×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • সাম্প্রদায়িক ফেক নিউজে লকডাউন নেই

    সুদীপ্ত সেনগুপ্ত, অয়ন্তিকা দত্ত মজুমদার ও অর্যমা দাস | 28-04-2020

    প্রতীকী ছবি

    Societies become modern when news replaces religion as our central source of guidance and our touchstone of authority.

     

    একটা সমাজ তখনই আধুনিক বলে গণ্য হয় যখন ধর্মের বদলে খবর হয়ে ওঠে তার কেন্দ্রীয় চালিকা শক্তি এবং ক্ষমতার অধিষ্ঠান।   দার্শনিক হেগেল

     

    লকডাউনে যা একেবারেই বন্ধ হয়নি, বরং ঘরবন্দি মানুষের সোশাল মিডিয়া নির্ভরতা বাড়ার জন্য হয়তো বেড়েছে, তা হল ফেক নিউজ। ছবি সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিথ্যা কথা বলে; আর ছবিটা ভিডিও হলে তো তারও এক কাঠি বাড়া। এই সরল সত্য ছোটবেলা থেকে ফিল্ম দেখে দেখে আমরা বিলক্ষণ জানি। কিন্তু ভিডিওটা যখন ‘নিউজের’ তকমা লাগিয়ে আমাদের সামনে ফেলা হয়, তখন আমরা অনেকেই বিচার, বুদ্ধি, বিবেচনা নিমেষে সুইচ অফ করে ফেলি। টাইটানিক থেকে হ্যারি পটার, শোলে থেকে বাহুবলী দেখতে দারুণ লাগে, যদিও জানি বাস্তবে ওই রকম হয় না। প্রায় একই রকমের অবাস্তব জিনিস নিউজ বলে পেশ করলে কিন্তু আমরাই ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্বাস করি। করেই অন্যদের বিশ্বাস করাতে দ্বিগুণতর উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ি। একের থেকে ফরোয়ার্ড হল পাঁচ জনে, পাঁচের থেকে 25, তার থেকে পাঁচ গুণে 125, তারও পরে 625। তারপর থেকে ক্যালকুলেটর লাগবে। লকডাউনে হাতে সময় থাকলে ওই পাঁচ দিয়ে গুণ করার অঙ্কটা কেউ চালিয়ে গেলে দেখতে পাবেন মাত্র 13 দফা ফরোয়ার্ড হলেই সংখ্যাটা 150 কোটি ছাড়িয়ে যায়। স্মরণ করুন, ভারতের জনসংখ্যা মাত্র 130 কোটি!

     

    ওই জ্যামিতিক প্রগতির (ক্রমাগত গুণ করতে থাকা) প্রবল পরাক্রম ব্যবহার করে মানুষকে প্রভাবিত করাই হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের আইটি সেল নির্ভর রাজনীতির মন্ত্র। লকডাউনে অনেক কিছু স্তব্ধ। কিন্তু রাজনীতির প্যাঁচ কষা থেমে নেই। দেশের প্রধান শাসক দল ও তার সহযোগীদের ভাবনায় রাজনীতি আর ধর্মেও ফারাক নেই। যে কোনও ঘটনায় মুসলিমদের খারাপ, দেশবিরোধী, শয়তান প্রতিপন্ন করা এদের কাজ। হিন্দুরা ন্যায়বিচার পাচ্ছে না বলে ভাবাবেগ জাগ্রত করা সেই মুদ্রারই অন্য পিঠ। প্রতিদিন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এই ধরনের ফেক নিউজ আছড়ে পড়ছে সোশাল মিডিয়ায়। অনেকে অতটা তলিয়ে দেখেন না, অভ্যাস নেই, সময় নেই, অথচ সত্য-মিথ্যা বিচারে আগ্রহী। তাঁদের জন্য www.altnews.in প্রতিনিয়ত সত্য আর অসত্যের ঝাড়াই বাছাই করে চলেছে। দুটি ভাইরাল হওয়া ফেক নিউজের ব্যবচ্ছেদ করে বেরিয়ে আসা সত্য আমরা নীচে তুলে ধরলাম। দুটি ফেক নিউজেরই মিল হল ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষ খেপিয়ে তোলার চেষ্টা।

     

    পালঘর কাণ্ডের পর রাস্তায় নাকি নেমেছে সাধুদের দল

    ঘটনা: 16 এপ্রিল, মহারাষ্ট্রের পালঘরে, শ্রী পঞ্চনাম জুনা আখাড়ার তিন হিন্দু সাধুকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে খুন করা হয়। এই কাণ্ডে এখনও পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অভিযুক্তরা কেউই অ-হিন্দু নয়।

    ফেক নিউজে দেখানো হয়েছে: পালঘর কাণ্ডের দ্রুত সুরাহা না হলে লকডাউন ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্ষোভের হুমকি জুনা আখাড়ার, দাবি করছে সাধুদের জনসমাগমের এক ভাইরাল ভিডিও। হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুনা আখাড়ার তরফে এও জানানো হয়েছে যে, এই ঘটনার উচ্চ-স্তরের অনুসন্ধানের দাবিতে তাঁরা নাসিকের ত্রয়োমকেশ্বরে একত্রিত হবেন। গুঞ্জন কাশ্যপ নামে একজন মহিলার টুইট ভাইরাল হয়। তিনি বিজেপি এবং আরএসএস সাপোর্টার। তাঁর টুইটের রি-টুইট সংখ্যা 300-এর অধিক। এতে বলা আছে, महाराष्ट्र सरकार । क्या यह तूफान रोक पाएगी? मैं मांग करती हूं जल्द से जल्द पालघर कांड पर इंसाफ हो। नहीं तो जूना अखाड़े ने लोक डाउन के बाद महाराष्ट्र में प्रदर्शन करने की चेतावनी दी है।” (মহারাষ্ট্র সরকার, এই ঝড় কি থামাতে পারবে? আমি প্রার্থনা করছি যেন খুব তাড়াতাড়ি পালঘর কাণ্ডের ন্যায়বিচার হয়। নয়তো লকডাউন ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভের হুমকি দিয়েছে জুনা আখাড়া।)

     

    ভিডিওটি সোশাল মিডিয়ায় হুড়মুড়িয়ে ভাইরাল হয়ে যায়।

     

    তথ্য যাচাই: গত জানুয়ারি মাসে এই ভিডিওটিরই সত্যতা যাচাই করেছিল, www.altnews.in. তখন ভিডিওতে দাবি করা হয়েছিল যে কাতারে কাতারে সাধু এবং আগুরিরা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা CAA-এর সমর্থনে রাস্তায় নেমেছেন। যদিও খোঁজ করে পাওয়া গেছে এই ভিডিওটি 7 মার্চ, 2019-এ অ্যাভিয়েটর অনিল চোপড়া নামে এক টুইটার ব্যবহারকারী শেয়ার করে লিখেছিলেন, The greatest temporary spectacle on earth, peaceful and orderly for such a great mass of humanity. Incredible Indian civilisation. #Kumbh2019.” (পৃথিবীর বৃহত্তম অস্থায়ী দর্শনীয় স্থান, এত বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য শান্তিপূর্ণ এবং সুশৃঙ্খল। ভারতীয় সভ্যতা সত্যিই অবিশ্বাস্য। #কুম্ভ2019)। ভিডিওটির সত্যতা আরও খতিয়ে যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, 11 মার্চ, 2019-এ সুরেশ কুমার নামে জনৈক ব্যক্তি ফেসবুকে এই ভিডিও পোস্ট করে লিখেছিলেন, “কুম্ভ মেলা নাগা সাধু”।

     

    গতবছর 15 জানুয়ারি থেকে 4 মার্চ পর্যন্ত কুম্ভের মেলা পালিত হয় এবং প্রায় কয়েক কোটি পুণ্যার্থী সেখানে ভিড় জমান। এই ভিডিওটিই আবার 3 মার্চ 2019- এ একটি চ্যানেল অন্য একটা ডেসক্রিপশন লিখে ইউটিউবে আপলোড করে। ক্যাপশনে “জুনাঘড় নাগা বাভা” লিখে মহাশিবরাত্রির কথা বোঝানো হয়। গত বছর মহাশিবরাত্রি 4 মার্চে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

     

    ভিডিওটির সঙ্গে পালঘর কাণ্ডের সম্পর্ক থাকতেই পারে না, কারণ এটি ঘটনার অনেক আগে শুট করা।

     

    "গুজরাতে মুসলিম ব্যক্তি নাকি করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছেন পেট্রল পাম্পে'

    ফেক নিউজে দেখানো হয়েছে: সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে একজন মুসলিম ব্যক্তি পেট্রল পাম্পে স্কুটারে তেল ভরালেন। তারপর একটা ছোট্ট জিনিস তিনি ছুঁড়ে ফেলে দেন মাটিতে। রাতারাতি সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় ভিডিওটি। মাটিতে পড়া জিনিসটা আসলে কারেন্সি নোট। ভিডিওটির ইঙ্গিত, তিনি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াতেই এই নোটগুলি মাটিতে ফেলেন। সোশাল মিডিয়া জুড়ে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন স্বভাবতই। ব্যাপারটা প্রথমে করোনা সংক্রমণের পর্যায়ে থাকলেও তা পরে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিণতি পায়। নির্দিষ্ট করে ‘মুসলমান'রা এইভাবে করোনা ছড়াচ্ছেন বলে প্রচার হয়।


    এবিপি নিউজের একজন সাংবাদিক তাঁর টুইটারে ভাইরাল ভিডিওটা পোস্ট করেন ক্যাপশনে লেখেন,"'नोट जानबूझ कर फेंका या गलती से गिर गया है ? इनका इरादा क्या हो सकता है?''(টাকাটা কি ব্যক্তির হাত থেকে ভুল করে পড়ে গেল? না কি এর কোনও উদ্দেশ্য ছিল?)সেই পোস্টেরই 2.5 লাখ ভিউজ এবং 6000 রি-টুইট হয়।


    TV9 খবরটি প্রকাশ করেন সোজাসুজি এভাবেই- "A man in Gujarat’s Navsari threw a Rs 20 note creating a coronavirus scare" (গুজরাতের নভসারিতে করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক ছড়াতে একজন ব্যক্তি 20 টাকার একটি নোট ফেলে যান।)

    তথ্য যাচাই: গুজরাতের নভসারি যাওয়ার পথে হাইওয়ের উপর অবস্থিত একটি পেট্রল পাম্পে 22 এপ্রিল এমনই একটা ঘটনা ঘটে। www.altnews.in তথ্য যাচাই করতে নভসারি পুলিশ স্টেশনে যোগাযোগ করেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর পি পি ব্রহ্মবত জানান, এই ঘটনা সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর পেট্রল পাম্প কর্তৃপক্ষ পুলিশ স্টেশনে যোগাযোগ করেন। সেই অনুসারে ভালসাদের বাসিন্দা, মহম্মদ ইউসুফ ইলিয়াস শেখ নামে ভদ্রলোককে পুলিশ স্টেশনে ডাকা হয়েছিল। দেখা যায় যে, তাঁর ডান হাত প্যারালাইসিসের জন্য ঠিকমতো কাজ করে না। সেদিন কী হয়েছিল ভিডিওটা না দেখলে খেয়াল করতেই পারতেন না। ভিডিও দেখে তিনি বোঝেন, তিনি ডানহাত দিয়ে খুচরো টাকাটা নিয়ে বাঁ হাত দিয়ে বাঁ পকেটে ঢুকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেন। কিন্তু, ডান হাতে যে 20 টাকার একটা নোট রয়ে গিয়েছিল এবং তা নীচে পড়ে যায় তা তিনি বুঝতেই পারেননি। 2009-এ একটি পথ দুর্ঘটনায় তাঁর ডান হাতটা প্যারালাইসড হয়ে যায়। ফলে তিনি ডানহাতে ঠিকমতো সাড় পান না। তিনি সেদিন নভসারি হাইওয়ে ধরে হাসপাতালে চেক আপে যাচ্ছিলেন। অ্যাকসিডেন্টের পর তাঁর শিরদাঁড়ায় মাঝেমধ্যেই ব্যথা হয়। দু-তিন মাস অন্তর তাঁকে চেক আপে যেতে হয়।


    ইন্সপেক্টর তা সত্ত্বেও ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করেন, করোনা ভাইরাসের কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা তাঁর মধ্যে। তারপর ইলিয়াস শেখের ডাক্তারি পরীক্ষা হয়, তাতে করোনা নেগেটিভ আসে।


    সর্বসমক্ষে ইলিয়াস শেখের বিনীত অনুরোধ, ‘আপনারা ভুল তথ্য এইভাবে ছড়াবেন না। আতঙ্ক বাড়াবেন না। সবাই সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন।'

     

     


    সুদীপ্ত সেনগুপ্ত, অয়ন্তিকা দত্ত মজুমদার ও অর্যমা দাস - এর অন্যান্য লেখা


    লকডাউনে ঘরবন্দি মানুষের সোশাল মিডিয়া নির্ভরতা বাড়ার জন্য হয়তো বেড়েছে, তা হল ফেক নিউজ।

    সাম্প্রদায়িক ফেক নিউজে লকডাউন নেই-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested