“পাপা, পাপা চলো না আমরা লুকাছুপি খেলি।”
“মাম্মা আমাকে একটা কাহানি শোনাবে?”
কিংবা, “এই পাজলটা করতে আমি মুসিবাতে পড়ছি, থোড়া সা সহয়াতা করে দাও না।”
সোনু তাতাইয়ের মতো চার ছয় কী দশ এগারো বছরের খুদেরাও এই ভাষাতেই কথা বলে। বর্তমানে শিশুদের মাতৃভাষায় কথা বলার প্রবণতা ক্রমশ কমছে। এখন অধিকাংশই একটা মিশ্র, থুড়ি ‘ইং-বাং-দি’ ভাষায় কথা বলে। এর নেপথ্যে রয়েছে অধিক পরিমাণে কার্টুন দেখা। বাড়ি হোক বা স্কুল, কিংবা খেলার মাঠ সব জায়গাতেই খুদেরা এই মিশ্র ভাষায় কথা বলছে, যেখানে হিন্দির আধিক্য চোখে পড়ার মতো। অথচ কেউ তাদের সচেতন বা নিষেধ করছে না।
একটা সময় পর্যন্ত, মূলত একান্নবর্তী পরিবারে ছোটরা বাড়ির বড়দের সঙ্গেই খেলাধূলা করেই বড় হয়েছে। বাড়িতেই অনেকে তখন থাকত, যারা ওদের সময় দিতে পারত। কিন্তু এখন অধিকাংশ পরিবারই ছোট পরিবার, মা, বাবা এবং সন্তান; মা বাবা দু’জনেই কর্মরত। ফলে বাচ্চাকে তারা যথেষ্ট সময় দিতে পারছে না। যার জন্য এক সময় যে কার্টুন শুধুমাত্র বিনোদনের একটি উপায় ছিল, আজ বাচ্চারা অধিকাংশ সময় সেটা দেখেই তাদের অবসর সময় অতিবাহিত করছে। ফলে, ছোটা ভীম, মোটু পাতলু, বালু, গ্রিজি অ্যান্ড দ্য লেমিংস, অগির প্রতি যেমন খুদেদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে, তেমনই রপ্ত করছে তাদের ভাষা।
কিন্তু কার্টুন বলতে আজকাল বাচ্চারা কেন শুধু হিন্দি ভাষার কার্টুন বোঝে? বাংলায় কার্টুন হয় কোথায়? একটি মাত্র চ্যানেলে গোপাল ভাঁড় দেখানো হয় কেবল। আর কোথায় বাংলা কার্টুন? 80-90 এর দশকে নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট, গোপাল ভাঁড়ের মতো কার্টুন দু’একটি চ্যানেলে দেখা গেলেও এখন সিরিয়ালের চাপে তা প্রায় উধাও। ফলে বাচ্চাদের হিন্দি কার্টুনের দিকেই ঝুঁকতে হচ্ছে। আর সেই কার্টুন দেখতে গিয়ে তারা হিন্দি ভাষাটাকে এমন ভাবে রপ্ত করে বাংলার সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে যে, এক ধরনের অদ্ভুত ভাষা বলছে তারা।
শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক পবিত্র সরকার এই বিষয়ে বললেন, “এটি প্রচ্ছন্ন হিন্দি প্রচারের কৌশল, শিশুরা যদি একাধিক ভাষা শোনে তারা শিখতেও পারে। তাই অভিভাবকদের দায়িত্ব বাচ্চাদের সামনে বেশি করে বাংলা বলা এবং তাদের বোঝানো যে হিন্দি ভাষা হিন্দির মতো করে এবং বাংলাকে বাংলার মতো করে বলতে হবে। অভিভাবকদের উচিত বাচ্চাদের স্বার্থে বাংলা ভাষায় কার্টুনের দাবি জোরদার করা।’’
অন্যদিকে বাংলা পক্ষের সাধারণ সম্পাদক গর্গ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন “শিশুর মনে সহজে প্রবেশ করে মাতৃভাষা, কারণ সে সেটা সারাক্ষণ তার চারপাশে শুনছে। এর পাশাপাশি তাদের মনে সহজে জায়গা করে কার্টুন, যেটা তারা হিন্দি ভাষায় শোনে এবং দেখে। এর ফলে ছোট থেকেই ওদের কল্পনার জগৎ এমন কিছু বিজাতীয় ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয় যে, প্রথম থেকেই সে পঙ্গু হয়ে যায়। কল্পনার জগতে প্রিয় চরিত্রদের ভাষার সঙ্গে বাবা মায়ের বলা ভাষার মিল না থাকায় নিজের ভাষার প্রতি যত্নশীল হয় না। একটা মিশ্র ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। বর্তমান শিক্ষার পরিকাঠামো এমন যে, সন্তানদের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে বা হিন্দিকেন্দ্রিক ভারতীয়ত্বের যে পরিকল্পনা স্কুলে স্কুলে রয়েছে, মা বাবারা বাধ্য হচ্ছেন তা মেনে নিতে। সরকারের উচিত বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে স্কুল কলেজ ও পেশাক্ষেত্রে এমন সুযোগ সুবিধা দেওয়া যাতে অভিভাবকরা সন্তানদের বাংলা মাধ্যমে পড়াতে আগ্রহী হন।’’
আরও পড়ুন :সোশাল মিডিয়া করতে মানা শিক্ষকদের!
মহামারীর ফলে শিশুর মনোজগৎ ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে, খেলার সঙ্গীর অভাব, বাবা মায়ের ব্যস্ততা, ঠাকুমা দাদুর অনুপস্থিতি পূরণ করে দিচ্ছে মোটু পাতলু, ছোটা ভীম-রা, যারা অবলীলায় তাদের কল্পনার জগতকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। কলকাতার পাভলভ হাসপাতালের শিশু মনোবিদ জয়িতা সাহা বললেন, “একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও সামাজিকীকরণের জন্য ভাষার বিকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্যান্ডেমিকের জন্য বাচ্চারা স্কুল জীবন কম পাচ্ছে। পরিবারের লোকজন ছাড়া বাকি সময় সে হয় পড়ছে, নইলে টিভিতে কার্টুন দেখছে। বেশিরভাগ সময় কার্টুন দেখার ফলে বাচ্চাদের ভাষায় ও বলার ভঙ্গিতে সেই বিশেষ বিশেষ চরিত্রের সুস্পষ্ট ছাপ থাকছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাত্রায় ইলেকট্রনিকস গ্যাজেটস ব্যবহারের ফলে ছোটদের মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটছে। বাংলা ভাল ভাবে না শেখার ফলে শিশু হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে একরকম মিশ্র ভাষায় কথা বলছে এবং নিজের মাতৃভাষার প্রতি তার ভালবাসা তৈরি হচ্ছে না। উল্টে একটা ভয় তৈরি হচ্ছে। পরবর্তীকালে দায়সারা ভাবে শিখছে ভাষাটা। এক্ষেত্রে বাবা মাকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।’’ জয়িতা সাহার কথা বছর এগারোর কিশোর উজান গুপ্তর মা দীপান্বিতা গুপ্তর কাছ থেকেও শোনা গেল। তিনি বলেন, “পড়াশোনা ছাড়া তো সারাদিন কার্টুন নিয়েই থাকে। এখন যদিও ফোনটাও নতুন আকর্ষণের বিষয় হয়েছে। তবে শুধু কার্টুনকে তো দোষ দিয়ে লাভ নেই, বাংলা ভাষার তো এমনই অবনতি হয়েছে। অনেক প্রথম সারির নিউজ চ্যানেল বা বাংলা চ্যানেলেও যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয় সেগুলো তো আদৌ বাংলা নয়! ফলে বাচ্চারা তো সেখান থেকেও ভুল বাংলা শিখছে!’’
ফলে, শুধু কার্টুন নয়, বাবা মা, সরকার, এক কথায় শিশুদের আশপাশে যারা আছে তাদের সবাইকেই কম বেশি এই মিশ্র ভাষা শেখার দায় নিতে হবে। বাবা মায়ের পাশাপাশি সরকারকেও বাংলা ভাষা সম্বন্ধে আরও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলা কার্টুন আরও বেশি করে আনতে হবে। চ্যানেলে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয় তার প্রতিও যথেষ্ট নজর দিতে হবে।
টিভিতে দেখানো হিন্দি কার্টুনের জন্য হিন্দি-ইংরেজি-বাংলা মেশানো এক অদ্ভুত ভাষা শিখছে বাচ্চারা।