×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • শম্ভু মিত্রর সাফল্য ছিল আমার ব্যর্থতা

    সুদীপ্ত সেনগুপ্ত | 17-01-2022

    প্রতীকী ছবি।

    এক্কেবারে কোনও নাটক ছাড়াই চলে গেলেন!

     

    থিয়েটারের লোকরা সব ধরনের শিল্পীর মধ্যে স্বজাতির মানুষকে সবচেয়ে ভাল চেনেন। এই প্রতিপাদ্যটি আরও এক বার যথার্থ প্রমাণ করলেন শাঁওলী মিত্র (Shaonli Mitra)নিজের পিতার মতোই শাঁওলী মিত্র তাঁর দেহের অন্তিম সৎকার করালেন নিভৃতে, ব্যক্তিগত পরিসরের স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে। শাঁওলী শুধু রাজ্যের বাংলা আকাদেমির প্রধানই ছিলেন না, এক দশক আগে আগে বর্তমান শাসক দল যে রাজনৈতিক পালাবদলের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল তাতে বঙ্গীয় শিল্প-সমাজের অন্যতম উজ্জ্বল মুক্তমনা মুখ ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবর রাজ্যের মু্খ্যমন্ত্রী পান মৃতদেহ সৎকারের পর— এই তথ্যটির তাৎপর্য অপরিসীম। নিজের মৃতদেহের উপর মৃত্যুর পরও দৃঢ় অধিকার শাঁওলী রক্ষা করতে পেরেছেন অর্পিতা ঘোষ এবং সায়ক চক্রবর্তীর জন্য। তাঁর পিতা শম্ভু মিত্র যেমনটা করতে পেরেছিলেন কন্য শাঁওলীর সুবাদে।

     

    শম্ভু মিত্রর সাফল্য ছিল আমার নিজের ব্যর্থতা। কারণ, রিপোর্টার হিসেবে তাঁর মৃত্যুর খবরটা ‘মিস’ করেছিলাম আমি। সান্ত্বনা একটাই ছিল, খবরটা মিস করাতে কলকাতার সমস্ত সাংবাদিককেই বাধ্য করিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। তবে সেটা ছিল 1997 সাল। আজকে মোবাইল, ইন্টারনেট, সোশাল মিডিয়ার যুগেও শাঁওলী যে পিতার পথে অনুগমন করতে পারলেন, তার জন্য বিশেষ কুর্নিশ প্রাপ্য অর্পিতাদের।

     

    সাধারণ ভাবে শম্ভু মিত্রর খবর আমার মতো রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি কভার করা সাংবাদিকদের করার কথা নয়। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে শম্ভু মিত্রের ‘দিনান্তের প্রণাম’ নামে দু’টি ক্যাসেটের একটি সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে নিজস্ব পাঠে তিনি রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দর কবিতার বিকৃতি ঘটিয়েছিলেন এমন অভিযোগ উঠেছিল। সেই খবর করতে আমার তাঁর বাড়িতে যাওয়া এবং বিস্তর সাধ্যসাধনার পর তৃতীয় দিনে তাঁর সাক্ষাৎকার পাওয়া। অবশ্য আমার প্রথম প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার আগে তিনিই আমার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন যাতে কোন কলেজে কোন বিষয়ে পড়েছি-র মতো সহজ থেকে শুরু করে কবিতা পড়ি কেন, এই রকম দুরূহ প্রশ্ন ছিল!

     

    কবিতার পাঠ নিয়ে আচার্য যখন বলতে শুরু করলেন, তখন সেটাই বুঝলাম যেটা প্রকৃত শিক্ষা ও প্রজ্ঞার মুখোমুখি হয়ে অর্বাচীন সাংবাদিকরা বারবার বুঝতে পারে। বুঝলাম কবিতা আমি কিছুই পড়িনি। কবিতার পাঠে বিকৃতির অভিযোগ নিয়ে একই অফিসে আমার সহকর্মী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কিছু মন্তব্য আমার হোমওয়ার্কের খাতায় ছিল। শম্ভু মিত্র প্রায় দু’ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎকার শেষ করার পর বুঝলাম এই বিষয়ে আমার কিছুই বলার থাকতে পারে না। যতদূর মনে পড়ছে প্রকাশিত রিপোর্টটিতে শম্ভু মিত্র ছাড়া আর তিন জন কবির উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছিল— শক্তি, শঙ্খ ঘোষ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

     

    শম্ভু মিত্র থাকতেন বেহালা নিউ আলিপুর অঞ্চলের জ্যোতিষ রায় রোডের ব্যাঙ্ক কলোনিতে। একেবারেই ওই এলাকায় আমার প্রায় নিত্য যাতায়াত ছিল। ফোন নম্বর থাকার সুবাদে কথা বলারও অবকাশ ছিল। রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর ফোনে কথা হয় এবং তিনি অখুশি হননি এটা বোঝা গিয়েছিল। খবরের কাগজের নিয়ম অনুসারে রিপোর্টারদের মধ্যে যাঁর সঙ্গে কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির বেশি যোগাযোগ, সেই রিপোর্টারই তাঁর খবর রাখবেন এটাই প্রত্যাশিত। আমার সঙ্গে তাঁর বেশি যোগাযোগ ছিল না, কিন্তু যেহেতু শূন্যের থেকে সবই বেশি, তাই তাঁর মৃত্যুর খবর মিস করার নৈতিক দায়টা আমারই। শম্ভু মিত্র ইচ্ছাপত্রটি ছিল হাতে লেখা, তার একটি লাইন মনে আছে, ‘"আমার এই শরীর যেন রবীন্দ্র সদন জাতীয় কোনও জনস্থানে প্রদর্শিত না হয়।’'

     

    জনস্থানে মৃতদেহ প্রদর্শনের আড়ম্বরে অবশ্য আজকের শাঁওলী এবং 25 বছর আগের শম্ভু মিত্র বিরল ব্যতিক্রম। সাধারণ ভাবে বাঙালি এ ধরনের ক্ষেত্রে চান্স পেয়ে খারাপ পারফর্ম করেছে এমন নজির নেই। 2011 সালের 3 জানুয়ারি মারা গিয়েছিলেন সূচিত্রা মিত্র। সময়টা লক্ষণীয়, বামফ্রন্ট সরকার যাবে যাবে করছে, তবে ক্ষমতায় রয়েছে তখনও, কলকাতা পুরসভা তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে। রবীন্দ্র সদনে শায়িত ছিল গায়িকার দেহ। সরকারের (বামপন্থী) কর্তাব্যক্তিরা এক দিকে, অন্য দিকে পুরসভার কর্তা-সহ তৃণমূলের নেতারা। তৃণমূলের তখন দের্দণ্ডপ্রতাপ, এখন দলত্যাগী নেতা মালা দিয়ে তার পরেও দলবল নিয়ে দেখলাম দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁকে গিয়ে বলেছিলাম, তোমাদের কি আর কিছু আছে, মানে আসলে জানতে চেয়েছিলাম সেখানে তাঁদের শীর্ষ নেত্রী কি আসবেন? ওই নেতার উত্তরটা কিন্তু ছিল বাঙালির মৃত্যু-পার্বণের আখ্যানে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতো: ‘"না, এখানে সব ওদের কন্ট্রোলে, তবে শ্মশানটা কিন্তু আমাদের’’ সত্যিই তো, শ্মশানটা তো পুরসভারই দায়িত্বে!

     

    সাংবাদিক হিসেবে গত তিন দশকে কলকাতার তিনটি সবচেয়ে স্মরণীয় মৃত্যুকেন্দ্রিক আড়ম্বরের সাক্ষী থাকার সৌভাগ্য হয়েছে— সত্যজিৎ রায়, মাদার টেরিজা এবং জ্যোতি বসুর। সত্যজিৎ রায়ের শেষযাত্রায় রবীন্দ্র সদন থেকে কেওড়াতলা পর্যন্ত পুরোটাই ছিল জনস্রোত। শ্মশানের ভিতরে মৃতদেহকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছেছিল। রবীন্দ্রনাথের মরদেহ থেকে চুল দাড়ি ছিঁড়ে নেওয়ার মতো ঘটনা রোধ করতে পুলিশকে বেশ বলপ্রয়োগ করতে হয়েছিল। মাদার টেরিজার মরদেহ প্রদর্শিত হয়েছিল সপ্তাহভর মিডলটন স্ট্রিটে লরেটো হাউসে। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তাঁর পারলৌকিক কৃত্যে হাজির ছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জায়া হিলারি ক্লিন্টন থেকে শুরু করে কয়েক ডজন রাজা রানি, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী। আন্তর্জাতিক মৃত্যু-পার্বণের দৌলতে সে দিন কলকাতাকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি এয়ারপোর্টের উড়ানসূচি সম্পূর্ণ অদলবদল করতে হয়েছিল। জ্যোতি বসুর মৃতদেহকে বিদায় দেওয়ার সময়ে তাঁর দলীয় এবং প্রশাসনিক সত্তার উপরে স্থান পেয়েছিল সাংবিধানিক পদাধিকারী হিসেবে তাঁর পরিচয়। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভবনে শায়িত তাঁর মরদেহকে ঘিরেই সাড়ম্বর প্রদর্শন ছিল সবচেয়ে বেশি। একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মৃত্যুতে প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন, এই বিরল দৃশ্যের সাক্ষী ছিল ভারত।

     

    এই রকম public spectacle বা জন প্রদর্শনের বিন্দুমাত্র সুযোগও দিলেন না শাঁওলী মিত্র। নাটকের লোক হয়েও। বাবা শম্ভু মিত্রর মতোই।

     


    সুদীপ্ত সেনগুপ্ত - এর অন্যান্য লেখা


    ফেসবুক পোস্টে তপতী দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন যে হরির কোনও ক্রনিক অসুখ ছিল না।

    স্বঘোষিত ইন্টেলেকচুয়াল এবং অ্যাকাডেমিশিয়ানদের থেকে সাবধান থাকাই শ্রেয়!

    যে কোনও স্থাপত্য বা এমনকি নান্দনিক নির্মাণকে কতটা দূর থেকে দেখতে হবে তার একটা আন্দাজ শিল্পীর থাকে

    শৈবাল মিত্রর আ হোলি কন্সপিরেসি, শিক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আগ্রাসনকে তুলে ধরা হয়েছে

    পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রে চাটুকারিতার রমরমার প্রমাণ তৃণমূল স্তরে অর্থনীতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা

    ব্যক্তি রোগীকে যোদ্ধায় পর্যবসিত করা মানে ভাবনা বা আইডিয়ার স্তরে একটা সর্বনাশের বীজ বপন করা।

    শম্ভু মিত্রর সাফল্য ছিল আমার ব্যর্থতা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested