1919 সালের জুন-জুলাই মাসে, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের পরে, বেশ কয়েকবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরে এন্ড্রুজ পাঞ্জাবে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিলেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল হান্টার কমিশনের জন্য রিপোর্ট তৈরি করতে।
পাঞ্জাবের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময় দরিদ্র, অত্যাচারিত, অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার দেখে, তাঁর সঙ্গী গুরুদয়াল মল্লিকের মনে হয়েছিল, CFA তো শুধু চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজের আদ্যক্ষর নয়, CFA মানে Christ’s Faithful Apostle। অনন্যসাধারণ খ্রিষ্টভক্ত ভারতবর্ষপ্রেমী এই মানুষটির কাছে খ্রিষ্টের কাজ আর পৃথিবীর সমস্ত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কাজ একাকার হয়ে গিয়েছিল
1940 সালে এন্ড্রুজের মৃত্যুর পরে, শান্তিনিকেতনে তাঁর লেখার টেবিলের ওপর একটি পান্ডুলিপি পাওয়া যায়, যা 1942 সালে The Sermon on the Mount নামে প্রকাশিত হয়। এন্ড্রুজকে তাঁর জনৈক ভারতীয় এবং হিন্দু বন্ধু কোনও এক সময়ে অনুরোধ করেছিলেন সহজবোধ্য ভাষায় খ্রিষ্টের একটি জীবনী লিখতে। এন্ড্রুজ নিজেও বিশ্বাস করতেন এই বই লেখার মতো যোগ্যতা তাঁর আছে, কারণ প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য এই দুই সভ্যতা আর সংস্কৃতির মধ্যে তাঁর অবাধ যাতায়াত। কিন্তু হাতে তাঁর সময় কোথায়? 1938 সালে বোম্বে থেকে তিনি চিঠি লিখছেন, “...a whole week gone with no writing done; but it is worth it. What is the good of writing about Christ if one is doing what is not Christ-like?”
কিন্তু কোন কাজ Christ-like আর কোনটা নয়? দক্ষিণ আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকা, উগান্ডা, কেনিয়া, চিন, ফিজি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাঞ্জাব, ত্রিবাঙ্কুর– কলেরা, গুটি বসন্ত, চুক্তিবদ্ধ শ্রম– যখন যেখানে ডাক পড়েছে, চার্লি এন্ড্রুজ দৌড়েছে। তাঁর কর্মকান্ডে ইংল্যান্ডবাসীরা খুশি হয়নি। পুলিশের খাতায় নাম উঠেছে, CID তাঁর ঘরে তাঁর ব্যক্তিগত কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। তাঁর মা অসুস্থ শুনেও, মায়ের সঙ্গে আর দেখা হবে না জেনেও, তিনি ইংল্যান্ডে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেও, কাজের টানে চলে গেছেন আফ্রিকা। এইটাই যে তাঁর কাজ, এটা কে তাঁকে বলে দিয়েছিল? তিনি তো ভারতবর্ষে নাও আসতে পারতেন। বা আসার পরেও দিল্লির St Stephen’s College-এর প্রিন্সিপাল হয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। অখ্রিষ্টানদের মধ্যে শিক্ষার আলো বিতরণ কি প্রকৃত খ্রিষ্টানের কাজ নয়?
এন্ড্রুজের বাবা-মা অত্যন্ত সাধারণ অবস্থায় অনেকগুলি ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছিলেন। তাঁরা Catholic Apostolic Church-এ যেতেন। চার্লির বাবা চেয়েছিলেন যে, ছেলে সেই চার্চেরই ধর্মযাজকের পদ গ্রহণ করুক। অথচ কেমব্রিজ প্রধানত অ্যাংলিক্যান। বাড়ি এবং কলেজের বিপরীত ধর্মীয় পরিবেশ-জনিত মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে দু’জনের সান্নিধ্য চার্লিকে ভবিষ্যতের জন্যে তৈরি করতে থাকে– চার্লস প্রায়র, কেমব্রিজের টিউটর, আর বেসিল ওয়েস্টকট, বিশপ ওয়েস্টকটের ছোট ছেলে। বেসিলের অসময়ের মৃত্যু চার্লির সামনে ভারতবর্ষে আসার পথ তৈরি করে দেয়। তবে সে আরও পরের কথা। কেমব্রিজে থাকাকালীন বিশপ ওয়েস্টকট, যাঁকে বলা হত Christian Socialist, তিনি হয়ে ওঠেন চার্লির রোল মডেল। বিশপের বক্তব্য ছিল যে, সমসাময়িক রাজনৈতিক বা সামাজিক সমস্যা সম্বন্ধে চার্চ কখনওই চোখ বুজে থাকতে পারে না; তবে সমস্যার সমাধান হতে হবে খ্রিষ্টান মতে।
একদিকে বিশপ ওয়েস্টকটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, Christian Social Union-এর কেমব্রিজ শাখার তিনি সেক্রেটারি, আবার অন্যদিকে একুশ বছর বয়স হওয়ার পরেই বাড়ির চাপে Catholic Apostolic Church-এ সার্ভিসের ব্রত নেওয়া– এই টানাপোড়েনের চাপ চার্লি শারীরিক পরিশ্রম ও খেলাধুলোর মধ্যে দিয়ে মোকাবিলা করার চেষ্টা করতেন। তার মধ্যে পড়াশোনাতে কোনও অবহেলা ছিল না। যে সময়ে যা পরীক্ষা দিয়েছেন, তাতেই চূড়ান্ত সফল। অবশেষে 1895 সালে তিনি ক্যাথলিক চার্চ ত্যাগ করে অ্যাংলিক্যান চার্চের সদস্য হলেন। তাঁর জীবনের একটা অস্থিরতার সমাপ্তি ঘটল। এর ফলে বাড়ির সঙ্গে তাঁর একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছিল, যদিও স্নেহ-ভালবাসায় কোনও ঘাটতি ছিল না।
একটা অস্থিরতা পর্ব পেরিয়ে এসে চার্লির সামনে আবার আর একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় উপস্থিত হল– তিনি ধর্মযাজকের কাজ করবেন নাকি মিশনারি হয়ে কোনও বিদেশ যাবেন? চার্লি ছিলেন কেমব্রিজের পেমব্রোক কলেজের ছাত্র। তারা লন্ডনের একটা ঘিঞ্জি, দরিদ্র, অপরাধপ্রবণ এলাকায় একটা মিশন চালাত। চার্লি সেখানে প্রায় তিন বছর কাজ করার পর ভগ্ন শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তারপর আবার ফিরে এলেন কেমব্রিজে। 1900 সালে পরপর হারালেন দুই প্রিয়জন চার্লস প্রায়র আর বেসিলকে। বেসিল দিল্লির St Stephen’s College-এর Vice-Principal ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে চার্লির মন ভারতবর্ষের দিকে ফিরল। কলেজেরও প্রয়োজন ছিল তাঁকে।
এই সময়ে নানান সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ে চার্লির মনোভাব কেমন ছিল? এককথায় বলা যেতে পারে তৎকালীন কেমব্রিজ থেকে পাশ করা ছাত্রদের মধ্যে প্রচলিত ধারণার মতোই- রাজভক্ত, চার্চমুগ্ধ, অ্যাংলিক্যান চার্চের সমস্ত খুঁটিনাটি নিয়মে নিষ্ঠ, রক্ষণশীল, সাম্রাজ্যবাদের বিষাক্ত আবহাওয়া সম্বন্ধে প্রায় অজ্ঞ। 1900 সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বুওর যুদ্ধ চলছে। চার্লি চিঠি লিখছেন “We are all delighted at Roberts crossing the Vaal on the Queen’s birthday.” 1903 সালের মে মাসে চার্লস এন্ড্রুজ সরকারিভাবে St Stephen’s College-এ যোগ দেওয়ার জন্য আবেদনপত্র পাঠালেন, যা জুলাই মাসে গৃহীত হল। 1904 সালের 20 মার্চ এন্ড্রুজ ভারতবর্ষের মাটিতে পা দিলেন।
“There is a second birthday in my own life which has now been kept fresh in my memory ... for nearly thirty years with deep thankfulness to God... A common word, dwija, can be found in most North Indian languages, ... In a very real sense I have been a dwija, because my life has been cut in two.” প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যর বৈপরীত্য তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল বৈকি! কিন্তু এই দেশে প্রথম কয়েক বছর এন্ড্রুজ হয়তো অন্যান্য মিশনারিদের চেয়ে খুব আলাদা ছিলেন না। ধর্মতত্ত্ব নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন তিনি এই সময়ে- বাইবেল এবং হিন্দু আর ইসলাম ধর্মগ্রন্থ, সবই। বুদ্ধ আর কৃষ্ণকে নিয়ে অনেক বই পড়তে পড়তে তাঁর মনে হয়েছে হয়তো খ্রিষ্ট সম্বন্ধেও এইরকম অনেক গল্প তৈরি হয়েছে, হয়তো খ্রিষ্টকে নিয়েও চার্চের ভাবনার বাইরে নতুন ভাবনার অবকাশ রয়েছে। তাঁর প্রথম বন্ধু এবং এক অর্থে অভিভাবক, St Stephen’s College-এর প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ সুশীল রুদ্রের একটি কথা তিনি তখন সত্যি বলেই মনে করতেন, “To India would come at last in Christ that centre of unity which it so surely needs. India’s children would gain in Christ the full fruition of their new-found national consciousness. A great Indian Church would become possible, and therefore a great Indian nation.” দশ বছর লেগেছিল এন্ড্রুজের এই কথা স্বীকার করে নিতে যে, Indian church তো ভারতের নিজস্ব চিন্তার ফসল নয়, সে কোনওদিনই ভারতবর্ষের আশা পূরণে সক্ষম হবে না। 1914 সালের 16 আগস্ট এন্ড্রুজ Anglican clergyman-এর বন্ধন থেকে পরিপূর্ণ মুক্তি নিলেন। তার আগেই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় গেছেন ভারতবর্ষ থেকে, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিয়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নামক একজনের সত্যাগ্রহ নামে একটি নতুন আন্দোলনের ধারা প্রত্যক্ষ করতে।
মুক্তি সহজ ছিল না। “It was not easy to get rid of certain deep-rooted prejudices which I had inherited from my youth up. For my father’s conservative view of India as a ‘British possession’ had got farther into my subconscious thoughts than I liked to imagine.” কিন্তু খ্রিষ্টের নামে বিভিন্ন চার্চের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর বিশেষ করে White Racism তাঁকে রীতিমতো পীড়া দিচ্ছিল। সুশীল রুদ্রের পরিবারভুক্ত হওয়া, খ্রিষ্টান ভিন্ন অন্যান্য ধর্মের ধার্মিক ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিতি এবং 1905 সালের পর থেকে ভারতের রাজনৈতিক বাতাবরণ এন্ড্রুজকে একের পর এক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। 1907 সালে লালা লাজপত রায়ের গ্রেপ্তার হওয়া, সুশীল রুদ্রকে কলেজের অধ্যক্ষ করার বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের তীব্র আপত্তি, গোখলের সঙ্গে পত্রালাপ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের Modern Review-তে প্রবন্ধ লেখা, কলেজের ছাত্রদের স্পষ্ট ব্রিটিশদের বিরুদ্ধাচরণ– নানান ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত ও প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে এন্ড্রুজ যেমন ভারতীয় বন্ধু পাচ্ছেন, তেমনই ব্রিটিশদের বিরাগভাজন হচ্ছেন। 1906 সালে তাঁকে কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনে আমন্ত্রণ জানানো হয়; তিনি এসেও ছিলেন, যদিও বেশি সময় কাটিয়েছিলেন কলকাতার অন্যান্য ধর্মযাজকদের সঙ্গে আলাপ করে। এই অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে একজন সুপুরুষ সুদর্শন কবি ও গায়কের উপস্থিতির কথা কিন্তু এন্ড্রুজের কোনও লেখার মধ্যে পাওয়া যায় না। 1912 সালের 30 জুন (মতান্তরে 7 জুলাই) যে রবীন্দ্রবাবুর ইংরেজি গীতাঞ্জলির কবিতা শুনে তিনি সারা রাত লন্ডনের রাস্তায় হেঁটে বেড়াবেন, লিখবেন, “The stars looked down in silence as if longing to speak and sympathise. There, all alone, I could at last think out the wonder of it – the wonder of the unity of the universal human heart, the mystery of the one spirit of the human race.” তাঁর সঙ্গে কোনওরকম পরিচয়ই এন্ড্রুজের তখন হয়নি।
1912 সালে পরিচয় হওয়া মাত্রই দু’জনে দু’জনকে পরম বন্ধু বলে গ্রহণ করলেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে এন্ড্রুজ শান্তিনিকেতনে এসেছেন, থেকেছেন, কিন্তু কখনওই অনেক দিনের জন্য নয়। এক জায়গায় বেশি সময় কাটানো তাঁর ধাতুতেই ছিল না! যদিও চার্চের বন্ধন থেকে মুক্তি নেওয়ার সময় তিনি বিশপকে লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনে এসেই তাঁর কাছে ভবিষ্যতের কর্মপথ পরিষ্কার হয়ে গেছে। “I find I can no longer continue my ministerial duties on account of difficulties of belief. I do not mean that my fundamental Christian position is shaken – it is not ... but I find myself less and less able to subscribe to the Prayer Book formulae and therefore in all honesty feel that I must withdraw.” চার্লির জীবন আরও একটা বড় বাঁক নিল। এরপরে চার্লস এন্ড্রুজের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক যোগাযোগ ঘনিষ্ঠতর হয়েছে, যদিও তাঁর কাছে এই সংযোগের কারণ ছিল অত্যাচারিত দীনদরিদ্রদের জীবনে কিছু শুভ পরিবর্তনের সূচনা করা।
What I owe to Christ by C F Andrews
The Sermon on the Mount by C F Andrews
The Ordeal of Love: C F Andrews and India by Hugh Tinker
উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় একবিংশ শতাব্দীর কাবুলের মতোই নারী শিক্ষার পথে ছিল বিপুল বাধা।
চালের অঙ্কে জল মেশানো, লবণের হিসেব থেকে জনসংখ্যার পরিমাপ করলেন প্রশান্তচন্দ্র
সন্তানহীনা নারী বিয়ে বা পুজো বা আর কোনও মঙ্গলকর্মের অধিকারিণী নন, ঘরেও তার অনাদর।
থোড় বড়ি খাড়ার সাম্রাজ্যে নাক গলাতে পারেনি করোনা ভাইরাস।
দেশ স্বাধীনতার 75 বছরে পা দিলেও দেশের মহিলাদের একাংশ এখনও স্বাধীনতা হীনতায়ই বাঁচতে চায়।
মানুষের ও দেশের সেবাকেই ধর্ম হিসেবে বরণ করেছিলেন সিএফ এন্ড্রুজ।