×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দুর্গাপুজো কি আদতে নিম্নরুচির আর্ট প্র্যাকটিস?

    সুদীপ্ত সেনগুপ্ত | 14-11-2019

    নান্দনিকতা বা aesthetics-এর কোনও জায়গা নেই, প্রতীকী ছবি

     দেওয়ালে লুচি টাঙানো
    ফুলদানির বদলে হাঁড়ি
    রবি ঠাকুরের মস্ত ভুল
    সবাই করলে সেটাই সুন্দর

     

    খুব ভয়ে ভয়ে এই লেখাটা লিখছি। পুজো, মানে দুর্গাপুজোর পর এক মাসেরও বেশি কেটে না গেলে এটা লেখার সাহসই আমি পেতাম না। সাহস না বলে দুঃসাহস বলাই বোধহয় ভাল।

    আমাদের বক্তব্য হল, পুজোর সময়ে মণ্ডপ, প্রতিমা, আলোক সজ্জা ইত্যাদি একটা উঁচু মানের শিল্প বলে বাঙালির যে শ্লাঘা আছে, সেটা নিতান্তই শূন্যগর্ভ। শিল্পরুচির দিক থেকে একটা অত্যন্ত পশ্চাদপদ জাতি বলেই বাঙালির এটা নিয়ে এত গর্ব এবং আহামরি ভাব। বাংলায় শিল্প কথাটার যে দ্বিতীয় অর্থ আছে, সেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কিছুটা পুজোকে ঘিরে ঘটে বটে; তবে সেটাও বাঙালির অন্যান্য অর্থনৈতিক কাণ্ডের মতোই দিন–আনি–দিন–খাই স্তরের। তাতে না উল্লেখযোগ্য সম্পদের সৃষ্টি হয়, না মানুষের জীবনের গুণগত মানের স্থায়ী উন্নতির কোনও সম্ভাবনা সূচিত হয়। অন্য আর কিছুকে কেন্দ্র করে রূঢ় বাস্তবকে ভুলে থাকা কঠিন বলেই সম্ভবত চার দিনের পুজোকে টানতে টানতে সাত আট নয় দিনের উৎসবে টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা।

     

    সুন্দরের সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করা বা সে বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনায় যাওয়ার আমাদের যোগ্যতা নেই। কিন্তু অসুন্দরকে চিহ্নিত করতে ওই যোগ্যতা লাগে না, এটা আমাদের দাবি। প্লাইউডের কাটআউটে রঙচঙ লাগিয়ে আমেরিকার বড় বড় শহরের স্কাইলাইনের আদল ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা বাচ্চাদের কাছে মেকানোর থেকে একটি বেশি মজাদার খেলা হতেই পারে। বিস্মিত হই যখন দেখি সাবালকরা গম্ভীর মুখে তাকে শিল্প বলে দাবি করে, আর ততোধিক সিরিয়াস মুখে ‘বিচারকরা’ তার সৌন্দর্যের নম্বর দেন।

     

    যে কোনও স্থাপত্য বা এমনকি নান্দনিক নির্মাণকে কতটা দূর থেকে দেখতে হবে তার একটা আন্দাজ শিল্পীর থাকে। তাজমহলের প্রবেশ পথটা মনে পড়ছে? কেমন যেন ঝপ করে সমূহ নির্মাণটি লাফিয়ে ওঠে চোখের সামনে? প্যারিসের ল্যুভ্‌র মিউজিয়ামে মোনালিসাকে কতটা দূর থেকে দেখতে হবে তা ব্যারিকেড করে মাপ করে দেওয়া আছে। সুন্দরীর ঘাড়ের উপর এসে নিঃশ্বাস ফেললে তার সৌন্দর্যের কদর করা যায় না। ঘরের কাছে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল? মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বাড়িটার সৌন্দর্য আস্বাদন করতে হলে পুকুরের এ প্রান্ত থেকে। কলকাতার মণ্ডপ নির্মাণে এই পরিপার্শ্বের মধ্যে স্থাপত্যকে স্থাপনা করার ভাবনা কি আদৌ চোখে পড়ে? বরং চোখে পড়ে আখাম্বা বড় করে কিছু বানানোর প্রতিযোগিতা। গম্বুজাকৃতি মণ্ডপের ৪০/৫০ ফুট উঁচু সিলিংয়ে সূক্ষ্ম কারুকাজ, অথচ সঙ্কীর্ণ রাস্তায় তৈরি মণ্ডপের ব্যাস বড় জোর ৩০ ফুট। মানুষ কি চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের শিল্প দেখবে; যেমন সিস্টিন চ্যাপেলে দেখে? ওদিকে লাঠি হাতে সিকিওরিটি গার্ড তো দাঁড়ানোরও ফুরসৎ দিচ্ছে না! তবু আমরা দশ হাত গলিতে সুউচ্চ বুলন্দ দরওয়াজা বানাব, বালির উপর উট বেঁধে রেখে রাজস্থান বানাব, আর স্টেনলেস স্টিলের থালার উপর টেরাকোটার কাজ রাখব। এগুলোকে বড়দের ঝুলন সাজানো বলা যেত, গো–অ্যাজ–ইউ–লাইক শিল্প বলা যেত, পশ্চিমী সংস্কৃতিতে কার্নিভালের মতো বিশুদ্ধ বিনোদন বলা যেত। কিন্তু বাঙালি অত অল্পে থামার পাত্র নয়। তার দাবি, এটা আর্ট!

    দুর্গা প্রতিমা দর্শনের পর বাঙালির সবচেয়ে বহুশ্রুত প্রতিক্রিয়া, ‘মায়ের মুখখানি বড় সুন্দর হয়েছে, দেখে মনটা ভরে গেল’। ভাগ্যিস দেবী প্রতিমার মুখখানিই নজর টানে। গোটা প্রতিমাটিকে একটা ভাস্কর্য বা অন্তত তার প্রতিরূপ হিসেবে দেখলে তার বিভিন্ন অংশের আকারের তুলনামূলক বৈসাদৃশ্য এতটাই প্রকট হয়ে উঠবে যে একটা পুতুল হিসেবেও তা দেখার অযোগ্য। দেবীর যে কোনও মূর্তিই ভক্তের কাছে পূজ্য, সেখানে নান্দনিকতা বা aesthetics–এর কোনও জায়গা নেই। কিন্তু তাকে শিল্পকর্ম বলে দাবি করলে তো স্কেল, প্রোপোরশন, হারমনি ইত্যাদি একেবারে বুনিয়াদি বিষয়গুলো তো আসবেই আলোচনায়। মানুষের উচ্চতা মুখের খাড়া মাপের সাড়ে সাত থেকে আট গুণ মতো হয়। তার মানে ৪০ ফুট উঁচু মানুষের মতো পুতুল হলে তার মুখটা ঠিকঠাক অঙ্কের হিসেবে পাঁচ ফুট হতে হয়। এখন একজন সাড়ে পাঁচ ফুটের মানুষ যদি মাটিতে দাঁড়িয়ে উঁচু বেদীর উপরে বসানো ওই চল্লিশ ফুট লম্বা পুতুল সামনে থেকে দেখে তবে গোটা শরীরের তুলনায় মুখটা দেখাবে এক্কেবারে পুঁচকে, বিসদৃশ রকমের ছোট। ভাস্কররা তাই মুখটাকে এবং শরীরের উপরের অংশকে ক্রমান্বয়ে একটু একটু করে বড় করে গড়েন, যাতে নির্দিষ্ট জয়গা থেকে দেখার সময়ে তা আনুপাতিকভাবে মানুষের শরীরের মতোই লাগে। ক্যামেরার চোখ ভক্তি বাদ দিয়ে দেখে। যে কোনও প্রতিমার ফটো খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় ভাস্কর্য নির্মাণের একেবারে গোড়াস্য গোড়ার কথাটাও পূজার প্রতিমায় মানা হয় না। তবু তাকে হৃদয়ের ভক্তি ভালবাসার নির্মাণ বলেই বাঙালি থামবে না, সেটা নাকি আর্টও!

     

    আলোকসজ্জা নিয়ে প্রথমেই বলার যে গাছের পাতার সবুজের সহস্র রকম শেড আছে। প্রকৃতি সেই সৌন্দর্যের সম্ভার আমাদের সামনে সাজিয়েই রেখেছে। সবুজ রঙের ফ্লোরেসেন্ট আলো লাগিয়ে বাঙালি গাছের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে এটা সম্ভবত প্রকৃতি দেবীর জানা ছিল না; থাকলে হয়তো ওই অনন্ত সবুজের সমারোহ তিনি অন্তত বঙ্গভূমির জন্য সৃষ্টি করতেন না। চাইনিজ আলো সস্তা হলে, পকেটে অন্য লোকের উপার্জনের পয়সা থাকলে এবং বিন্দুমাত্র শিল্প–সৌন্দর্যবোধ না থাকলে — যে কম্বিনেশনটা পুজো পাগল বাঙালির মধ্যে এন্তার মিলবে — তখন আলো নিয়ে যা খুশি করা যায়। তা হোক যা খুশি; কারই বা কী বলার আছে? বলার আছে তখন যখন প্রাপ্তবয়স্কদের সমাজ এটাকে সিরিয়াসলি নেয় এবং সমাজের পরিচিত মানুষরা এই শিল্পের ফার্স্ট সেকেন্ড বাছতে বসেন। এটাও নাকি আর্ট!

     

    পুনশ্চ রবীন্দ্রনাথ: যাহা আমাদের উপকারী ও উপযোগী, তাহাই কালক্রমে অভ্যাসবশত আমাদের চক্ষে সুন্দর বলিয়া প্রতীত হয় ও বংশপরম্পরায় সেই প্রতীতি প্রবাহিত ও পরিপুষ্ট হইতে থাকে, এরূপ কথা কেহ কেহ বলিয়া থাকেন। তাহা যদি সত্য হইত তাহা হইলে লোকে অবসর পাইলে ফুলের বাগানে বেড়াইতে না গিয়া ময়রার দোকানে বেড়াইতে যাইত, ঘরের দেয়ালে লুচি টাঙাইয়া রাখিত ও ফুলদানির পরিবর্তে সন্দেশের হাঁড়ি টেবিলের উপর বিরাজ করিত।

     

    (মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

     

     


    সুদীপ্ত সেনগুপ্ত - এর অন্যান্য লেখা


    ব্যক্তি রোগীকে যোদ্ধায় পর্যবসিত করা মানে ভাবনা বা আইডিয়ার স্তরে একটা সর্বনাশের বীজ বপন করা।

    সদ্যপ্রয়াত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে আবেগের সুনামিতে একবারও আমাদের মনে পড়ল না অন্য কৃতীদের।

    সোনার পালঙ্কে তুলোর গদিতে শুয়ে 170 বছরের লেডি লিবার্টির প্যারিস থেকে টোকিও যাত্রা।

    রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মুর বিরুদ্ধে বিরোধীদের যশবন্ত সিনহা কোনও প্রার্থীই নন

    অবশেষে নিষ্পত্তি অযোধ্যায় বিতর্কিত জমি মামলার। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মিলল সমাধান সূত্র।

    সারা জীবন নাটক করছেন, মৃত্যুতে সযত্নে সেটাই এড়িয়ে গেলেন শম্ভু-দুহিতা শাঁওলী।

    দুর্গাপুজো কি আদতে নিম্নরুচির আর্ট প্র্যাকটিস?-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested