×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ‘ছত্তিশগড়ের চালচিত্র’ : একটি দ্বান্দ্বিক পাঠ

    শিবাংশু দে | 13-04-2020

    শিবাংশু দে।

    বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছত্তিসগড় বলতে যে যে বিষয়গুলো চট করে ভেবে ফেলা হয়, ছত্তিসগড় কি আদৌ তেমন? তেমন না হলে, কেমন?

    -এই প্রশ্নেরই অন্তর্ভেদী জবাব রয়েছে ‘ছত্তিশগড়ের চালচিত্র’-তে। লিখেছেন রঞ্জন রায়। বইটি পড়লেন শিবাংশু দে

     

    তঁহু যাবে, মহু যাবো, রাজিম কে মেলা

    ছত্তিসগড় জায়গাটা চিরকালই একটা ছায়া অঞ্চল একটু বিশদ হতে চাইলে বলা যায়, বিন্ধ্যের ছায়া অঞ্চল আর্য দ্রাবিড় সভ্যতার মাঝখানের হাইফেন শুধু ভূগোল নয়, সংস্কৃতির দিক দিয়ে দেখতে গেলে তার অন্য অংশ হল দক্ষিণ-পশ্চিম ঝাড়খণ্ড এবং গোটা পশ্চিম ওড়িশা এই বিস্তৃত ভূখণ্ডটি এদেশের আদি কৌম সভ্যতার কেন্দ্র তার পর্বত-অরণ্য-নদী-মানুষের চতুষ্কোণ কখনও আর্য বা দ্রাবিড় সভ্যতার ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠতে পারেনি দুইশক্তিমানসভ্যতা তাকে দখল করতে চেয়েছে ভালোবাসেনি, আপন করতেও চায়নি বহু পরে ঝাড়খণ্ড এবং ছত্তিসগড়পৃথক রাজ্যহয়ে কিছুটা আত্মনিয়ন্ত্রণ হয়তো পেয়েছে পশ্চিম ওড়িশায় যুদ্ধ চলছে বহুদিন ধরে অথচ ঘটনা , এঁরা কেউই সর্বশক্তিমান ব্রাহ্মণ্য সামাজিক গ্রাসের উর্ধ্বে যেতে পারেননি এঁদের ইজরায়েলের নামদক্ষিণ কোসল  

    ছত্তিসগড়ের বাঙালিরা প্রথম এসেছিলেন বিলাসপুরে রেলের চাকুরে হিসেবে তার বহুদিন পরে ভিলাইতে লোহা কারখানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবশ্য ছিলেন রায়পুর, অম্বিকাপুর অন্যান্য নানা প্রান্তে কালীবাড়ি, সাহিত্য পরিষদ, রবীন্দ্রনাথ, লাল ঝাণ্ডা, দলাদলি সব কিছু নিয়ে বাঙালিরা বেশ জমিয়েই থেকে গিয়েছিলেন তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের এই অংশটিতে কিন্তু তাঁদের যাপনকথায় এই জলমাটির নির্যাস তেমনভাবে জমে ওঠেনি কিছু ছিল না, তা নয় বাংলাচর্চায় নাগপুরকেন্দ্রিক বিদর্ভ জঁর এবং তার সঙ্গে পাশের দক্ষিণ কোসলের ধরাছোঁয়া কিছু তো ছিল নিশ্চয়

    কিন্তু সঠিক আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেশের এই উল্লেখযোগ্য প্রান্তটির খতিয়ান বাংলাভাষায় সুলভ নয় প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন উল্লেখযোগ্য? উত্তরটি খুব সহজ ছত্তিসগড় এদেশের প্রাচীন কৌম সভ্যতার কেন্দ্র যাকে আর্যসংস্কৃতি অনার্যবলতেন এখানকার আদি অধিবাসী শবর, গোণ্ড, মারিয়া, মুরিয়া, ওঁরাও, মুণ্ডাদের বলা হত রাক্ষস, দানব, চণ্ডাল, পিশাচ এই অঞ্চলের প্রাচীনতম শ্রমজীবী শ্রেণী কর্মকার তন্তুবায় সম্প্রদায় ব্রাহ্মণ্য মতে তাঁরা ছিলেন নিম্নতম বর্ণের তালিকায় অথচ একহাজার বছর ধরে এখানে সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে কনউজিয়া আর সরযূপারিন ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের তুর্কি বা খ্রিস্টান শাসক নয়, এখানকার ভূমিসন্তানরা তুমুলভাবে নিপীড়িত হয়ে এসেছেনস্বদেশীয়বর্ণাশ্রমী, নিহিত স্বার্থবহিরাগতদের কবলগ্রস্ত হয়ে নিজেদের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ নয় তাঁদের বাধ্য করা হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য মূল্যবোধের অচেনা, জটিল, সামন্ততান্ত্রিক নিয়মকানুনকে স্বীকার করতে এই অনাচার থেকে জন্ম নিয়েছে ছত্তিসগড়ের সমাজজীবনে শিকড়ের খোঁজে অস্থির তোলপাড় যার প্রকাশ দেখা যাবে মাওবাদী কার্যকলাপ আর সালওয়া জুদুমের অবিরাম রক্তমোক্ষণে 

    • এই বিস্তৃত ভূখণ্ডটি এদেশের আদি কৌম সভ্যতার কেন্দ্র তার পর্বত-অরণ্য-নদী-মানুষের চতুষ্কোণ কখনও আর্য বা দ্রাবিড় সভ্যতার ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠতে পারেনি
    • এখানকার আদি অধিবাসী শবর, গোণ্ড, মারিয়া, মুরিয়া, ওঁরাও, মুণ্ডাদের বলা হত রাক্ষস, দানব, চণ্ডাল, পিশাচ
    • তাঁদের বাধ্য করা হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য মূল্যবোধের অচেনা, জটিল, সামন্ততান্ত্রিক নিয়মকানুনকে স্বীকার করতে এই অনাচার থেকে জন্ম নিয়েছে ছত্তিসগড়ের সমাজজীবনে শিকড়ের খোঁজে অস্থির তোলপাড় যার প্রকাশ দেখা যাবে মাওবাদী কার্যকলাপ আর সালওয়া জুদুমের অবিরাম রক্তমোক্ষণে 
    • কথক নিস্পৃহভাবে, সংক্ষেপে তাদের চালচিত্র এঁকে যাচ্ছেন তিনি ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘদিন দেশের এই প্রান্তের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে বিজড়িত স্পষ্ট বোঝা যায় কথাচিত্রগুলি আত্মজৈবনিক ব্যক্তি অভিজ্ঞতা তাঁকে সেই বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়েছে যা মহানগরবাসী, বেড়াতে আসা, পর্যটক বাঙালি কথাকারদের নাগালের বাইরে

    বাংলার মূলভূমি থেকে তেমন দূরে নয় এই প্রান্ত কিন্তু বাঙালির সর্বত্রগামী শিল্পসাহিত্যে এর অভিঘাত প্রায় কিছুই দেখা যায় না এই আফশোসটি মিটিয়ে দিয়েছেন রঞ্জন রায় তাঁর কথকতায় তাঁর প্রণীতছত্তিশগড়ের চালচিত্রগ্রন্থে আমরা পাই ছত্তিসগড়ের বহুস্তরীয় সমাজ ব্যক্তিযাপনের টানাপোড়েন ভরা বিশ্বস্ত দলিলগুলি গৌরচন্দ্রিকা পরিশিষ্ট বাদে এই বইয়ের দুটি ভাগ আছে প্রথম ভাগজলছবিএবং দ্বিতীয় ভাগজাতপাতের গল্পগাছা প্রথম ভাগের 'টি আখ্যান বর্ণনা করে ছত্তিসগড়ে ব্যক্তি সমাজজীবনের পারস্পরিক মন্থনের কাহিনী একজন তন্তুবায় সম্প্রদায়ের তরুণ স্বপ্নের চাকরি পেয়েছেন গ্রামীণ ব্যাঙ্কে পোস্টিং ছত্তিসগড়ের বিভিন্ন দূরতম, দুর্গম গ্রামীণ এলাকাগুলিতে সে নিজেও রায়পুরের মানুষ সভ্যমানুষের বিচারে নেহাত মফস্বল জায়গা প্রায় আধ শতক আগে তাই ছিল মানসিকতার দিক দিয়ে এখনও তাই উত্তমপুরুষে সে তার বাসভূমির ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ, অনুভব, অভিজ্ঞতা, প্রেম, ঘৃণা, ক্রোধ, বিস্ময় সব কিছু জড়িয়ে থাকা যাপনের বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে প্রাণবন্ত, বিশ্বস্ত, আকর্ষক সেই ধারাবিবরণী বাঙালি পাঠকের অচেনা, আধোচেনা, আলোআঁধার উপত্যকার গল্প পাত্রপাত্রীদের মধ্যে রয়েছে ব্রাহ্মণ জমিদার, শূদ্র পরিচারক, বৈশ্য দোকানদার, ‘জাতিহীনপুলিশ, প্রগলভা গণিকা, কুটিল ধর্মজীবী, অসহায় গ্রামীণ কৃষিজীবী পরিস্থিতির সঙ্গে সবাই বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে তাদের অবস্থান টিকে থাকার মরিয়া যুদ্ধে ডায়নামিক্সগুলি জায়গা বদল করে নিচ্ছে

    চাম্মু চামার, বুধরাম, হকলারাম, দ্রুপতীবাঈ, উত্তম সিং রনধাওয়া, উদ্যমেশ্বরশরণ মণিপালপ্রতাপ সিংহ, সোহনলাল, বুধবারিন বাঈ, চ্যাটার্জি, অজয় ডোঙ্গরে, তীজ কুঁয়র বা তুরতুরিয়া মঠের মোহান্ত এরকম অসংখ্য চরিত্র এখনও বাঙালি পাঠকের দহলিজ মাড়ায়নি কিন্তু আমাদের সামগ্রিক সাইকি-তে প্রবেশের জন্য তাদের দাবি কেউ অস্বীকার করতে পারেন না কথক নিস্পৃহভাবে, সংক্ষেপে তাদের চালচিত্র এঁকে যাচ্ছেন তিনি ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘদিন দেশের এই প্রান্তের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে বিজড়িত স্পষ্ট বোঝা যায় কথাচিত্রগুলি আত্মজৈবনিক ব্যক্তি অভিজ্ঞতা তাঁকে সেই বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়েছে যা মহানগরবাসী, বেড়াতে আসা, পর্যটক বাঙালি কথাকারদের নাগালের বাইরে এই প্রতিবেদক সত্যটি হয়তো একটু বেশি অনুভব করে কারণ তারও শিকড় রয়েছে কৌম ভারতের অন্য কেন্দ্র ঝাড়খণ্ড রাজ্যে   

       

    দ্বিতীয়ভাগে রয়েছে জাতপাতের গল্পগাছা সাতটি রচনার মাধ্যমে লেখক পেশ করেছেন ছত্তিসগড়ের বর্ণাশ্রমী যাপনের নিবিড় চিত্র এদেশের অন্যপ্রান্তের সঙ্গে তার কোনও তফাত নেই কিন্তু কোনও মেলোড্রামা নেই নেইচোখে আঙুল দাদাহওবার ত্বরিত প্রলোভন ধসে যাওয়া ব্রাহ্মণ্য মূল্যবোধের জালে নিশ্ছিদ্র জড়িয়ে থাকা অসহায় মানুষের নিরুপায় কষ্টভোগের দলিল সব দ্বান্দ্বিকতায় বিশ্বাস রাখা পাঠক হয়তো প্ররোচিত হবেন উত্তেজিতও কিন্তু বস্তুস্থিতিকে হিসেবে রেখেই মানুষকে রণকৌশল স্থির করতে হবে আরেকজন শংকর গুহনিয়োগির বলি এই সভ্যতা নিতে পারবে না আর লেখক তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে পিছনে রেখে শুধুআঁখো দেখা হালঅর্থাৎ নিরেট বস্তুস্থিতি পাঠককে উপহার দিয়েছেন আখ্যানভাগটি মূলত প্রচ্ছদ হলেও শুদ্ধ গল্পপিপাসীরা খুঁজে পাবেন কাহিনীর টান যেখানেসাসপেন্স-টেনশন-ট্যুইস্টে অভাব নেই এই খেলায় লেখক সফল হয়েছেন

    পরিশিষ্ট অংশটি মূল্যবান এই প্রতিবেদক প্রথমে গ্রন্থের অংশটিই পড়েছে চারটি পরিচ্ছেদে লেখক সংক্ষেপে ছত্তিসগড় বিষয়ক নানা জরুরি তথ্য গ্রন্থিত করেছেন সরসভাবে সাধারণ বাঙালি পাঠকের জন্যদূরতর দ্বীপছত্তিসগড়কে অন্দরমহলের স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পরিশিষ্টটির প্রয়োজন ছিল

    রঞ্জন রায় বাংলা কথাকার হিসেবে সুপরিচিত তাঁর রচিত বহু সমাদৃত গ্রন্থরাজি পাঠকদের নসিব হয়েছে আখ্যান রচনা করার কৌশল তাঁর করায়ত্ব এই গ্রন্থটিতে মাঝে মাঝে মনে হতে পারে ডকুমেন্টশনের প্রতি তাঁর অতিরিক্ত আগ্রহ রয়েছে হয়তো কাহিনি গড়ে তোলার পথেবিশ্বাসযোগ্যহয়ে ওঠার তাড়না লেখায় যৎসামান্য অতিকথনের প্রবণতা এনে দিচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা এটা ইচ্ছাকৃত ছত্তিসগড়ের বস্তুসত্যকে প্রকৃত মাত্রায় আত্মস্থ করতে চাইলে ঈষৎ অতিরিক্ত কথন জরুরি হয়ে পড়ে এখানে আর্য, তুর্কি বা ইংরেজ শাসনের কেন্দ্র ছিল না কখনও ছায়াচ্ছন্ন, বনজ, পার্বতী মায়াই তার সম্পদ তার অভিশাপ ক্রমান্বয়ে ক্ষমতাশালী বহিরাগতদের জুতোর নীচে নিষ্পেষিত হওয়া তারগল্পবস্তুর তৃতীয় মাত্রার মধ্যেই বেশি স্বচ্ছন্দ চতুর্থ মাত্রার বিলাসিতা তার নসিবে বিশেষ নেই

    রঞ্জন নিজের বিশ্বাস থেকে এঁকে গেছেন চালচিত্রের পট প্রতিমাকে তিনি প্রকট করতে চাননি যে কোনও সংবেদনশীল কথাকারের মতো কিন্তু পাঠক খুঁজে নেবেন নিজের মতো করে তিনি বঙ্কিমের ষড়ৈশ্বর্যশালিনী দেবী মূর্তি হতে পারেন হতে পারেন জয়নাল আবেদিনের কালিকলমে আঁকা আকালের নিরন্ন মাতৃমূর্তি তিনি যেই হোন, ভারতবর্ষের নিঃসীম ঐতিহ্যের পতাকা, রঞ্জন তাঁর হাতে সফলভাবে তুলে দিয়েছেন     


     

     


    শিবাংশু দে - এর অন্যান্য লেখা


    তঁহু যাবে, মহু যাবো, রাজিম কে মেলা…

    অনুমান করা হয় হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় শৈলীতে এই রাগটি এসেছিলো সুফি সাধকদের দৌলতে

    ‘ছত্তিশগড়ের চালচিত্র’ : একটি দ্বান্দ্বিক পাঠ-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested