মলিকা বির্দি। দিল্লির কনভেন্ট স্কুলে পড়েছেন। আদ্যন্ত শহুরে মানুষ ছিলেন একসময়। কিন্তু হঠাৎই বছর পঁচিশেক আগে ১৯৯২ সালে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন কুমায়ুঁ'র মুন্সিয়ারিতে। সরমোলি নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামে। আসলে শহরের মধ্যে থেকে শহরবিমুখ এক জীবন তাঁকে বরাবর টেনেছে। চেয়েছিলেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে প্রকৃতির মানুষের জন্য কিছু করতে। আর এখানেই তিনি আলাদা। অবশ্য মানুষের প্রতি এই টান তাঁর বরাবরের। ৮৪-র শিখ দাঙ্গায় রিফিলক্যাম্পে মানুষের সেবা করেছেন। রাজস্থানের নির্যাতিতা ও রেপ-ভিক্টমদের নিয়েও কাজ করেছেন। মানুষের বাঁচার অধিকারে নির্যাতিত, নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সবসময়। কিন্তু কোনও এন জিও'র মতো প্রতিষ্ঠান খুলতে চাননি।
আজ মুন্সিয়ারির সরমোলি গ্রামে মলিকা বির্দি সবার কাছে মলিকাদিদি। একবাক্যে। কিন্তু প্রথমদিকে গ্রামের মানুষজন দিল্লি থেকে আসা মলিকাকে এত সহজে মেনে নেননি। গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টায় কিংবা মুন্সিয়ারির বনাঞ্চল রক্ষার লড়াইয়ে প্রথমদিকে অনেক বাঁকা কথা শুনতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তিনি দমেননি। আলোর লোভ তাঁর ছিল না। নিজের ভেতরের তাগিদেই প্রকৃতি আর মানুষকে ভালোবেসে তাদের কাছে থাকতে চেয়েছেন। তাই প্রথমদিকে গ্রামের পঞ্চায়েতে সাধারণ দর্শকের মতোই উপস্থিত থাকতেন। সেখানকার মানুষজন-- তাদের অভাব-অভিযোগ-সমস্যা বুঝতে। আস্তে আস্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন। গ্রামের মানুষজন বোঝেন, মলিকা বির্দি আসলে তাঁদের আর প্রকৃতির ভালো চান। ধীরেধীরে গ্রামের মুখচোরা মহিলারা নিজেদের অভাব-অভিযোগের কথা দিদির কাছে খুলে বলতে থাকেন। মলিকা বোঝেন গ্রামের মেয়েদের মূল সমস্যা তাঁদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন না হতে পারা। কেবল নিজেদের খেত থেকে শস্য উৎপাদনই একমাত্র সুরাহার পথ নয়, বোঝেন তিনি। তাই ২০০৪ সাল থেকে গ্রামের মধ্যে হোম স্টে খোলা শুরু হয়। বেতের ঝুড়ি,কার্পেট, সোয়েটার বানানোতে উতসাহ দেন গ্রামের মানুষকে। আস্তে আস্তে সরমোলি গ্রাম বাড়তি আয়ের পথ দেখে। দারিদ্র্য ঘোচে। তৈরি হয় মাটি-সংগঠন, গ্রামের মেয়েদের নিয়ে। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি সংগঠন। যেখানে গ্রামবাসীরা অন্যায়-অবিচারের অভিযোগ জানাতে আসেন। সেইসঙ্গে গ্রামের মানুষকে পরিবেশ প্রকৃতির অপরিহার্যতা সম্পর্কে বোঝাতে সক্ষম হন। প্রকৃতি না থাকলে মানুষও যে বাঁচবে না-- এই সার কথাটি তিনি গেঁথে দেন সরমোলির প্রতিটি মানুষের মনে। তাই গোরি নদীর বুকে NTPC-এর হাইড্রোলিক প্রজেক্ট রুখে দিতে পারেন গ্রামবাসীরা। কোটিকোটি টাকার খেলা, রাজনৈতিক নেতাদের শাসানি কিছুই দমাতে পারেনি মলিকা দিদি আর গ্রামবাসীদের। প্রাণ সংশয়ের ভয় ছিল মলিকাদিদির, জানাচ্ছেন গ্রামবাসীরাই। কিন্তু তিনি মলিকা বির্দি।
সরমোলি গ্রামে ফিরিয়ে এনেছেন মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। অটুট রেখেছেন মুন্সিয়ারির বন-জঙ্গল-সংস্কৃতি।
আজ মুন্সিয়ারির সরমোলি গ্রামে মলিকা বির্দি সবার কাছে মলিকাদিদি। একবাক্যে।