নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপারে সোশাল মিডিয়ায় পরস্পর বিরোধী ও ভিত্তিহীন কিছু তথ্য পরিবেশিত হওয়ায় বিভ্রান্তি ছড়াতে শুরু করেছে। যার মধ্যে একটা মারাত্মক হানিকর ভ্রান্তি হল রান্না করা মাংস খাওয়ার সঙ্গে এই ভাইরাস সংক্রমণের সম্পর্ক রয়েছে। আদপে যা একেবারেই নেই।
প্রাণীবাহিত মানুষের রোগ হওয়ায় এই নতুন (নভেল) করোনা ভাইরাসটির উৎপত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিষয়টা এখনও স্পষ্ট নয়। বাদুর, ভাম (সি-ভেট ক্যাট), বন্য কুকুর (রেকুন ডগ) রয়েছে সন্দেহের তালিকায়। কেউ কেউ বলছেন বিষাক্ত সাপ ও সামুদ্রিক মাছ এব্যাপারে দায়ী। এরই প্রেক্ষিতে প্রাণী ও মানুষের চিরায়ত দ্বন্দ্ব আবার সামনে চলে এসেছে। খাদ্য হিসাবে সামুদ্রিক মাছ, মাংস ও অন্যান্য প্রাণিজ আহারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে এসবই হচ্ছে বিষয়গত সম্যক্ ধারণা না থাকার জন্য।
আপনি কি জানেন, আমরা প্রায় প্রত্যেকেই জীবনের কোনও না কোনও সময়ে করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি? কী, চমকে উঠলেন তো? বিশ্বাস হল না, তাই তো? তা হলে শুনুন, সর্দিজ্বর সৃষ্টিকারী যে সমস্ত ভাইরাস আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, তারা হল, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এডিনো ও করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের চারটি স্ট্রেন (২২৯ ই, এনএল৬৩, ওসি৪৩, এইচ কে ইউ১) মানুষের সর্দিজ্বর করতে ভয়ানক পটু। তবে এরা প্রাণঘাতি নয় মোটেই। হাঁচি, কাশি, সর্দিজ্বরের মত সাধারণ উপশম নিয়ে পাঁচ/ছয়দিন ভুগিয়ে চুপচাপ চলে যায়।
শুধু মানুষই নয়, কুকুর, বিড়াল, গবাদী প্রাণী, শূকর, মুরগি, ইঁদুর – সবাই এই করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়। আর নির্দিষ্ট রোগের শিকার হয়। যেমন করোনাভাইরাস কুকুরে এন্টেরাইটিস, বিড়ালে পেরিটোনাইটিস, গরু ও শূকরে গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস, মুরগিতে ব্রঙ্কাইটিস ও ইঁদুরে হেপাটাইটিস (জন্ডিস) তৈরি করে। অর্থাৎ প্রাণীদেহে এরা সর্দিজ্বর না করে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ আক্রমণ করে এবং নির্দিষ্ট উপশম তৈরি করে। কম ভয়াবহ রোগ হলেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণও হয়ে দাঁড়ায়। তবে এখনকার (নভেল) করোনাভাইরাস একেবারেই আলাদা, যা সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) ও মার্স (মিডিল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাসের মতই প্রাণীদের দেহ থেকে জিনপরিবর্তন (জেনেটিক মিউটেশন) করে মানুষকে আক্রমণ করার ক্ষমতা লাভ করেছে। অর্থাৎ প্রজাতি বাধা অতিক্রম করে মনুষ্যেতর প্রাণী থেকে মানুষে চলে এসেছে।
একটা বিষয় জেনে রাখা ভাল, করোনাভাইরাস বা অন্যান্য সমস্ত ভাইরাসই নির্দিষ্ট প্রাণীকূলকে আক্রমণে পারদর্শী। সবাইকে নয়। তার কারণ ভাইরাস প্রাণীদেহে ঢুকতে গেলে, তাকে শরীরের যেকোনও কোষে প্রবেশ করতে হয়। আর কোষে প্রবেশ করতে প্রয়োজন কোষের নিজস্ব ‘পারমিট’। সেটা হল, কোষের বাইরে ডিশ অ্যান্টেনার মত বেরিয়ে থাকা কিছু গ্রাহক (রিসেপ্টর)-এর উপস্থিতি। ভাইরাসের গায়ে বেরিয়ে থাকে পেরেকের মত কিছু জৈব অণু (পরিভাষায় লিগান্ড), যা কিনা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট গ্রাহকের সঙ্গে যুক্ত হতে সক্ষম। অর্থাৎ, যেকোনও ভাইরাস যেকোনও কোষে ঢুকতে পারবে না, যদি না তার কাছে গ্রাহক বা রিসেপ্টর-উপযোগী লিগান্ড থাকে। গ্রাহকের উপস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্ন প্রাণীকোষকে আক্রমণ করার ক্ষমতা বিভিন্ন ভাইরাসের বিভিন্ন বলেই তারা নির্দিষ্ট প্রাণীকেই আক্রমণ করে। এটিকে আমরা বলি প্রজাতিগত বাধা (পরিভাষায় স্পিসিস বেরিয়ার)।
তবে মুশকিল হচ্ছে, জিনের পরিবর্তন করে ভাইরাস তার খোলকের বাইরে বেরিয়ে থাকা লিগান্ডের গড়ন বদলে ফেলতে পারে। আর তাই পরিচিত গন্ডির বাইরের রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই পরিবর্তনের পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। ভাইরাস তখন নির্দিষ্ট প্রাণীর কোষ ছেড়ে অন্য কোষকে আক্রমণে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে। এই পরিস্থিতিকেই প্রজাতিগত বাধা অতিক্রম বলে।
করোনাভাইরাসের সামগ্রিক গঠন সম্পর্কে ধারণা থাকলে পুরো বিষয়টা স্পষ্ট হবে। করোনাভাইরাস করোনাভিরিডি পরিবারের একটি আর এন এ ভাইরাস। এটি গড়ে দেড়শ ন্যানোমিটার সাইজের এবং ‘কিউবিক্যাল’ আকৃতির। এই ভাইরাসের দেহ প্রোটিন খোলক ও রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (আর এন এ) দিয়ে তৈরি। খোলকের বাইরে রয়েছে একটি স্নেহজাতীয় পদার্থের আচ্ছাদন। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে এই ভাইরাসকে মুকুটের মত দেখতে হওয়ায় এর নাম করোনা (ল্যাটিন ভাষায় ‘করোনা’ শব্দের অর্থ ‘ক্রাউন’ বা মুকুট)। চারটি প্রোটিন এই ভাইরাসের গঠনের মুখ্য উপাদান। প্রোটিন খোলকের বাইরে পেরেকের মত প্রত্যঙ্গ ‘স্পাইক’ প্রোটিন দিয়ে তৈরি। বাইরের চাদরে রয়েছে ‘এনভেলপ’ প্রোটিন। খোলকের পর্দায় রয়েছে ‘মেমব্রেন’ প্রোটিন এবং আর এন এ-কে জড়িয়ে রয়েছে ‘নিউক্লিও প্রোটিন’। স্পাইক প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিড সজ্জাই গ্রাহকের সঙ্গে বন্ধনী তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ।
স্পাইক প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিডের সজ্জার পরিবর্তন সম্ভব আর এন এ-তে অবস্থিত জিনসজ্জার ‘মিউটেশন’ (পরিব্যক্তি)-এর মাধ্যমে। এই পরিবর্তন একেবারেই আকস্মিকভাবে ঘটে। তাতে অবশ্য পরিবেশের প্রভাব থাকার সম্ভাবনাই বেশি। বর্তমানের এই নভেল করোনাও অতর্কিতে হওয়া মিউটেশনের এক মারাত্মক ফল। এখন এই করোনা ভাইরাস যে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে, তা জানা গেছে। আর তাই বিজ্ঞানীমহল এত চিন্তিত।
আলোচনা থেকে এটা উঠে এল, নভেল করোনা আকস্মিকভাবে তৈরি হওয়া একটি এমন ভাইরাস যেটা প্রাণী থেকে মানুষে চলে এসেছে; আর বর্তমানে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রামিত হচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি বা ব্যবহার করা পোশাকের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বলে বোঝা যাচ্ছে এরকম ব্যক্তির সংশ্রব ছাড়া করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে না। আর তাই প্রাণীজ আহারের উপর নিষেধাজ্ঞা নিছকই ভিত্তিহীন বা বিজ্ঞানসম্মত নয়। এই প্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসেরই নিধান দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ প্রাণীজ আহার চলতেই পারে।
-ড. সিদ্ধার্থ জোয়ারদার
ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়
করোনাভাইরাস সংক্রমণে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসেরই নিধান দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।