বাংলা ছড়ার সবচেয়ে পরিচিত রূপ হল ছেলেভুলানো ছড়া— যে ছড়ায় কোলের সন্তানকে, অবশ্যই পুত্র সন্তানকে — আদর করা হচ্ছে। এখানে ছড়া বলতে আমি লোক-ছড়া বোঝাতে চাইছি, যার কোনও রচয়িতার সন্ধান করা যায় না, সন্ধান করলেও পাওয়া যায় না। লোকসাহিত্যের অন্তর্গত সব ছড়াকেই ছেলেভুলানো ছড়া বা মেয়েলি ছড়া বলে মনে করা হয়, যদিও শিশুকে আদর জানানো ছাড়াও অনেক বক্তব্যই এইসব ছড়াগুলির মধ্যে পাওয়া যায়। আপাতত শুধু ছেলেভুলানোই যে সব ছড়ার উদ্দেশ্য, সেগুলির আলোচনা করা যাক।
বাংলা ছড়াগুলির বয়স কত? মনে হয় না এগুলি সুপ্রাচীন, হয়তো চার-পাঁচশো বছর মাত্র। বয়সের হিসেবে বিশেষ কিছু এসে যায় না, কারণ বাঙালি সমাজে তো অনেক বছর ধরেই বিরাট পরিবর্তন আসেনি। একটা বড় ধাক্কা এসেছিল একাদশ শতাব্দীতে, মুসলমান আক্রমণের সময়ে। তার পরের বড় ঢেউ এল অষ্টাদশ শতকে, ইংরেজ রাজত্ব-বিস্তারের সময়ে। মাঝখানের এই সাতশো-আটশো বছরে বাঙালি সমাজের বুনটে বিশেষ পরিবর্তন আসেনি। ইতিহাসের আদিযুগ থেকেই বাঙালি সমাজ প্রধানত কৃষিজীবী; বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ইত্যাদি নানা সামাজিক ব্যাধিগ্রস্ত। লোকসাহিত্যকে মনে করা হয় সমাজের আয়না, সমাজের বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখা কথা। কে প্রথমে কোন ছড়া বলেছে কেউ জানে না। যেই বলে থাকুক, সে আরও অনেকের মনের কথা বলেছে; তাই সেগুলি মুখে মুখে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে, অনেক শতক পেরিয়ে অবশেষে এসে পৌঁছেছে আমাদের সামনে, বিভিন্ন সংকলনের মাধ্যেমে।
ছড়া কে বলে? কেন বলে? বহুদিন পর্যন্ত পণ্ডিত সমাজে ধারণা ছিল বাংলা ছড়া, যা লোকমুখে প্রচলিত, তা বলে শুধুমাত্র মেয়েরা, আর বলে বাচ্চাদের মনোরঞ্জন করতে, তাদের খাওয়াতে, ঘুম পাড়াতে, তাদের সঙ্গে খেলতে, তাদের নিয়ে সময় কাটাতে। গ্রামের কৃষক পরিবারে, সন্ধের সময়ে মা-ঠাকুমারা ছড়া বলে, রূপকথার গল্প বলে ছোটদের ভুলিয়ে রাখতেন, যতক্ষণ না খেয়েদেয়ে তারা রাতের মত ঘুমিয়ে পড়ে। কী কথা থাকত সেই ছড়াতে? যদিও বাঙালি পরিবার যৌথ পরিবার, তবু একেবারে কচি বাচ্চাদের দেখাশোনার প্রধান দায়িত্ব নিশ্চয়ই ছিল সদ্য-কিশোরী মায়ের। তার মানে যে ছড়া বলা হত, সেগুলিকে মায়েদের মনের-প্রাণের কথা বলে মেনে নেওয়া যায়। যেহেতু লোক-ছড়া মুখে মুখে তৈরি হয়, কেউ লিখে রাখে না, জোর করে মুখস্থ করার কোনও প্রশ্নই নেই, সেই সব ছড়াই দিদিমা-মা-মেয়ে-নাতনির পরম্পরা ধরে চলে, যা তাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
শিশু সম্পর্কিত ছড়াগুলিতে শিশুর বর্ণনার চেয়ে অনেক বেশি আছে মায়ের মনের আকাঙ্ক্ষা। ছোট্ট খোকনকে কোলে নিয়ে মা স্বপ্ন দেখেন খোকনমণি বড় হয়ে বসবে সিংহাসনে। বেশির ভাগ সময়েই কিন্তু চাহিদাগুলি এত বাস্তবমুখী হয় না। সন্তানের জন্য জননীর মনস্কামনার মধ্যে ফুটে উঠেছে সমকালীন সমাজের চাহিদা, আদর্শ ও মূল্যবোধের খণ্ডচিত্র। সন্তানহীনা নারী বিয়ে বা পুজো বা আর কোনও মঙ্গলকর্মের অধিকারিণী নন, ঘরেও তার অনাদর। কোনও এক গর্ভধারিণী বলছেন:
যখন পুঁটু আমার হয়নি, ভিখারিতে ভিখ নেয়নি। ভাগ্যে পুঁটু হয়েছে, ভিখারিতে ভিখ নিয়েছে।।
আর এ তো জানা কথাই যে বন্ধ্যাত্বের সব দোষই নারীর, পুরুষের ক্লীবত্ব— সে অসম্ভব! সন্তান কামনায় পুজো-উপবাস আর সন্তানেই জীবনের চরম সার্থকতা, এমন ভাবনা বোধহয় পৃথিবীর আর কোনও দেশেই নেই।
কত মুনির মনস্তাপ, কত কাত্যায়নীর জপ। কত উপোষ মাসে মাসে, তবে ধন এসেছে দেশে।।
এত ব্রত-পার্বণের পর প্রথম সন্তানের মুখ দেখেই মায়ের পরম তৃপ্তি।
গঙ্গাজলে বিল্বদলে জপ করেছি কত। তাই তো সোনা চাঁদের কণা পেয়েছি মনের মত।।
ধনকে নিয়ে বনকে যাব আর করিব কী। বিরলে বসিয়ে ধনের মুখ নিরখি।।
একটি সন্তান হলেই যে বাঙালি মেয়েরা তাকে জীবনের একমাত্র সার্থকতার পরিমাপ হিসেবে দেখে, তার প্রমাণ ভূরি ভূরি।
ধন-ধোনা-ধন-ধন। এমন ধন যার ঘরে নেই তার বৃথাই জীবন।।
কিংবা
আমার কত দুখের ধন। দুঃখ-হরা দুখ-পাসরা দুঃখ-নিবারণ।।
একটি সন্তানে কিন্তু জননীর তৃপ্তি নেই। শতপুত্রের জননী হবার আশীর্বাদ বাঙালি মায়েদের রক্তের মধ্যে মিশে আছে। বহুপুত্রবতী রমণীর সম্মান সংসারে সবার উপরে।
কি ধন কি ধন বেণে। কে দিল তোমায় এনে?
তার নাগাল যধি পেতাম, তোমার মত সোনার চাঁদ আর গোটা দুই চেতাম (চাইতাম)।।
দ্বিতীয় আর একটি ছড়া:
কত সাগর মন্থন করে এ ধন পেয়েছি আমরা। আবার যদি পাই, তো সবাই মিলে যাই।।
কোলের শিশুকে সত্যিই দেবতার সম্মান দেওয়া হচ্ছে। সাধে কি আর রবীন্দ্রনাথ এই গোত্রের ছড়াগুলিকে শিশুস্তব বলেছেন? দেবতার স্তবের উদ্দেশ্য দৈবপ্রসাদ লাভ করা এবং দৈবরোষ থেকে নিষ্কৃতিষ শিশুস্তবের উদ্দেশ্য কি হতে পারে?
অল্প বয়সে বিবাহিত শ্বশুর-পরিবারের শাসন ও নানান বিধিনিষেধের জালে আবদ্ধ থাকার পর বালিকা বধূর কিঞ্চিৎ আদরযত্ন জোটে সন্তানের মা হিসেবে। সব দেশে, সব কালে, সব সমাজেই শিশু অত্যন্ত আদরণীয়। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে শিশুপুত্রের আদরের তো কোনও তুলনাই নেই। এক তো শিশুর মধ্যে দিয়ে বংশ পরম্পরা বজায় থাকবে। দ্বিতীয়ত ছোট্টবেলা থেকে বাঙালি মেয়েদের ব্রতের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয় যে, নারীজীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য পুত্রসন্তানকে স্বামীর কোলে তুলে দেওয়া। পুণ্যিপুকুর ব্রতে কুমারী কন্যা আর বধূ দু'জনেই প্রার্থনা করে:
পুত্র রেখে স্বামীর কোলে। মরণ যেন হয় গঙ্গাজলে।।
সদ্য-কিশোরী বধূর নিজের মনেও ভীতি থাকে যে অন্তত একটি পুত্রের জন্ম দিতে না পারলে সপত্নী সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। তাছাড়া বাংলাদেশে প্রসূতি ও শিশু মৃত্যু হার খুবই বেশি ছিল। সুস্থ শিশুকে কোলে নিয়ে সুস্থ জননীর মনে হতেই পারে যে পূর্বজন্মের পুণ্যফলে দু'জনেই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। শিশুর প্রতি ভালবাসা যে বাঙালি মায়ের মধ্যে শুধু প্রাকৃতিক নিয়মেই উছলে ওঠে তা নয়, সামাজিক অবস্থা এমনই যে পুত্রভাগ্যেই রমনীর সামাজিক মূল্য ও গ্রহণযোগ্যতা।
খোকা একটু বড় হয়ে ওঠার পর কিন্তু পাড়াপ্রতিবেশী বা ঘরের ননদ-জা-ভাজের ছেলেদের সঙ্গে তুলনা ও ভালমন্দ বিচার চলতে থাকে। জননীর কাছে তাঁর ছেলেটি তো সর্বাঙ্গসুন্দর বটেই।
পরের ছেলে – ছেলেটা, খায় যেন এতটা, নাচে যেন বাঁদরটা।
আমার ছেলে – ছেলেটি, খায় যেন এতটি, নাচে যেন ঠাকুরটি।।
কোলের ঠাকুর ক্রমশ রক্তমাংসের মানুষ হয়ে ওঠে। ছড়াগুলিও শিশুস্তবের মহিমান্বিত বেদী থেকে মাটির কাছাকাছি নেমে আসে। আরও বড় ছেলেদের পাঠশালায় পড়তে যাওয়ার কথাও খুঁজে পাওয়া যায়।
রাত পোহালো, মণি জাগিল, কোকিল করে রা। দুধু খেযে যাদুমণি পড়নেতে যা।।
তবে লেখাপড়া করার ছড়া খুব বেশি দেখি না। তার একটা কারণ গ্রামে লেখাপড়ার চর্চা সামান্যই হত। আর মেয়েরা তো সবাই প্রায় অক্ষরপরিচয়হীনা। বাচ্চারা যতক্ষণ ঘরের মধ্যে তাদের কোলে-কাঁখে থাকে, তাদের জীবনের সঙ্গে মায়ের জীবনের যোগ থাকে। পাঠশালা পর্বে ছেলেরা অন্দর ছেড়ে সদর-মুখো, মায়েদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীয়মান। ততদিনে হয়তো পরেরটি এসে মায়ের স্নেহে ভাগ বসিয়েছে। অতএব ছড়ার প্রবাহ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়েছে।
তা সত্ত্বেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। ইংরেজি nursery rhymes-এর মধ্যে এক ধরনের ছড়া পাই যেখানে বাচ্চাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ চিনিয়ে দেওয়া হচ্ছে খেলার মাধ্যমে।
Eye winker, Tom tinker, Nose smeller, Mouth eater, Chin chopper, Guzzlewopper.
অথবা
Toe, trip and go; Heel, tread a bank; Shin, shinny shank; Knee, knick a knick;
Thigh, thick a thack; Tummy, trouble us, trouble us.
এই ধরনের ছড়া বাংলা লোকসাহিত্যে একেবারেই অনুপস্থিত। মাত্র একটা ছড়ার কথাই মনে পড়ছে, সেটাকেও ছেলেভুলানো ছড়া না বলে হয়তো ধাঁধাই বলা উচিত।
নলা নলা দুটি নলা; তার উপরে ভাতের জালা; তার উপরে চৌকি; তার উপরে খাও কি;
তার উপরে ফোঁসফোঁসানি; তার উপরে ড্যাবড্যাবানি; তার উপরে গড়ের মাঠ; গড়ের মাঠে কালো ঘাস;
তাতে আবার চরে হাঁস।।
কোনও ধরণের শিক্ষামূলক বিষয়বস্তু বাচ্চাদের জন্য বলা বাংলা ছড়ার মধ্যে একদমই পাই না। এর সহজ উত্তর হতে পারত যে বাঙালি মায়েরা শিক্ষিত ছিল না, তাই বাচ্চাদের কোনও কিছু শেখানোর দায়িত্ব তাদের হাতে কেমন করে থাকবে? কিন্তু এত সরল উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারছি না। ইউরোপিয়ান মহিলারাও যে রেনেসাঁসের যুগে অনেক শিক্ষার সুযোগ পেত, এমন তো নয়। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে গ্রামের মেয়েরা, যারা এই nursery rhymes বলত, তারাও বেশির ভাগই অক্ষরপরিচয়হীনা ছিল। কিন্তু একটি সন্তান পেলেই তাদের জীবন ধন্য হয়ে যেত না, সামাজিক মূল্য তাদের ছিল বাঙালি মেয়েদের চেয়ে বেশি। তাই হয়তো ধনের মুখ নিরীক্ষণের পরেও তারা সন্তানকে কিছু শেখানার চেষ্টা করতেন, একেবারে ঠাকুরের সিংহাসনে বসিয়ে রাখার দরকার হত না।
যে ধরনের বাংলা ছড়ার অস্তিত্ব একেবারেই নেই, তা হল, বাচ্চাদের নিজের মুখের বলা ছড়া, অর্থাৎ উত্তরপুরুষে বলা। একটা উদাহরণ দিলে ভাল বোঝা যাবে।
Jack and Jill went up the hill, to fetch a pail of water.
Jack fell down and broke his crown, and Jill came tumbling after.
অতি পরিচিত ইংরেজি ছড়া। এখানে ঘটনাটা কোনও এক দর্শকের মুখে বর্ণনা করা হয়েছে।
কিন্তু যখনই বলা হচ্ছে
Twinkle twinkle little star; How I wonder what you are.
তখন বক্তা নিজের কথা নিজেই বলছে।
অথবা
Pat-a-cake, pat-a-cake baker’s man. Bake me a cake as fast as you can.
এই ছড়াতেও যার কেক খাবার ইচ্ছে হয়েছে সে-ই গেছে দোকানে। বাংলা ছড়ায় বাচ্চাদের নিজের কোনও কার্যকলাপ কিন্তু দেখতে পাই না। বাংলাতে তো খোকাবাবুর খাওয়া নামক কাজটি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু সে সবই আমরা জানছি মায়ের মুখে। এমনকী Little Jack Horner-এর মতও দেখি না, যেখানে তার কোনায় বসে ক্রিসমাস পাই খাওয়ার গল্প অন্য কেউ বললেও তার নিজের গলাও একবার শোনা গেল
What a good boy am I!
সেইটুকুও বাংলা ছড়ায় দেখি না। তাহলে কি ধরে নিতে হবে খোকনসোনা চিরকাল মায়ের খোকা হয়েই রয়ে যাবেন, তাঁর মুখে বাক্যস্ফূর্তি আর হবে না?
সন্তানহীনা নারী বিয়ে বা পুজো বা আর কোনও মঙ্গলকর্মের অধিকারিণী নন, ঘরেও তার অনাদর।
দেশ স্বাধীনতার 75 বছরে পা দিলেও দেশের মহিলাদের একাংশ এখনও স্বাধীনতা হীনতায়ই বাঁচতে চায়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা স্নাতক চন্দ্রমুখী বসুর শেষ জীবন কেটেছিল দেরাদুনে, সকলের অন্তরালে।
চালের অঙ্কে জল মেশানো, লবণের হিসেব থেকে জনসংখ্যার পরিমাপ করলেন প্রশান্তচন্দ্র
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার হিসেবে কোভিডের সময় ভারতে অতিরিক্ত মৃত্যুর তথ্য মানতে নারাজ সরকার।
থোড় বড়ি খাড়ার সাম্রাজ্যে নাক গলাতে পারেনি করোনা ভাইরাস।