বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা এখন ক্রমশ খর্ব করা হচ্ছে। স্বশাসিত যে সমস্ত সাংবিধানিক (যেমন নির্বচন কমিশন) এবং বিধিবদ্ধ সংস্থার (যেমন সিবিআই) আসল কাজ ছিল গণতন্ত্রকে রক্ষা করা, তারা যেন শাসকের অনুগত সেবকে পরিণত হচ্ছে। অভিজ্ঞমহলের একটা অংশ মনে করছেন, বিগত কয়েক বছরে দেশের স্বশাসিত সংস্থাগুলির অধিকার খর্ব করার পাশাপাশি জনগণের স্বাধীন চিন্তাভাবনা এবং অধিকারের উপরেও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেমে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকারের একটার পর একটা সিদ্ধান্তে সাংবিধানিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এই পরিস্থিতিতে 20 আগস্ট www.4thpillars.com ‘বিপন্ন সংবিধান’ শীর্ষক একটি আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল। এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সমীর কুমার দাস। দুই বিশিষ্ট অতিথির বক্তব্যে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তবর্তী সংকটের প্রসঙ্গ যেমন উঠেছে, তেমনি এই পরিস্থিতিতেও দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশার কথা শোনা গেছে তাঁদের বক্তব্যে।
1) কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল পদে নিয়োগ করা হয়েছে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এক ব্যক্তিকে যিনি গত দুই দশক ধরে নরেন্দ্র মোদীর বিশ্ষ আস্থাভাজন। নবনিযুক্ত জি.সি. মূর্মূ অতীতে গুজরাতের মুক্যমন্ত্রী মোদীর ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। সিএজির কাজ সরকারের খুঁত খুঁজে বের করা। অডিট এবং অ্যাকাউন্টিং-এর কাজে তাঁর অভিজ্ঞতা নেই। এমন কাজ দক্ষভাবে করতে পারেন, তেমন যোগ্য কাউকে খুঁজে নেওয়া যেত।
2) একই ব্যক্তিকে সংবিধানের 370 ধারা বিলোপের সিএজি পদে আর একটু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কাউকে নিয়োগ করা হলে ভাল হত। সরকারি অর্থ যে খাতে খরচ হওয়ার কথা সেই খাতে খরচ হচ্ছে কিনা, তা দেখার কথা। এই পদে অভিজ্ঞ কোনও আমলাকে প্রয়োজন ছিল।
3) শুধুমাত্র ব্যক্তিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই ক্ষয়রোগ দেখা গিয়েছে। এখন প্রশ্ন, কোনও সৎ অফিসার এলেও কি তাঁকে কাজ করতে দেওয়া হত? এটা আসলে প্রাতিষ্ঠানিক সংকট।
4) সিএজি-কে সাপোর্ট দেয় পার্লামেন্টারি কমিটি। পার্লামেন্ট সাপোর্ট না দিলে সিএজি কাজ করতে পারবে না।
5) সিএজি সংক্রান্ত অনেক সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থা আছে। সিএজি-র রিপোর্ট অনেক পরিশ্রম করে তৈরি করা হয়। তবে সেই রিপোর্টে উঠে আসা ভুল বা খুঁতগুলো আইনসভাকে ভুল বলে স্বীকার করতে হবে। বাস্তবে দেখা যায়, পাতার পর পাতা রিপোর্ট পড়ে থাকে। কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আবার এই ভুলটাকে তুলে ধরে আমরা নাগরিকরা কোর্টেও যেতে পারব না। তার জন্যও আইনসভার বৈধতা চাই।
6) সিএজির কাজ নিয়ে অনেক মতবিরোধ থাকলেও, দ্বিতীয় ইউপিএ আমলে সিএজি বিনোদ রাই 1 লক্ষ 76 হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ফাঁস করেছিলেন। তারপর সরকারকে পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করতে হয়েছিল। সরকারকে অভিযোগটা মানতেও হয়েছিল। টাকার অঙ্ক কিংবা সিএজি-র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু এটাই কিন্তু সিএজির কাজ, যেটা বিনোদ রাই করতে পেরেছিলেন।
7) পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান এখন শাসকদলের কাউকেই করা হচ্ছে। এখন তো বিরোধীহীন আইনসভার কথা বলা হচ্ছে, মানে যাকেই বসানো হচ্ছে সে শাসক দলেরই লোক। আমরা এতকাল জেনে এসেছি বিরোধী দলেরই লোক পিএসি-র চেয়ারম্যান হবে। এখন এটা আর হয় না। এটা নিয়ে কোনও জনস্বার্থ মামলা হয়েছে কিনা তাও জানা নেই।
8) নেহরুর আমল থেকেই সিএজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু সরকারকে বিব্রত করাই হল সিএজির কাজ। স্বাধীন ভারতে যে প্রথম "ইন্ডিয়া এগেন্সট ফ্রিডম' আন্দোলন শুরু হল, তার জন্য সিএজি-র একটা বড় ভূমিকা ছিল।
9) গণতন্ত্র নিয়ে এখনই হতাশ হওয়ার মতো কিছু হয়নি। সমকালীন সময়ে স্বাধীনতা পাওয়া অনেক দেশই গণতন্ত্র টেকাতে পারেনি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি বলেছিলেন ভারতে গণতন্ত্র টিকবে না। কিন্তু ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে গণতন্ত্র এতকাল অক্ষুণ্ণ থেকেছে। সাতের দশক থেকে এর অবক্ষয়ের শুরু। এখন যারা ক্ষমতায় রয়েছে, "গণতন্ত্রের পূজারি' হিসাবে তাদের বিশেষ খ্যাতি তো নেই। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কিছুটা পিছিয়েছি আমরা, তাই এখন একটু জোর করেই সামনে এগোতে হবে।
10) শেষ দু'-তিন দশকে নির্বাচন কমিশনের বিশেষ কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেনি। গত লোকসভা ভোটের সময় কমিশনের একজন সদস্য প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী বিধিভঙ্গের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তো পরে চাকরি নিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। ইতিবাচক এটাই যে, একজন অন্তত এর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন।
11) এই পরিকাঠামোর মধ্যেই অনেক নির্বাচন কমিশনার স্বাধীন ভাবে কাজ করতে চেয়েছেন। কেউ একজন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চাইলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়ান না। তবে কিছু মানুষ তো আছেন, যাঁরা অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এরকম বহু দৃষ্টান্তে আমরা অতীতে দেখেছি যে, এইসব মানুষরাই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছেন। আবার এও সত্য যে, কোনও সাহসী পদাধিকারীকে কিন্তু প্রশাসনের তরফ থেকেও ততটা বাহবা দেওয়া হয় না।
12) চায়ের ক্লাব, প্রেস ক্লাব কিংবা রামলীলা ময়দান— গণতন্ত্রের পরিধি কিন্তু বহুবিস্তৃত। এই গণতন্ত্র কিন্তু শুধু প্রতিষ্ঠাননির্ভর নয়। আমাদের সকলের এই নয়া গণতন্ত্রটিকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা দায়বদ্ধতা আছে।
13) 2019-এর মতো উত্তাল আন্দোলন আমরা অতীতে দেখিনি। গণতন্ত্রে জনগণের অংশগ্রহণ না থাকলে, সেটা আর কীসের গণতন্ত্র? জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করা গেলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আছে। নচেৎ তাকে টিকিয়ে রাখা মুশকিল।
14) মহামারী না হলে হয়তো সিএএ, এনআরসি-র বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনের অন্য একটা রূপ আমরা দেখতে পারতাম। এনআরসি অসমে হল, কিন্তু তার কী ভবিষ্যৎ আমরা জানি না। তাই এখনই এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ দেখি না। এনআরসি নিয়ে বারবার পিছু হঠছে সরকার। এটা কি আন্দোলনের সার্বিক সাফল্য নয়?
15) বিচারব্যবস্থার কাছে স্বচ্ছ তদন্ত এবং স্বচ্ছ বিচার আশা করব। তদন্তে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, বিচারের যে মূল্যবোধ সংবিধানে স্বীকৃত তাকে স্বীকৃতি দেওয়া বিচারব্যবস্থার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
16) আমরা তো বিচার চাইব সুপ্রিম কোর্টের কাছে। উল্টে তারা জাতির কাছে বিচার চাইছে। বোধহয় শেষ পর্যন্ত একটা বিমূর্ত জাতির কাছেই আবেদন করতে হয়। কিন্তু এই বিমূর্ত জাতি কবে সাকার হবে, কবে গর্জে উঠবে আমাদের তার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
সাধারণ মানুষ আর কি কমিশন কিংবা আধাসেনার ওপর ভরসা করে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবে?
বিদেশ ও প্রতিরক্ষার মধ্যে দলীয় রাজনীতি আনার ফলেই স্বচ্ছতার অভাব।
গত সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনও আন্দোলনকে কেন্দ্রীয় সরকার দেশবিরোধী তকমা দিতে পারল না।
বিজেপি বাংলায় এসেও জাতপাতের রাজনীতিই শুরু করবে।
বাঙালিকে বাধ্য করা হচ্ছে হিন্দি বলতে।
রাজনীতিতে বিরোধীর জায়গা থাকবে না? পুরো পরিসর জুড়ে থাকবে শুধুই শাসক?