আমার পড়া এখন অধিকাংশত আমার প্রকল্পিত লেখা বইয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যে বই লিখব বা যে লেখা লিখব, তার জন্যে বই পড়ব। তার সুযোগ নিয়ে আমি এখানে বাঘা বাঘা সব ইংরেজি বইয়ের নাম নিক্ষেপ করতেই পারতাম, তাতে পাঠকের কাছ থেকে কিছু উটকো সম্ভ্রমও জুটত। কিন্তু এ লেখায় তা করছি না।
কেন এই খামোখা আত্মত্যাগ? আমি গল্প-উপন্যাস খুব কম পড়ি এখন – বাংলায় হোক, ইংরেজিতে হোক। কিন্তু একটি বাংলা গল্পের বই পড়তে হল, আমার ছোট মেয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখো, মেয়েটি ভাল লিখেছে।’ সে ভাল লিখেছে বললেই আমি ভাল বলে মেনে নেব তা তো হয় না, কিন্তু যেহেতু তখন একটা খুব ভারী বই হাতে ছিল, দিবানিদ্রার আগে সেটা পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তাই পিয়ালী চক্রবর্তীর ‘ঠিক যতটা শর্ট ফিল্ম’ বইটি একটু তেতো মুখে হাতে নিলাম। সে আবার পেপারব্যাক, দেখে খুব ভক্তি হল না। ছেপেছে সৃষ্টিসুখ, দাম ৯০ টাকা, আর ৮.৯৯ মার্কিন ডলার। শেষটা দেখে একটু মজা লাগল বই কি।
• এই বইয়ের এক ডজন গল্পের প্রথমটি পড়েই আমি চমকে গেলাম। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমি কি পিয়ালির লেখা সম্বন্ধে একটু বেশি পরে জানলাম, অন্যরা কি আগেই ওর কদর বুঝে গেছে? • সে গল্প বলে একটা তির্যক ভঙ্গিতে আর ভাষায়, নিজেকে খানিকটা দূরে রেখে, অথচ তাদের অস্তিত্বের রসটুকু কেমন করে সে নিংড়ে বার করে আনে। বিচিত্র মানুষ আসে সব গল্পে, সব বাঙালি নয় এও খুব স্বস্তির কথা। • ভবিষ্যপুরাণে মঙ্গলগ্রহে গিয়ে ছাপোষা বাঙালির দুদিন বাস করে পালিয়ে আসার গল্প, গ্রাম্য প্রেম ও প্রিয়বিচ্ছেদের গল্প – যা পড়ে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। |
কিন্তু এই বইয়ের এক ডজন গল্পের প্রথমটি পড়েই আমি চমকে গেলাম। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমি কি পিয়ালির লেখা সম্বন্ধে একটু বেশি পরে জানলাম, অন্যরা কি আগেই ওর কদর বুঝে গেছে? বইটি দেখলাম এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সংস্করণ পেয়েছে, তাতে এই রকমই মনে হল। ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ তার নাম, তার মধ্যে ক্যালেইডিস্কোপ ধরনের টুকরো টুকরো ছবি, মধ্যবিত্ত বাড়ির শিশু থেকে বৃদ্ধ নানা চরিত্র, সকলে ছোট ছোট গল্প তৈরি করে মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য সুতোয় যেন সব বাঁধা পড়ে যাচ্ছে। পড়ে মনে হল পিয়ালীর যেমন দৃষ্টি বহুধা ছড়িয়ে যায়, তেমনই সে ছোট্ট শিশু থেকে বধির বৃদ্ধ, যে ‘কে মারা গেল’ প্রশ্নটা অনবরত করে চলে কিন্তু সংসারে গুরুত্বহীন হয়ে যাওয়ার জন্য উত্তর পায় না – সকলের মনের কথা ধরতে পারে। মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের নানা বয়সের নানা মানুষের বহুমাত্রিক সুখদুঃখের খবর যেন তার জানা। আর সে গল্প বলে একটা তির্যক ভঙ্গিতে আর ভাষায়, নিজেকে খানিকটা দূরে রেখে, অথচ তাদের অস্তিত্বের রসটুকু কেমন করে সে নিংড়ে বার করে আনে। বিচিত্র মানুষ আসে সব গল্পে, সব বাঙালি নয় এও খুব স্বস্তির কথা। সে হায়দরাবাদ আর দিল্লিতে থেকেছে, ফলে বাঙালি ছেলের সঙ্গে পাঞ্জাবি মেয়ের প্রেম, দক্ষিণ ভারতে সুনামিতে বিপর্যস্ত এক নারীর দুঃখ (এই গল্পটিতে সে যেন একটু আবেগপ্রবণ, তার বিবৃতিতে দূরত্ব নেই), এমনকি প্রবাসে বেড়ে ওঠা একটি কিশোর ছেলের বড়দের রবীন্দ্রনাথ নিয়ে মাতামাতির মধ্যে প্রাথমিক দ্রোহ সত্ত্বেও আস্তে আস্তে রবীন্দ্রনাথের কাছে আসা (‘সোনার বাঁশি’ গল্প, ‘উঁহু দাদু, তুমি দেখছি যা-তা নও। তোমাকে একটু কালটিভেট করতে হচ্ছে তো!’ শেষে সে বলছে রবীন্দ্রনাথের ছবিকে) – এই সব অভিজ্ঞতাগুলির মধ্য দিয়ে পিয়ালী আমাদের যখন নিয়ে যায় তখন আমরা ওদের সুখেদুঃখে উদ্বেলিত হতে থাকি।
এই রকম সবগুলি গল্প। ‘নুনগোলা আর টালির বাড়ি’ অসাধারণ মমতায় লেখা হয়েছে এক বর্জনযোগ্য বাসগৃহের কথা, ‘হৃদয় আমার’ গল্পে মা আর ছেলের চমৎকার বোঝাপড়া, আবার ‘হেভেন ইন্টারন্যাশনাল’ গল্পের একেবারে ভিন্ন কৌতুক – স্বর্গে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের রাজনীতিতে শিব কালী আর দুর্গার টানাপোড়েন, সেই সঙ্গে তার নারীবাদী প্রিন্সিপালের বিচিত্র সিদ্ধান্ত (নরকে গিয়ে স্কুল খুলবেন), ERROR গল্পে ভবিষ্যপুরাণে মঙ্গলগ্রহে গিয়ে ছাপোষা বাঙালির দুদিন বাস করে পালিয়ে আসার গল্প, গ্রাম্য প্রেম ও প্রিয়বিচ্ছেদের গল্প – যা পড়ে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে (আসলে সব গল্প পড়েই সেই রকম একটা কেচ্ছা হয়)। আর লেখিকার ভিতরে কোথায় যেন থাকেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সব রকম মমতা আর উজ্জ্বলতা নিয়ে।
আমি এ বইটি পড়ে সমৃদ্ধ হয়েছি। আমি লেখিকার কাছ থেকে অনেক বড় কাজ আশা করি। পাঠকদের বলি, বইটি পড়ুন, আপনাদেরও কিছু প্রাপ্তিযোগ ঘটবে, বুড়োমানুষের কথা ফেলবেন না।
আমার ছোট মেয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখো, মেয়েটি ভাল লিখেছে।’