×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • এক দিন বের হব বলেই আজ ঘরে বন্দি

    অভীক রায় | 09-04-2020

    'গুজারিশ' ছবির একটি দৃশ্য

    হলভর্তি দর্শকের সামনে জাদুকর ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন মোমবাতির জ্বলন্ত শিখাটিকে। গ্যাসবেলুনের মতো শিখাটি ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করল উপরের দিকে। হঠাৎই সবাইকে স্তম্ভিত করে, নিজের শরীরটাকে শূন্যে ভাসিয়ে দিলেন জাদুকর। পিছু নিলেন শিখাটির। সেটিকে আবার মোমবাতির শরীরে ফিরিয়ে আনবেন বলে। প্রায় ফিরিয়ে এনেছিলেন, ঠিক এমন সময় মঞ্চের পিছনে এক আজ্ঞাবহ হাত কেটে দিল সেই শক্ত ধাতব তারটা, যার সাহায্যে সবাইকে বোকা বানিয়ে জাদুকরের এই উত্থান। নীচে থাকা একটা বড় জলভর্তি কাঁচের বাক্সে টুপ করে খসে পড়ল জাদুকরের শরীরটা। মাথাটা সজোরে ধাক্কা খেল কাঁচের বাক্সের শক্ত মেঝেতে। মুচড়ে গেল ঘাড়টা।
     
    আজ প্রায় আঠারো দিন হল আমরা‌ সবাই গৃহবন্দি। আরও কতদিন এইভাবে কাটাতে হবে আমরা কেউ জানি না। কাজে যেতে পারছি না। বাইরে বের হতে পারছি না। আড্ডা দিতে পারছি না। তবে আমাদের হাত নড়ছে। পা নড়ছে। মশা কামড়ালে মশাটাকে মারতে পারছি। কিন্তু ইথান এসব কিছুই পারতেন না। ইথান মাসকারেনহাস। গোয়ার এক প্রাসাদোপম বাড়িতে গৃহবন্দি থাকা, এক থমকে যাওয়া জাদুকর। হাত, পা, আঙুল কিছুই নড়ত না তাঁর। সবচেয়ে কাছের বন্ধুর ঈর্ষা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে, এক দুর্ঘটনার ফলে চোদ্দ বছর জড়পদার্থের মতো পড়েছিলেন বিছানায়। রোগটার নাম প্যারাপ্লেজিয়া। মেরুদণ্ডে আঘাত লাগার ফলে নিম্নাঙ্গে পক্ষাঘাত। তাই কখন প্রস্রাব হচ্ছে, কখন মলত্যাগ হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারতেন না ইথান।
     
    তবে ইথানের একজন সোফিয়া ছিলেন। পাথরের মতো স্থির জীবনে ইথান পাশে পেয়েছিলেন তাঁকে। সোফিয়া ডি'সুজা। বারো বছর ধরে প্রত্যেকদিন ইথানের পরিচর্যা করতে আসতেন নিয়ম করে। সকালবেলা ঘুম থেকে তুলে দাঁত মাজিয়ে দেওয়া, স্নান করিয়ে দেওয়া, খবরের কাগজ পড়ে শোনানো, খাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে রাতে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া অবধি ইথানের পাশে‌‌ থাকতেন তিনি।
     
    কিডনি বিকল হয়েছিল আগেই। শ্বাসযন্ত্রটাও বিকল হওয়ার পথে। এমন সময় হঠাৎই একদিন সকালবেলা নিজস্ব উকিলকে ডেকে ইথান ইচ্ছা প্রকাশ করলেন ইউথানশিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর। সেই ইথান যে হুইলচেয়ারে বসে নিজের সঞ্চালনা করা রেডিও শোয়ের মাধ্যমে প্রত্যেকদিন সবার মধ্যে প্রাণখুলে বাঁচার শক্তি ছড়িয়ে দেন। আদালত মানল না কিছুতেই। পিটিশনের পর পিটিশন দিয়েও লাভ হল না। এই নিশ্চল জীবন থেকে ইথানকে মুক্তি দেওয়ার জন্য এগিয়ে এল না কেউ।
     
    তবে ইথানের একজন সোফিয়া ছিলেন। নিস্তরঙ্গ জীবনের শেষবেলায় ইথান পাশে পেয়েছিলেন তাঁকে। বিবাহ বিচ্ছেদের মামলায় জিতে ফেরা সোফিয়া, নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন ইথানকে জীবন থেকে মুক্তি দেওয়ার। জেল হতে পারে জানা সত্ত্বেও। এর বিনিময়ে সোফিয়াকে দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না ইথানের কাছে। তাই উপহার স্বরূপ নিজের পদবীটুকু সোফিয়াকে দিতে চেয়েছিলেন ইথান। "ইউ ক্যান কল মি মিসেস. মাসকারেনহাস নাও’— এই বলে বিবাহ প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন সোফিয়া। তারপর ছোট একটা ঘরোয়া পার্টি আর এক থমকে যাওয়া জাদুকরের খিলখিলিয়ে ওঠা। ওখানেই অন্ধকার হয়ে যায় পর্দা। বারবার।
     
    ওটাই ইথান মাসকারেনহাসের শেষ‌ হাসি কিনা আমি জানতে চাইনি‌ কোনওদিন। কোনওদিন জানতে চাইবও না। শুধু চাইব, আমরা যারা গৃহবন্দি থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠছি, তারা সবাই যেন একদিন আবার ঘর থেকে বের হতে পারি। ইথান মাসকারহেনাস গৃহবন্দি দশায় যন্ত্রের সাহায্যে বাঁচবে না বলে মৃত্যু চেয়েছিল। আমরা গৃহবন্দি দশায় থেকে বাঁচতে চাইছি। বাঁচাতে চাইছি নিজের সন্তান-সন্ততিকে। এই লড়াই আমাদের নিজেদেরই লড়তে হবে। এখন ঘরে থাকতে হবে। যাতে আবার একদিন বাইরে বের হতে পারি। কারণ আমাদের লড়াই জিতিয়ে দেওয়ার মতো কোনও সোফিয়া নেই। কোনওদিন ছিল না!

     


    অভীক রায় - এর অন্যান্য লেখা


    অভীক রায়ের কোয়ারেন্টাইনে থাকাকালীন একটি লেখা

    এক দিন বের হব বলেই আজ ঘরে বন্দি-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested