ফাঁকা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। কদাচিৎ দু-একজন লোক। মোড়ে মোড়ে পুলিশ, কড়া নজরদারি। লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদির আদর্শ বিজ্ঞাপন। মোড়কের বিচারে দশে দশ।
এক্ষেত্রে নম্বর দেখে বিচার করলে অবশ্য ঠকতে হবে। দশে দশ পাওয়া পরীক্ষার্থীটি আসলে একটি বর্ণচোরা আম। দেখে বোঝার উপায় নেই ভিতরে কী রয়েছে। জিটি রোড সংলগ্ন রাস্তা বা গলিতে কি পুলিশ আসছে না? হ্যাঁ আসছে। নিয়ম করে আসছে। একাধিকবার সচেতন করে যাচ্ছে সাধারণ মানুষকে। দোকানে-বাজারে পর্যাপ্ত রসদ। রেশনও মিলছে যথাযথ। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে স্থানীয় মানুষদের সচেতনতা এবং প্রয়োজনীয়তা নিয়ে।
হাওড়া শালকিয়া এলাকায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের বাস। কেউ সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত কেউ বা অসংগঠিত ক্ষেত্রে। কারও কাপড়ের দোকান, কারও দুধের ব্যবসা রয়েছে। কাজের রকমফের যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম তিনটি জিনিসের কথা আমরা বলে থাকি - অন্ন, কাপড় এবং বাসস্থান। অন্নের অভাব যে নেই তা আগেই বলেছি। কাপড়ও রয়েছে। বাকি রইল বাসস্থান। কে কীরকম বাড়িতে থাকছেন, একজনের মাথাপিছু থাকার জায়গাই বা কত?
সচেতনতার জন্য শিক্ষা আবশ্যক। কিন্তু অন্ন, কাপড়, বাসস্থানের মধ্যে শিক্ষার স্থান প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ এই এলাকার বহু স্থানে দু’টি বাড়ির মধ্যে জায়গা এতই কম যে সেখানে দু’জন মানুষের একসঙ্গে প্রবেশ চলে না। অনেকসময় একজন মানুষকেই দেওয়াল থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে হয়। এহেন পরিবেশে উপযুক্ত ‘শিক্ষা-সচেতনতা’-র জায়গাটা আন্দাজ করে নেওয়াই যায়।
তাহলে কি মানুষ একেবারেই বুঝতে পারছেন না বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব? বারবার যে বলা হচ্ছে, ‘আপনারা দয়া করে বাড়িতে থাকুন’, তা কি তাঁদের কানে যাচ্ছে না? হ্যাঁ যাচ্ছে এবং তাঁরা বুঝতেও পারছেন বলে আশা রাখছি। কিন্তু তাতেও কেন একাধিক মানুষ বাড়ির ভিতর থাকছেন না?
থাকছেন না কারণ থাকার জায়গা নেই তাই। এক কামরার ছোটো ঘরে পাঁচ-ছ’জনের বাস একসঙ্গে; ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে। একটি বা দু’টি জানালা, সেটাও বিপরীত বাড়ির দেওয়ালমুখী। এই অবস্থায় মানুষ ঘরের ভিতর থাকবে কীকরে? বয়স্ক এবং ছোটোরা ঘরের মধ্যে, পরিবারের যুবকরা এসে বসছেন ফুটপাথে। এরকম একাধিক যুবক রয়েছেন যাঁরা বাধ্য হয়েই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসছেন। এরই মধ্যে চেনা বন্ধু বা চেনা মুখ দেখলে তো কথাই নেই। গায়ে গা লাগিয়ে বসে গল্প, আড্ডা, মোবাইল। পুলিশ যখন আসবে দেখা যাবে, এরকম মনোভাব।
যাঁদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা বা বাড়িতে পর্যাপ্ত জায়গার অভাব নেই তাঁদের প্রত্যেকেই কি তাহলে লকডাউন বা সামাজিক দূরুত্ব মেনে চলছেন? অবশ্যই না। কিন্তু সেই সংখ্যাটা কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব জনিত সমস্যায় ভুগছেন, যাঁদের আর্থিক অসঙ্গতি রয়েছে তাঁরাই।
শালকিয়ার মতো জায়গায় এই ধরণের ঘটনা কি একেবারেই অনভিপ্রেত, কল্পনার অতীত? বোধহয় না। কারণ কোনও জায়গায় গড়ে ওঠা সমাজের প্রকৃতির উপর অনেকাংশে নির্ভর করে সেখানকার ইতিহাস। হাওড়া বা শালকিয়া যে খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গা এমন বর্ণনা ইতিহাসের পাতায় মেলে না। বরং জলা-জঙ্গল, কাদা, দুর্গন্ধ, তুলোর গুদাম প্রভৃতি সম্বন্ধযুক্ত রয়েছে এখানকার সঙ্গে। পরবর্তীকালে এই সমস্ত জলাশয় বুজিয়ে ক্রমে গড়ে উঠেছে একের পর এক বাড়ি। ‘হাওড়’ হল ‘হাওড়া’। যে বাবুরা এখানে বাগানবাড়ি (নন্দীবাগান, বাবুবাগান, বিবিবাগান ইত্যাদি) গড়েছিলেন তারাও বিদায় নেন সময়ের সঙ্গে। বাকি যেটা পড়ে রইল সেটা উচ্ছিষ্ট, এঁটোকাঁটা। এরকম জায়গায় কোনও ধনী ব্যক্তি কি বাড়ি নির্মাণ করতে চাইবেন?
লকডাউন না মানার ক্ষেত্রে আরও একটি সমস্যা ‘জনসংখ্যা’। ফ্ল্যাট কালচার আসার আগে দু-একতলা বাড়িতে বাস করত মানুষ। সেখানেই ক্রমে গড়ে উঠতে থাকতে বড় বড় বিল্ডিং। আগে যেখানে কুড়ি জন থাকতেন সেখানে এখন কুড়ি হাজার জন। গলির ভিতরে ফ্ল্যাটের দাম মূল রাস্তা লাগোয়া বিল্ডিংগুলোর তুলনায় কম। তাই অনেকেই চলে এলেন ভিতরের দিকে। যারা বেশি সুযোগ-সুবিধা চাইলেন তারা রইলেন মূল রাস্তার কাছে, যেখানে সর্বদা রয়েছে পুলিশি নজরদারি। লকডাউন বা সামাজিক দূরত্ব উল্লঙ্ঘন করার জো নেই।
শালকিয়া নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম নয়। প্রতিটি জায়গার লকডাউন তার চরিত্র অনুযায়ীই হতে বাধ্য। উপর থেকে জারি করা ফরমান কি যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাস্তবতা রাতারাতি বদলে দিতে পারে?
একটি ঘরে ছয়টি মানুষ, সোশাল ডিসট্যান্সিং মানতে হলে রাস্তায় বের হতেই হবে