×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • পথে নামিয়া প্রমাণ করিল সমাজের কতটা জুড়িয়া আছে তাহারা

    রজত রায় ও শুভস্মিতা কাঞ্জী | 16-04-2020

    প্রতীকী ছবি

    দেশের বিভিন্ন প্রান্তেই আটকে পড়েছেন অভিবাসী শ্রমিকরা। তাদের কাছে নেই প্রয়োজনীয় খাবার বা অন্যান্য সামগ্রী। বাড়ি ফেরার আকুলতা সবার মধ্যেই। লকডাউন না মেনেই চলছে জমায়েত, বিক্ষোভ। কেউ কেউ পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাংলার বহু অভিবাসী শ্রমিক আটকে আছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।  

    মালদার সগরাম টুডু আরও অনেকের সঙ্গে ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়েছিলেন কাজের জন্য। একটি 4-5 বছরের প্রকল্পে নিযুক্ত হয়েছিলেন শ্রমিক হিসেবে। কিন্তু হঠাৎ এই লকডাউনের ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে কাজ। সেখানকার কর্মরত 200 জন শ্রমিক এখন টিনের অস্থায়ী বাড়িতে দিন কাটাচ্ছেন। কতদিন এভাবে থাকতে হবে সগরামরা জানেন না। লকডাউন উঠলে তাঁদের কাছে বাড়ি ফেরার টাকাও নেই। বকেয়া টাকা পাবে কি না তাও জানেন না। ঠিকাদারই আপাতত তাদের রেশনের ব্যবস্থা করছেন, যা পরবর্তীকালে তাদের প্রাপ্য টাকা থেকে কেটে নেওয়া হবে।

    আরও পড়ুন 

    কেরালায় কনট্রোলে করোনা: ম্যাজিক নয়, শুধু স্ট্র্যাটেজি আর শিক্ষা

    তেমনই মাজিন শেখ সহ আরও 70 জন শ্রমিক বিহারের ঔরঙ্গবাদে আটকে পড়েন লকডাউনের সময়। তাঁদের দিনে এক ঘণ্টা করে সময় দেওয়া হতো রেশন কেনার জন্য। কিন্তু দোকানের সেই ভিড় ঠেলে জিনিস কিনতে কিনতে সময় পার হয়ে যেত। ফলে, পড়তে হতো পুলিশের অমানুষিক অত্যাচারের মুখে। কেড়ে নেওয়া হতো রেশন। মার জুটত কপালে। তাই এসবের থেকে মুক্তি পেতে তাঁরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। জি.টি রোডে কর্মরত পুলিশেরা তাঁদের চা বিস্কুট খাওয়ায়। সাহায্য করে। পথে আরও প্রায় 500 জন শ্রমিক তাঁদের সঙ্গী হয়। এরপর যখন তাঁরা দু’দিন দু’রাত্রি পায়ে হেঁটে 300 কিলোমিটার পেরিয়ে ঝাড়খন্ড-বাংলা বর্ডারে পৌঁছান, ততক্ষনে আন্তঃরাজ্য যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই সেখানকার পুলিশ তাঁদের নিকটবর্তী এক কলেজে রাখার ব্যবস্থা করে। এসডিপিও-র তদারকিতে মাজিনদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এবং তাঁদের প্রত্যেক দিন চাল, ডাল বা খিচুড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। ঝাড়খন্ড পুলিশের এই মানবিক ব্যবহারে তাঁরা খুশি।


     

    অন্যদিকে বাংলার বহু অভিবাসী শ্রমিক কেরালা যান কাজের খোঁজে। কারণ, সেখানে রাজমিস্ত্রির মজুরি একদিনে 750/- টাকা। মুর্শিদাবাদের কিছু শ্রমিক, বরুণ সরকার, মজামুল হক সেখানে একটি স্কুলের প্রকল্পে ছিলেন। স্কুল কতৃপক্ষ প্রথম ক’দিন সাহায্য করলেও পরে তা বন্ধ করে দেন। ফলে সমস্যায় পড়েছেন তাঁরা। বাধ্য হয়ে ধার করছেন ঠিকাদারের থেকে। তাই গুলিয়ে যাচ্ছে পুরনো সব হিসেব। কারণ, অনেকেই ঠিকাদারের কাছে তাঁদের টাকা জমিয়ে একসঙ্গে তা বাড়িতে পাঠাতেন।

     কেরালা সরকার বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় বানিয়েছে। মানুষদের কাছে খাবার পৌঁছানোর ব্যবস্থাও করেছে। কেরালার কন্নুর জেলাও একই পন্থা অবলম্বন করেছে। সরকারের তরফে সাহায্যের হাত বাড়ান হয়েছে। বিভিন্ন উপায়ে খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে মানুষের কাছে। গড়ে তোলা হয়েছে কমিউনিটি কিচেন। তবুও বিপদে পড়েছেন অনেকেই। ইউপির অজয় রাজনিশ পরিবার নিয়ে কন্নুরেই থাকেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপদে পড়ায় তাঁর বাড়িওয়ালা তাঁকে সাহায্য করছেন। বাড়ি ভাড়া নিচ্ছেন না। কিন্তু খাবার? জমানো টাকাও ফুরিয়ে আসছে। কাতর গলায় তিনি জানিয়েছেন, ‘করোনায় তো পরে মরব, খিদে আগেই মেরে ফেলবে।'

    কেরালা বা ঝাড়খন্ড সরকারের যে মানবিক রূপ দেখা গিয়েছে, মহারাষ্ট্রে তা অমিল। কোনও পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই শ্রমিকদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের নিজ নিজ রাজ্যে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 

    দেশ জুড়ে অভিবাসী শ্রমিকদের অবস্থা ভয়াবহ। কোথাও কোথাও সাহায্য মিললেও তাদের শোচনীয় অবস্থা বারবার প্রকাশ্যে আসছে। 

    প্রধানমন্ত্রী বলেছেন 80 কোটি মানুষকে আগামী তিনমাস রেশন দেওয়া হবে। একই সুর বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর গলায়। তিনিও জানিয়েছেন 7.8 কোটি মানুষকে সরকার আগামী ছয়মাস রেশন দেবে। এছাড়াও বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলার শ্রমিকদের খোঁজ করছেন। ইতিমধ্যেই তাঁরা প্রায় 50000 শ্রমিকের খোঁজ পেয়েছেন। রোজ সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে। তাদের থেকে কোনও খবর পেলে, সাহায্যের আর্তি  শুনলেই সেই জায়গার নিকটবর্তী কোনও সংস্থা বা সরকারের থেকে সাহায্য চেয়ে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করছে বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ। তাঁরা নিজেরা চাঁদা তুলে প্রায় 35000 মানুষের খাবার ব্যবস্থা করেছেন। একই ভাবে All India Minority Organization-এর তরফে 10 লাখ টাকা তোলা হয়, এবং তার 7.5 লাখ টাকা অভিবাসী শ্রমিকদের দেওয়া হয়। বাকিটা দিয়ে চাল ডাল কিনে দুঃস্থ মানুষদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু সংস্থাই নয়, বন্ধুবান্ধব মিলেও এই সময় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন অনেকেই। তেমনই দার্জিলিঙের পেঞ্চন ধান্দুপ এবং তাঁর বন্ধুরা মিলে বয়স্কদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন ওষুধ, যা তাঁরা দোকান থেকে 50% ছাড়ে পাচ্ছেন।

    বিভিন্ন সময়ই দেশ নানান বিপদে পড়েছে। ত্রাতা হিসেবে সরকার ছিল, আজও তাই। তবুও তার মধ্যে যেটুকু ফাঁক থাকত তা এভাবেই বারবার পূরণ হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা মানুষের সাহায্যে। 

    আরও পড়ুন

    দেশ দেখছি অন্ধকারে

    কিন্তু শুধু খাবার দিলেই কী হবে? কেন বারবার মনে করা হয় এভাবে শুধু খাবার দিলেই সমস্যা মিটে যাবে? সবার মনেই যেন এই ভুল ধারণা গেঁথে বসে আছে। দেশে বিভিন্ন জায়গায় নানান উদ্যোগ নেওয়া হলেও শ্রমিকদের প্রয়োজন কি সত্যিই মিটছে? অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় এবং এস্থার ডুফলো তাদের বই ‘Good Economy For Hard Times’-এ বলেছেন, এটা ভুল। শুধু খাবার দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। অর্থেরও সমান প্রয়োজনীয়তা আছে।

    হর্ষ মন্দারের হয়ে আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানান, অভিবাসী শ্রমিকদের টাকা দেওয়া উচিত তাঁদের বাড়িতে পাঠানোর জন্য। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে এস.এ ববদে, এস.কে বেল ও দীপক গুপ্তের বেঞ্চ এই আবেদন খারিজ করে দেয়। জানিয়ে দেওয়া হয়, সরকার যেহেতু অভিবাসী শ্রমিকদের খাবার ব্যবস্থা করছেন তাই তাদের অর্থ সাহায্যের প্রয়োজন নেই। ভারতের সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহেতা জানিয়েছেন, সারা দেশে 26476 "শেল্টার হোমস' আছে যেখানে আশ্রয় পেয়েছেন 10.3 লাখ মানুষ। 17000 ক্যাম্প থেকে রোজ প্রায় 84 লাখ মানুষকে খাওয়ানো হচ্ছে। কিন্তু ভারতে প্রায় 45 কোটি 30 লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক আছেন, বাংলায় 1 কোটি 3 লক্ষ। সাহায্য পাচ্ছে মোট সংখ্যার মাত্র 2%-এর কাছাকাছি মানুষ। অন্য সময় এদের অস্তিত্ব অতটা প্রকট না হলেও এখন বোঝা যাচ্ছে। সাহায্য পাওয়ার পরেও বাড়ি ফেরার আকুলতা বুঝিয়ে দিচ্ছে তাঁদের দরকার খাবারের সঙ্গে অন্য কিছু। অর্থও প্রয়োজন। এই মহামারীর সময় শ্রমিকদের সমস্যা সামনে এলেও আমরা যেন এক প্রকার বধির হয়ে গিয়েছি। সবটা যেন শুনেও শোনা হচ্ছে না। ফল? জমায়েত, বাড়ির ফেরার তাড়া আর বিক্ষোভ।

    সবটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, শুধুই নিজের খাদ্যাভাব মিটলে হবে না। প্রিয়জনদের জন্যে চিন্তা বাড়ছে, জীবানুর আতঙ্কের থেকে অনাহারে মরার ভয় বা বাড়ি ফেরার টান অনেক বেশি। তাই শুধু খাবার দেওয়া সমাধান নয়।

     

     


    পথে নামিয়া প্রমাণ করিল সমাজের কতটা জুড়িয়া আছে তাহারা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested