×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • মানুষ মরছে মরুক, মন্দিরের জন্য কান্না

    শিখা মুখার্জি | 28-04-2021

    প্রতীকী ছবি।

    রাজস্থানের আলওয়ার জেলার রাজগড়ের সরাই মহল্লা এলাকায় সম্প্রতি রাস্তা চওড়া করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন কিছু ঘরবাড়ি ভেঙেছে। তার মধ্যে একটি রাস্তার ধারের মন্দিরও পড়েছে। এই ঘটনার পরেই স্থানীয় বিজেপি নেতাদের থেকে শুরু করে  দলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র রাজ্যবর্ধন সিংহ রাঠোর (যিনি অলিম্পিকে একজন রৌপ্য পদক বিজেতাও) পর্যন্ত সবাই রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে মন্দিরে স্থাপিত বিগ্রহের ক্ষতি করার অভিযোগে রে রে করে উঠেছেন। সেই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন দেশের বহু সাধুসন্ত ও ব্রাহ্মণ পুরোহিতরাও। এরা একযোগে রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলে এটাই বলে চলেছে যে, রাজ্য সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবেই বিগ্রহ ভেঙেছে ও মন্দির অপবিত্র করেছে

     

    কিছুদিন ধরেই একটা কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল যে, নয়া দিল্লির জহাঙ্গীরপুরায় মুসলমানদের বেআইনি ভাবে তৈরি ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার পর তার পাল্টা হিসাবে অন্তত 300টি পুরনো মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। একই সঙ্গে বামপন্থীদের বিশেষ করে নিশানা করে বলা হচ্ছিল যে, তাদের মদতেই নাকি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের লুকিয়ে লুকিয়ে এনে জহাঙ্গীরপুরায় ডেরা বাঁধার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল

     

    রাজস্থানের আলওয়ারে যেখানে বিগ্রহ ভাঙার অভিযোগে বিজেপি প্রতিবাদে উত্তাল, সেখানে রাস্তার ধারের মন্দিরের দেবতা এতদিন কিন্তু সাধারণ গরিব মানুষদের মধ্যেই মিলেমিশে বাস করছিলেন। শুধুই মন্দির নয়, রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য সেই সব বেআইনি দখলদারি করে সরকারি জমিতে তৈরি ঘরবাড়িও ভাঙা পড়েছে। কিন্তু হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত রক্ষাকর্তা বিজেপি এবং তাদের সোশাল মিডিয়ায় প্রধান প্রচারকর্তা অমিত মালব্য শুধুই কংগ্রেস সরকারকে মন্দির নিয়ে আক্রমণ করছেন। অমিত শাহ ট্যুইট করে বলছেন, কংগ্রেসের উন্নয়নমূলক কাজে মন্দিরের বিগ্রহ অপবিত্র হয়েছে।' তাঁর আরও মন্তব্য, ‘একদিকে জহাঙ্গীরপুরা ও কারাউলি নিয়ে চোখের জল ফেলছে, অন্যদিকে হিন্দুদের বিশ্বাসে আঘাত হানছে—এটাই কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতা।'

     

    দেখাই যাচ্ছে, বিজেপির যত মাথাব্যথা সবই মন্দির ও বিগ্রহ নিয়ে। মন্দিরের সঙ্গে যে কয়েক ডজন হতদরিদ্র পরিবারের ঘরবাড়ি ভাঙা পড়ল, তা নিয়ে বিজেপি নেতাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। কিছু মহিলা ও শিশু নিরাশ্রয় হয়ে তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে যতই হাহাকার করুক না কেন, তাতে বিজেপির কিছু যায় আসে না। কারণটা স্পষ্ট, মন্দির ভাঙাকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি, তার মূল্য কয়েক ডজন ঘরহারা মানুষের ভোটের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি

     

    সাম্প্রতিক ইতিহাসেই দেখা গেছে, কিছু ভোটদাতা ক্ষুব্ধ হয়ে নির্বাচনের সময় কোনও দলের যতটা ক্ষতি করতে পারে, মন্দির ও তার বিগ্রহ সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েও অনেক বেশি বাড়তি লাভ তার ঘরে জমা করতে পারে। ধর্ম দিয়ে কী করে ভোটদাতাদের ভুলিয়ে রাখতে হয়, বিজেপি সেটা ভালই জানে। এই ভোটদাতারাও মনে করেন যে, বিজেপির সুবাদে তাঁরা নতুন করে ধার্মিকতার স্বাদ অনুভব করতে পারছেন, তার বিনিময়ে বিজেপিকে ভোট দেওয়াটা সামান্য প্রতিদান মাত্র। তাই দেখা যায় ঘরবাড়ি ভাঙার পরে সরাই মহল্লার নিরাশ্রয় মহিলাদের ক্রন্দনে নিজেদের ঘরবাড়ি ভাঙার দুঃখ ও মন্দিরের জন্য হাহাকার মিশে যায়

     

    আরও পড়ুন: সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা ব্যর্থ সুপারম্যান

     

    বিগ্রহের ক্ষতি বা ধ্বংসই কিন্তু একসময় বিজেপিকে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় পৌঁছে দিয়েছিল। রামলালার বিগ্রহ একসময় 1949 সালের ডিসেম্বরের এক রাতে রহস্যজনক ভাবে অযোধ্যার বাবরি মসজিদের অন্দরে আবির্ভূত হয়, পরে 1992 সালের ডিসেম্বরে করসেবকদের বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় নিজেও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেটাই কিন্তু 1998 সালে বিজেপিকে প্রথমবার কেন্দ্রে সরকার গড়তে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। মনে রাখতে হবে, ভারতীয় আইনি ও বিচারব্যবস্থায় দেবতার বিগ্রহও একজন সাধারণ মানুষের মতোই আইনি সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারী। কাজেই, বিগ্রহের সম্পত্তির সুরক্ষা পাওয়াও তাঁর আইনি অধিকারের মধ্যেই পড়ে। যদি দেহ থাকে, তাহলে তার সুরক্ষা দান করাটাও আইনি ব্যবস্থার মধ্যেই পড়ে। সরাই মহল্লার মন্দিরের বিগ্রহ একটা শিবলিঙ্গ। তাই বিজেপি বিগ্রহের অঙ্গহানি বা ক্ষতি করার জন্য কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতেই পারে। মন্দিরের বা উপাসনাস্থলের কথা আলাদা, তা সে যতই প্রাচীন মন্দির বা উপাসনাস্থল হোক না কেন! ইসলাম ধর্মে যে হেতু কোনও সাকার বিগ্রহ পুজোর রীতি নেই, তাই বিজেপির মতে, মুসলমানরা তাদের উপাসনাস্থল মসজিদ রক্ষার জন্য আইনি প্রতিকারের দাবিও করতে পারে না। বিজেপির কাছে মুসলমানদের কোনও গুরুত্ব নেই, মুসলমান ভোটও তাদের দরকার নেই

     

    সরাই মহল্লার মন্দির ভাঙা ও বিগ্রহের ক্ষতি করার প্রশ্নে কংগ্রেসকে বেঁধার সঙ্গেই বিজেপি আবারও হিন্দুত্বকেন্দ্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিষ ছড়াতে শুরু করেছে। তার ফলে আঘাত এসে পড়ছে দেশের ধর্মনিরেপক্ষতার নীতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ন্যায়বিচার এমনকি ধর্মীয় রীতি পালনের স্বাধীনতার উপরে

     

    মন্দির ভাঙা নিয়ে কিন্তু বিজেপি মোটেই স্পর্শকাতর নয়। প্রাচীন মন্দির ও পুরাকীর্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে তাদের হাত কাঁপে না। তাই কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির চত্বরের উৎকট সম্প্রসারণ করতে গিয়ে যে বেশ কিছু ছোট ছোট প্রাচীন মন্দির ভাঙা হল, তাতে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। বিশ্বনাথ মন্দিরে পুণ্যার্থীদের যাতায়াতের জন্য প্রশস্ত রাস্তা তো তৈরি হল, যতই উৎকট হোক, মন্দির এলাকার সৌন্দর্যায়ন তো হল। তাতেই অন্য মন্দির ভাঙার সব পাপ ধুয়ে যাবে। যতদিন বিশ্বের এই বৃহত্তম রাজনৈতিক দল তার বিশাল অর্থ ও প্রচারশক্তি নিয়ে দাবি করে যেতে পারবে যে, মন্দির ভাঙলেও তাদের হাতে বিগ্রহ নিরাপদেই আছে, ততদিন বিজেপির মন্দির ভাঙার রাজনীতি এবং দেশের মানুষের একাংশকে শত্রু রূপে চিহ্নিত করে বিভেদের রাজনীতি অবাধে চলতে থাকবে।

     


    শিখা মুখার্জি - এর অন্যান্য লেখা


    গণধর্ষণ ও নাবালিকা ধর্ষণে অভিযুক্তরাও পরিবার আর সহযোগীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমর্থন পাচ্ছে আজকের বাং

    জ্বালানির দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিমান সহযাত্রীর প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারেন না কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি

    মোদী সরকার সুপ্রিম কোর্টে দেড়শো বছরের পুরানো দেশদ্রোহ আইন বজায় রাখার পক্ষ সওয়াল করছে

    পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যের বিরোধিতা করতেই ব্যস্ত রাজ্যের স্বার্থ অবহেলা করে

    পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের অপরাধের জন্য অঙ্কিতা অধিকারীকে দায়ী সাব্যস্ত করা বিস্ময়কর

    জাতীয় স্তরে বিজেপিই সিপিএমের প্রধান প্রতিপক্ষ হলেও পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস শাসনের বাস্তবতায় রাজ্য

    মানুষ মরছে মরুক, মন্দিরের জন্য কান্না-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested