCell/status/1287441933548232710?s=20
এরপর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। রমেশ বলেন, ‘সাইবার ক্রাইম ওয়েবসাইট থেকে অভিযোগ পৌঁছয় স্থানীয় থানায়। তখন পুলিশ আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের জবানবন্দি দেওয়ার জন্য ডাকে। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা এফআইআর গ্রহণ করার জন্য পুলিশকে অনুরোধ করে। তিনি আরও জানালেন, প্রথম ট্যুইট থেকে এফআইআর করা পর্যন্ত আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখে না। অভিযুক্ত মানুষটিকে গ্রেপ্তার করা হবে এবং তাকে জেলে পাঠানো হবে, এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই।'
হিন্দু আইটি সেলের শিকার যারা
মধ্যযুগের মারাঠা শাসক শিবাজির একটি প্রস্তাবিত মূর্তি নিয়ে অনেক আগে একটা ভিডিও পোস্ট করায় কৌতুক শিল্পী অগ্রিমা জোসুয়াকে গত বছরের জুলাই মাসে সোশাল মিডিয়ায় তীব্র বিদ্রুপ করা হয়৷ প্রসঙ্গত, হিন্দু আইটিসেল এই ভিডিওটিকে সামনে এনেছিল।
মিডিয়া 10: অগ্রিমা জোসুয়ার স্ক্রিনশট
https://twitter.com/HinduITCell/status/1287441933548232710?s=20
কাঠুয়া কান্ডে নির্যাতিতা এবং নিহত শিশুটির হয়ে সওয়াল করে প্রচারের আলোয় আসা আইনজীবী দীপিকা রাজাওয়াতকে গত বছরের অক্টোবরেই ‘হিন্দু-বিরোধী’ বলে দেগে দেয় এই আইটি সেল। ধর্ষণ নিয়ে তাঁর তৈরি করা সচেতনতামূলক একটা পোস্টারের অর্থকে বিকৃত করে দাবিকরা হয় যে, পোস্টারে হিন্দু উৎসব নবরাত্রির অবমাননা করা হয়েছে। 21 অক্টোবর রাতে দীপিকার বাড়ির সামনে একদল লোক ভিড় জমালে তিনি সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে সকলকে সাহায্য করার আবেদন জানান। আইটি সেলের নির্দেশনায় সেই ভিড় থেকে আওয়াজ ওঠে, ‘দীপিকা, তোমার কবর খোঁড়া হবে।'
মিডিয়া 11: দীপিকা রাজাওয়াতকে ট্রোল করার স্ক্রিনশট
https://twitter.com/HinduITCell/status/1318849052910383104?s=20
সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে, দীপিকা জানান, ‘আমি এটা প্রমাণ সহ বলতে চাই যে, যে স্থানীয় পুলিশ আধিকারিক আমার বিরুদ্ধে এফআইআর গ্রহণ করেছিলেন, তিনি জানিয়েছেন, তিনি আইটি সেলের চাপে পড়ে এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন।' আমরা নিরপেক্ষভাবে তাঁর এই দাবির সত্যাসত্য বিচার করে দেখিনি।
দিল্লির সাংবাদিক সাকেত কুমার, যিনি দলিতদের সমস্যা নিয়ে বারবার সরব হয়েছেন, তাঁকেও হিন্দু আইটি সেলের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি হিন্দু দেবতা হনুমান সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন।
সাকেত জানিয়েছেন, ‘এই পরিকল্পিত ঘৃণা-প্রচার এক সপ্তাহ ধরে চলেছিল।' তাঁর মতে, ‘এটা একটা দুঃস্বপ্নের থেকে কম কিছু নয়।' তিনি আরও জানালেন, ‘হিন্দু আইটি সেল শুধু আমাকেই আক্রমণ করেনি, আমার বান্ধবীকেও ওরা ছেড়ে দেয়নি। ওরা আমার কর্মস্থল, আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক সবকিছুর সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে এগুলোকে ওদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তোলে। আমি এখনও এই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি।'
আইটি সেলের কাছ থেকে ধর্ষণের হুমকি পাওয়ার পর অগ্রিমা, এই সম্মিলিত আক্রমণকে পঙ্গপালের ঝাঁকের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
কাউকে ট্রোল করা সোশাল মিডিয়ার যুগে খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু আগে থেকে কাউকে চিহ্নিত করে নিয়ে, পরিকল্পিত ভাবে আক্রমণ করার যে ছক হিন্দু আইটি সেল নিয়েছে, তা ভীতিপ্রদ।
হনুমান মনমোহন নামের এক ইউটিউবার আইটি সেলের দ্বারা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বিদ্রুপ করে ভিডিও তৈরি করেন।
মিডিয়া 12: হনুমান মনমোহনের ট্রোলের কিছু স্ক্রিনশট
https://www.youtube.com/watch?v=JrWjHQaL7YE
https://www.youtube.com/watch?v=G3C3lm3nGQg
https://www.youtube.com/watch?v=DqGyv6wEP_s
https://www.youtube.com/watch?v=BriRPNCN3Qo
https://www.youtube.com/watch?v=LnQO6mhzdno
এই সমস্ত ট্রোলিং কিংবা ঘৃণা-প্রচার বিষয়ে রমেশকে প্রশ্ন করা হলে, তিনি নিজে এবং তাঁর সংগঠনের এগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ উড়িয়ে দেন। পাশাপাশি জানিয়ে দেন, এগুলো ঠিক কাজই হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ট্রোলিং-এর নিন্দা করি কিন্তু উল্টোদিকের মানুষগুলোও ট্রোলিং করা হয়েছে, এই বলে সহানুভূতি কুড়োতে চায়।' অনিমার ঘটনাটি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘অনিমা খুব ভাল করেই জানেন তিনি কী কাজ করেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি রাজনীতি করার জন্য নিজেকে আক্রান্ত হিসাবে দেখাতে চাইছেন।'
রমেশকে নির্দিষ্টভাবে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আইটি সেলের এই সুনির্দিষ্ট কাউকে বেছে নিয়ে পরিকল্পিত ভাবে আক্রমণ চালানোকে তিনি কীভাবে দেখেন? এর উত্তরে তিনি জানান, ‘যখন অভিযুক্তিরা হিন্দুদের অবমাননা করেন, তখন যেন তারা এটাও মনে রাখেন যে, প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা প্রতিক্রিয়া আছে। সবাই গান্ধীর অহিংস পথে চলবেন, এমন নয়। কেউ কেউ ভগৎ সিং-এর সহিংস পথেও চলতে চাইবেন। কৌতুক শিল্পী মুনাওয়ার ফারুকি যেমন এই বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরেছেন!’
প্রসঙ্গত, জনৈক কৌতুক শিল্পী ফারুকিকে ইংরাজি নতুন বছরের প্রথম দিনে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি একটা অনুষ্ঠানে হিন্দু দেবতাদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। অথচ, সেই অনুষ্ঠানে তিনি কোনও বক্তব্যই রাখেননি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জামিনে মুক্ত হওয়ার আগে তিনি এক মাসাধিক কাল জেলবন্দি ছিলেন।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, রমেশ, ফারুকির গ্রেপ্তার হওয়ার আট মাস আগেই, 2020 সালের 8 এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
মিডিয়া: ফারুকিকে আক্রমণ করে রমেশ সোলাঙ্কির যে টুইট, তার লিঙ্ক
https://twitter.com/Rajput_Ramesh/status/1250186663222857728?s=20
রমেশ হুঁশিয়ারির সুরে বলেন, ‘যদি আপনি মনে করেন, কারও ভাবাবেগে আঘাত করবেন আর জনতা হাততালি দিয়ে আপনাকে সাধুবাদ জানাবে, তাহলে আপনি ভুল করবেন। আপনাকে স্মরণে রাখতে হবে, আপনি অন্য কাউকে অপমান বা বিদ্রুপ করলে, তার ফল মারাত্মক হবে। আপনি যদি আমাদের ঈশ্বরকে অপমান না করেন, তবে আপনাকে নিয়ে ট্রোল করা হবে না। খুবই সহজ ব্যাপারটা। যারা ট্রোল হচ্ছে বা আক্রমণের শিকার হচ্ছে, তারা তাদের কৃতকর্মের জন্যই হচ্ছে। এতে আমাদের কোনও ভূমিকা নেই। আমরা ভাল মানুষদের আক্রমণ করি না। কিন্তু যারা হিন্দু, হিন্দুত্ব এবং ভারতবর্ষকে আক্রমণ করে, আমরাও তাদের আক্রমণ করি।'
‘এটা তাদের দোষ। আমাদের কিছু করার নেই’— রমেশের কথায় এই ট্রোলিং এবং আইটি আক্রমণের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন ধরা পড়ে।
আইনি ব্যর্থতা
এই দেশে দশকের পর দশক বাকস্বাধীনতার অধিকার এবং কারও ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত না করার যে সাংবিধানিক বিধি— তা লঙ্ঘিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনও ব্যক্তি বা ধর্মের সম্মান রক্ষার কথা বলে জনপরিসরে বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে।
ভারতের সংবিধান দেশের নাগরিকদের যেমন বাকস্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে, তেমনই দেশের সরকারকে যুক্তিগ্রাহ্য কোনও কারণে এই বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করারও ক্ষমতা দিয়েছে। বাকস্বাধীনতায় সরকার প্রযুক্ত এই ‘ন্যায়সঙ্গত বিধিনিষেধ’ ভারতীয় দণ্ডবিধির দু'টি বিশেষ ধারার দ্বারা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। একটি হল, কারও ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা থেকে নাগরিককে বিরত রাখা। অপরটি হল, কেউ ধর্ম, বর্ণ অথবা ভাষার ভিত্তিতে বিদ্বেষ ছড়ালে, তাকে শাস্তিপ্রদান করা।
হিন্দু আইটি সেল মূলত ভারতীয় দণ্ডবিধির 153A এবং 295A এই দু'টি ধারায় কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। এমনকী কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগ আনার সময়ও তারা এই দু'টি ধারায় সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে।
আইনজীবী গৌতম ভাটিয়া ভারতীয় দণ্ডবিধির 295A ধারার ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এই আইন ব্লাসফেমি (ধর্মনিন্দামূলক) আইনের নামান্তর।' কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে বা কোনও ধর্মমতকে খাটো করার লক্ষ্যে যদি কোনও ব্যক্তির রাজনৈতিক বিশ্বাস আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তবে আইনের 295A ধারায় অভিযুক্তকে শাস্তিপ্রদান করা হয়।এই আইনে অভিযুক্তকে পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে।কোনও ব্যক্তি ধর্ম, বর্ণ, জন্মস্থান, ভাষা ইত্যাদির ভিত্তিতে দুটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে হিংসায় প্ররোচনা দিলে এবং দেশের সম্প্রীতি বিনষ্ট করলে ভারতীয় দণ্ডবিধির153A নং ধারায় তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। এই আইনবলে উসকানিমূলক বক্তব্যেও রাশ টানা হয়।
295A ধারাটি উচ্চ আদালতের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে মান্যতা পেয়েছে। তার মানে, কেবলমাত্র সাতজন বিচারপতির বেঞ্চেই এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা পুনর্বিবেচিত হতে পারে। আইনজীবী গৌরব ভাটিয়ার ব্যাখ্যা তাই বলছে।
যদিও 1957 সালে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে আইনের এই ধারাটি বৈধতা পেলেও, ভারতীয় বিচারব্যবস্থা এই দেশীয় ধর্মনিন্দামূলক আইনের প্রয়োগে ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেনি। এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। দেশের সংবিধানের 19A অনুচ্ছেদে ব্যক্তি বাকস্বাধীনতা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে একটা সাংবিধানিক রক্ষাকবচ পায়। সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে এই দুই আইনের অপব্যবহার নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। একটি মামলার আত্মপক্ষ সমর্থনে ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনি তাঁর বিরুদ্ধে 295A আইনে ব্যবস্থা নেওয়ায় এই আইনের বিরোধিতা করেন। 2013 সালে একটা ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ধোনিকে ভগবান বিষ্ণুর আদলে দেখানো হয়েছিল। এতে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত আনার অভিযোগ তোলা হয়। এই মামলায় শীর্ষ আদালত জানিয়ে দেয়, অনিচ্ছাকৃত এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে কোনও ধর্মের অবমাননা করা হলে, সেখানে আদালত হস্তক্ষেপ করবে না। কেননা, এতে আইনটির অপব্যবহার বাড়তে পারে।
আইনের 153A ধারা নিয়ে অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশ (ডিসেম্বর, 2020) হল, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা হলে, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে উপরিউক্ত আইনে অভিযোগ নেওয়া জরুরি।
হিন্দু আইটি সেলের দ্বারা ‘আক্রান্ত’ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই বিচারবিভাগীয় ব্যাখ্যা যথেষ্ট পীড়াদায়ক। দেশের দীর্ঘসূত্রী বিচারপ্রক্রিয়া এবং ব্যক্তিমানুষকে লাগাতার আক্রমণ করে যাওয়া, রীতিমতো ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মহেন্দ্র সিং ধোনি পর্যন্ত টার্গেট!
ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের সঙ্গে বাকস্বাধীনতা সংক্রান্ত মামলা নিয়ে কাজ করা আইনজীবী অভিনব শেখরির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এইসব ক্ষেত্রে বারবার অভিযোগ ওঠে যে, ব্যক্তির বক্তব্য বা আচরণের জন্য কারও ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লেগেছে৷ কিন্তু এই অভিযোগের ভিত্তিতে, অভিযোগের সারবত্তা না দেখেই ব্যক্তিকে জামিন অযোগ্য মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়, কেননা এই অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করারই নিদান দেওয়া হয়েছে সংবিধানে। আর এখান থেকেই এই আইনের অপব্যবহার করা শুরু হয়। এই কারণেই এই আইনে ‘অভিযুক্ত’ স্বয়ং মহেন্দ্র সিং ধোনিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য শীর্ষ আদালতে দৌড়তে হয়। কেননা, আমাদের আইনি ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতায় অভিযুক্ত ব্যক্তির অপ্রয়োজনীয় ভোগান্তি ও সম্মানহানি হয়। অপরাধের প্রকৃত উদ্দেশ্য নির্ণয়ে, আরও স্পষ্টভাবে বললে, অভিযুক্ত কোন ভাবনার দ্বারা চালিত হয়ে কাজটি করেছে, তার উৎস সন্ধানে পুলিশ কীভাবে তদন্ত চালাচ্ছে এবং তদন্তে অভিযুক্তর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি প্রমাণিত কিনা, তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে সবই গৌণ বিষয় হয়ে যায়।
সাকেত কুমারের ক্ষেত্রে যেমন, হিন্দু আইটি সেল 6টি অভিযোগ দায়ের করে। যদিও সেগুলোর একটাও এফআইআর হিসাবে গৃহীত হয়নি। এরকম অন্যান্য অনেক ঘটনাতেও অভিযোগগুলির কোনও আইনি সারবত্তা খুঁজে পাওয়া যায়নি।আইটি সেলের আইনি উপদেষ্টা, দিল্লি হাইকোর্টের আইনজীবী মুকেশ শর্মা জানালেন, ‘50-60টি অভিযোগে এফআইআর গৃহীত হয়নি। সেক্ষেত্রে আমরা পুলিশের উচ্চস্তরে এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করি। সেখানেও কাজ না হলে, সিআরপিসি-র 156(3) ধারায় মামলা রুজু করি।' সিআরপিসি-র 156(3) ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট কোনও অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশকে তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন। তিনি বিস্তারিত জানালেন, ‘সুস্মিতা সিনহার ক্ষেত্রে অনুরূপ ঘটনাই ঘটেছে। সাকেত আদালতে সুস্মিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে এলেও দিল্লিপুলিশ তার প্রাপ্তিস্বীকার করেনি।'
সুস্মিতা জানালেন, ‘হিন্দু আইটি সেল আমার বিরুদ্ধে গোবিন্দপুরী থানায় অভিযোগ দায়ের করে। কিন্তু থানার ইনচার্জএফআইআর নিতে অস্বীকৃত হন। পরে তারা একইভাবে সাকেত আদালতে যায় এবং আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। কোর্ট পুলিশকে অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললে, পুলিশ জানায় আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ গৃহীত হয়নি। হিন্দু আইটি সেল পুলিশের সেই দাবিকে চ্যালেঞ্জ জানালেও, অক্টোবরের শুনানিতে তাদের তরফে কেউ উপস্থিত ছিল না।'
ধর্মের জন্য, এর মধ্যে নাকি রাজনীতি নেই!
হিন্দু আইটি সেলের প্রতিষ্ঠাতারা কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রাখার কথা অস্বীকার করে। তারা দাবি করে, তারা শুধুমাত্র ‘জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুধর্ম’ রক্ষা করার কাজে ব্রতী। যদিও বহু বিজেপি নেতা এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। দিল্লিদাঙ্গায় প্রকাশ্যে মদত জুগিয়ে খবরের শিরোনামে এসেছিলেন বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র। সেই ‘কুখ্যাত’ কপিল মিশ্র নয়া নাগরিকত্ব আইনে নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রত্যাশী হিন্দু উদবাস্তুদের সঙ্গে দীপাবলি উদযাপন করার যে ডাক দেন, তাতে সামিল হয় এই হিন্দু আইটি সেলও।
মিডিয়া 13: রমেশ সোলাঙ্কির সঙ্গে কপিল মিশ্রর ছবি
https://www.instagram.com/p/CJ3uJVIgKMi/?utm_source=ig_web_copy_link
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, 2019 সালের আগস্ট মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে সাইবার ক্রাইম স্বেচ্ছাসেবকদের অন্তর্জালের দুনিয়ায় সন্ত্রাসবাদ, বিপ্লববাদ, দেশ বিরোধী কার্যকলাপে নজর রাখা ও এরকম কিছু নজরে এলে তা শনাক্ত করা এবং একইসঙ্গে ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম রিপোর্টিং পোর্টালে সেগুলি সম্পর্কে অভিযোগ নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অনেকটা আইটি সেলের মতোই কাজের ধরন।
রমেশের প্রশ্ন, সরকার একা আর কতটুকু কী করবে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এই পদক্ষেপ সম্পর্কে তাঁর অভিমত, ‘সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের কিছু দায়বদ্ধতা আছে। তাই, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও, আমরা মন্ত্রকে অভিযোগ পাঠাচ্ছি।' রমেশ স্বীকার করে নিলেন যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম রিপোর্টিং পোর্টালে হিন্দু আইটি সেলের ছেলেরা নিয়মিত অভিযোগ দায়ের করে থাকে।
2020 সালের নভেম্বর মাসে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে রাজ্যগুলিকে চিঠি দিয়ে বলা হয়, ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম রিপোর্টিং পোর্টালে জমা পড়া অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখতে, এবং তার ভিত্তিতে এফআইআর গ্রহণ করতে। মন্ত্রকের তরফে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে পোর্টালে জমা পড়া অভিযোগের মাত্র 2.5 শতাংশের ক্ষেত্রে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
মিডিয়া 14: হিন্দু আইটি সেল তার স্বেচ্ছাসেবকদের সাইবার সেল পোর্টালে অভিযোগ নথিভুক্ত করতে বলছে
https://twitter.com/HinduITCell/status/1302612486827302912?s=20
রমেশ হিন্দিতে যা বললেন, তার ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায় অনেকটা এইরকম, ‘এটা কারও বাবার জমিদারি নয় যে, ইচ্ছামতো ঘুরে চলে যাবেন। যদি আপনি অপমান করেন বা কারও কাজে নাক গলান; তবে তার ফল আপনাকে ভুগতে হবেই।' রমেশ হিন্দিতে আরও বলেন, ‘এই দেশের সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা লেখা আছে। কিন্তু তারও তো একটা সীমা রয়েছে। আমি আপনার গালে চড় মারলে সেটা কি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে গণ্য হবে?’
‘সূক্ষ একটা সীমারেখা আছে এর মধ্যে। একবার আপনি সেই সীমারেখা টপকালে, সেটাই হবে অপরাধ’— দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়ে দেন রমেশ।
রমেশ জানান, ‘আমরা যাই করি না কেন, আইন মেনেই করব।'
(সৃষ্টি জসওয়াল এবং শ্রী গিরীশ জলিহাল The Reporters' Collective-এর সদস্য। নিউজলন্ড্রি (www.Newslaundry.com) হচ্ছে ইংরেজিতে এই প্রতিবেদনের লিড পাবলিশার)
ধর্ম রক্ষার নামে যুক্তিবাদী স্বরের কণ্ঠরোধ।