×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ছাত্র তো শিক্ষকের‌ই, শাসক যাই করুক

     অম্লান বিষ্ণু | 18-01-2022

    প্রতীকী ছবি।

    পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ঐতিহ্যের একটা বিশেষত্ব হল, চিন্তার চলাচল। এবং সেই চলাচল থেকে গড়ে ওঠে নানা কর্মোদ্যোগ। ‘শিক্ষা আলোচনা’ এমনই একটি চিন্তা ও কর্মের সমন্বয়। এ রাজ্যের প্রাথমিক স্তরের একদল শিক্ষক এক সময় ভাবলেন, ‘ছাত্রছাত্রীরা তো আমাদেরই’ শিক্ষা ব্যবস্থায় নানান সমস্যা থাকতে পারে, আছেও। কিন্তু তার জন্য তো শিক্ষার্থীরা অবহেলিত হতে পারে না। এই ভাবনা থেকে তাঁরা নিজের স্কুলগুলো বদলাতে শুরু করেন। রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেন। তাঁদের মনে হয়, শিক্ষার্থী শুধু পাঠক্রম অনুযায়ী শিখবে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট ক্লাসের অঙ্ক, গণিত, ইংরেজি, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে নানা সমস্যার সমাধান করতে পারবে এমন নয়। বরং শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে প্রশ্ন করবে, পড়ালেখার সঙ্গে খেলাধূলা, আবৃত্তি, নাটক, নাচ-গান এসব তো করবেই, পাশাপাশি তার গ্রাম, পরিবার, স্কুল ইত্যাদির মাঝে যে বিভিন্ন সম্পর্ক আছে, এই সম্পর্কগুলোকে এগিয়ে নিতে তাদেরও যে কিছু দায়িত্ব আছে, সেগুলোও তারা বুঝবে। আর এই সবটা মিলিয়েই তো স্কুল।
     

     


    শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু এর মধ্যেও অনেকটাই করা যায়। না করাটা ভুল। এই পরিবর্তনের কাজ করতে গিয়ে তাঁরা দেখেন, এটা একা করা যাবে না। দেখা গেল কেউ অঙ্ক খুব ভাল বোঝাতে পারেন। কেউ হয়তো ইংরেজি, পরিবেশ বিদ্যা নিয়ে নানান ভাবনাচিন্তা করছেন, কেউ বাংলাটা খুব ভাল পড়ান; ‘শিক্ষা আলোচনা’ এগুলোকে পরস্পর জুড়তে থাকে। এই নৈতিক প্রয়োজন থেকেই ‘শিক্ষা আলোচনা’র জন্ম। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতিতে নানান উদ্ভাবনী দিক নিয়ে গবেষণা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে শুধু প্রাথমিক শিক্ষিকা-শিক্ষকরাই নন, এই মঞ্চে যুক্ত হয়েছেন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। যোগ দেন সাংবাদিক, গবেষক, সমাজকর্মী ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। করোনা সংক্রমণের কারণে স্কুল বন্ধ হওয়ার বেশ কিছুদিন পর থেকেই ‘শিক্ষা আলোচনা’র সদস্যদের মধ্যে একরকমের বিচলন দেখা যায়, তাঁরা ভাবতে থাকেন কীভাবে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালু রাখা যায়। এই বিষয়ে তাঁরা একাধিক ভার্চুয়াল সভার আয়োজন করেন। প্রাথমিক কয়েকটি সভায় আলোচনা ও বাস্তব পরিস্থিতির উপর নজর রেখে ‘শিক্ষা আলোচনা’র সদস্যরা বুঝতে পারেন, কোভিড পরিস্থিতি আমাদের সামনে নিঃসন্দেহে বিরাট সংকট নিয়ে এসেছে। সংকটের স্বরূপটা কী এবং এ থেকে কীভাবে উদ্ধার পাওয়া যায়, তা নিয়ে শিক্ষা আলোচনা একটি সমীক্ষার কাজ হাতে নেয় - প্রাথমিক শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত সমাজের নানা স্তরের সহযোগিতায়। এই কাজের ফল হল, Learning Together: The Opportunity to Achieve Universal Education শীর্ষক প্রতিবেদন (https://shikshaalochana.com/sareports.html)  এটা প্রকাশ পায় 2021-এর সেপ্টেম্বরে।
     


    এই দলিলটি থেকে জানা যায়, যে-কোন সংকটেই যেমনটা হয়ে থাকে, এক্ষেত্রেও সমাজের সামনে ভবিষ্যৎ গঠনের অনেক সুযোগও হাজির হয়েছে। এখানে সংকলিত অভিজ্ঞতাগুলো, এবং তার ভিত্তিতে প্রস্তুত কিছু রূপরেখা, প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার কোভিড-পরবর্তী পুনর্নিমাণের কাজে খুবই সহায়ক হয়ে উঠতে পারে।
     


    এই কাজটা করতে গিয়েই তাঁরা এই পরিবর্ত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখাপড়ার যে দূরত্ব তৈরি হল, সেটার নবনির্মাণে স্কুল খুললে কিছু পরিকল্পনা করা দরকার বলে মনে করেন। এটা মূলত শিক্ষকদের জন্যই তৈরির কথা ভাবা হয়। সেটা প্রস্তুতও করা হয়। কিন্তু অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় স্বেচ্ছাশিক্ষকদের লেখাপড়া জারি রাখার বিষয়টা তুলে ধরেন। বিভিন্ন এলাকার আগ্রহী মানুষজনকে যদি স্বেচ্ছা শিক্ষাদানে উৎসাহিত করা যায়, তাহলে কাজটা অনেকাংশে সহজ হয় এবং আরও অনেক বেশি শিক্ষার্থীকে লেখাপড়ার আওতায় আনা সম্ভব হবে। অধ্যাপক অচিন চক্রবর্তী, সাংবাদিক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়-ও এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। সিদ্ধান্ত হয়, যেহেতু স্বেচ্ছা শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের শিক্ষক নন, ফলে পাঠদান সংক্রান্ত কোনও প্রশিক্ষণও তাঁদের নেই। তাই তাঁদের কাজে সহায়তার জন্য একটা বিষয়ভিত্তিক পাঠক্রমের রূপরেখা তৈরি করা হবে। সেই হিসেবে ‘শিক্ষা আলোচনা’র বন্ধুরা নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অত্যন্ত সহজ ও উপযোগী একটা রূপরেখা প্রস্তুত করেন। নাম দেওয়া হয়- স্বেচ্ছা শিক্ষকের হাতবই (https://shikshaalochana.com/handbook.html)  পরে বিভিন্ন জেলায় এই কাজ শুরু হলে শিক্ষা আলোচনা’র সদস্যদের মনে হয়, শুধু লিখিত কিছু তাঁদের কাছে তুলে দিলে চলবে না। তখন বিষয়ভিত্তিক ভিডিও তৈরির কাজ শুরু হয়। বেশ কিছু ভিডিও ‘শিক্ষা আলোচনা’র ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা হয় (https://www.youtube.com/channel/UC6g1t8PU1G4-sUQFoN6wm_Q) এমতাবস্থায়, আরও ঠিক হয়, এই কাজ যদি আরও বড় আকারে সবার কাছে পৌঁছে দিতে হয়, তাহলে একটা ওয়েবসাইট প্রস্তুত করা দরকার। সেই ভাবনা থেকে ‘শিক্ষা আলোচনা’র একটি ওয়েবসাইটও তৈরি হয় (https://shikshaalochana.com/ ) স্বেচ্ছা-শিক্ষকদের হাতবই ও শিখন ভিডিওগুলি ‘শিক্ষা আলোচনা’র শিক্ষিকা-শিক্ষক বন্ধুরা বিভিন্ন জেলায় একত্রিত হয়ে প্রস্তুত করেছেন। এগুলো ‘শিক্ষা আলোচনা’র ওয়েবসাইটে রাখা আছে।
     


    এটা কতটা কার্যকরী হবে সেটা সবাই দেখে নিশ্চয়ই মতামত দেবেন। এটাই একমাত্র পথ সে দাবিও আমরা করছি না। আমরা এমন কথা বলছি না যে, ‘শিক্ষা আলোচনা’র এইসব কাজে সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। আমরা বলতে চাইছি এভাবে অনেক কিছু বদলে দেওয়া যায়। করে দেখানো যায়। ব্যবস্থায় কী কী বদল আনা দরকার সে তো ‘শিক্ষা আলোচনা’র বন্ধুরা তাঁদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন।
     


    নিশ্চয়ই অনেক সমস্যা আছে। রাজনীতি, সমাজনীতি, সরকারি; বিভিন্ন সমস্যা। সমস্যা মেটানোর আবেদন থাকবে কিন্তু পাশাপাশি কাজগুলোকে তো এড়িয়ে যাওয়া চলে না। প্রায় দু'বছর ধরে যেহেতু শিশুদের মেলামেশা, লেখাপড়া একপ্রকার বন্ধ, মূল কথা স্কুল বন্ধ; এই পরিস্থিতিতে তারা কেবল বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তা নয়, তাদের মানসিক অবস্থার, বুদ্ধির বিকাশের ক্ষেত্রেও এক বিরাট বাধার পাহাড় জমছে ক্রমাগত। এই অন্ধকার সময়ে আমরা সমন্বিত হওয়ার সুযোগটুকু হাতছাড়া করব কেন? ‘শিক্ষা আলোচনা’র ওয়েবসাইটটা দেখলে স্বেচ্ছা শিক্ষক, অভিভাবক বা যে-কেউ নিজেদের কিংবা প্রতিবেশি বাচ্চাদের অনায়াসেই পড়ালেখায় সাহায্য করবার রসদ পেতে পারেন।



    ‘শিক্ষা আলোচনা’র এই পদক্ষেপ এই মুহূর্তে নিঃসন্দেহে সবাই মিলে লেখাপড়াকে বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে একটা বিরাট আহ্বান। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ যদি স্বেচ্ছা শিক্ষাদানের বিষয়টা ভেবে দেখেন, আগ্রহী হন; তাহলে আর দেরি না করে কাজ শুরু করতে পারলে খুব ভাল হয়। সেক্ষেত্রে চাইলে ‘শিক্ষা আলোচনা’র ওয়েবসাইটটাও একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে। শুধুমাত্র সহায়তা পেতেই যে দেখতে হবে তা নয়, ওয়েবসাইট সহ আমাদের যে কোনও ব্যাপারে, বিশেষ করে স্বেচ্ছা শিক্ষাদানে ‘শিক্ষা আলোচনা’ সকলের মূল্যবান পরামর্শও প্রত্যাশা করে। 

     


     অম্লান বিষ্ণু - এর অন্যান্য লেখা


    ঘরবন্দি প্রাথমিক পড়ুয়া আর তাদের পড়ানোর জন্য শিক্ষকদের প্রয়াসে এক উদ্ভাবনী উদ্যোগ শিক্ষা আলোচনা।

    ছাত্র তো শিক্ষকের‌ই, শাসক যাই করুক-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested