2014 সালে ক্ষমতায় এসে হুঙ্কার ছেড়েছিলেন, 'শির পে মত চড়ো। ভাইকো তরা রহো'। সেই সময় অবশ্যই তাঁর টার্গেট ছিল সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। ব্যাপারটা যে ব্যুমেরাং হবে, তা বোঝেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। না বোঝারই কথা। কোনও হিন্দুত্ববাদী প্রচারক ক্ষমতান্ধ হলে তাই হয়। 2019-এ নয়া নাগরিকত্ব আইন (CAA) আর জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (NRC) ঘিরে পশ্চিমবঙ্গে বিতর্ক দেখা দেয়। পরপর কয়েকটি রেলস্টেশন আক্রমণ করা হয়। মোদী তখন বলেছিলেন, "কারা আক্রমণ চালাচ্ছে তাদের বেশভূষা দেখলেই তা বোঝা যায়"। ছুঁড়ে দেওয়া তীর আর বলে ফেলা কথা ফিরে আসে না। অবশ্যভাবেই সে ইঙ্গিত ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। এভাবে জনমানসে বা নিজের দল বিজেপির মধ্যে মোদী বুনে দিয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার বিষ। সমাজে তা গরল হয়ে দেখা দিয়েছে। মেরুকরণ আর সাম্প্রদায়িকীকরণ রাজনৈতিক ছকের খেলা মোদীর নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। বাঘের পিঠে চড়ে রয়েছেন মোদী। উগ্র হিন্দুত্ব এখন মোদীর সব চেয়ে বড় শত্রু। তাকে বাগে আনা তাঁর কর্ম নয়। তাই মোদীর ডুবন্ত নাওয়ের পারের তরী হয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবত। তাঁর তত্ত্বাবধানেই প্রচারক হিসাবে বেড়ে উঠেছিলেন মোদী। মোদী যখন প্রচারক, ভাগবত সংঘের প্রচার প্রমুখ। নাগপুরের গৃহে ভাগবতের পিতা মধুকর রাওয়ের শিক্ষা ও দীক্ষায় গড়ে ওঠেন মোদী। অবস্থা সামাল দিতে ভাগবত আগেই বলেছিলেন, ''হিন্দু-মুসলমানের ডিএনএ এক।' এবার দাবি করেছেন, 'ভারতের মুসলমানরা হিন্দু মুনি, ঋষি আর ক্ষত্রিয়দের বংশধর।''
1939 সালে আরএসএস-এর দ্বিতীয় সংঘপ্রধান মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর 'উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড' গ্রন্থে কোনও সম্প্রদায়ের নাম না করে লেখেন কারা বহিরাগত আর বিদেশি। কেন মুসলিম আর খ্রিস্টানরা এই দেশের নাগরিকত্ব পেতে পারেন না। যতক্ষণ না তারা জাতীয় আবেগ মেনে নিয়ে এই দেশের জমি, জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি আর ভাষার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান বা 'অ্যাসিমিলেট' করেন। 2006-এ আরএসএস সে লেখা বাতিল করে দেয়। তবে মোদী তা ভোলেননি। নিজের বা দলের ভোটব্যাঙ্ক তৈরির জন্য তিনি বা তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা তা প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে লেখেন। খুব আশ্চর্যের যে গোলওয়ারকর বা 'গুরুজি' বলে সংঘের মধ্যে পরিচিত তাঁর সেই গ্রন্থের মুখবন্ধ লিখেছিলেন কংগ্রেস নেতা এমএস অ্যানি। তখন চলছিল ত্রিপুরি কংগ্রেসের অধিবেশন। 1966 সালে গোলওয়ালকার লেখেন 'বাঞ্চ অফ থটস' বা 'চিন্তাচয়ন'। এবার তিনি চিহ্নিত করেন ভারতের প্রধান তিন শত্রু— মুসলিম, খ্রিস্টান আর কমিউনিস্ট৷ মোদী আর তাঁর দলের অত্যুৎসাহী কর্মীরা সেই ফর্মুলাতেই চলছেন।
মাঝেমধ্যেই চাণক্য থেকে উদ্ধৃতি দেন মোদী। তবে বোঝেন না কেন চাণক্য বলেছিলেন, অপ্রিয় সত্য বলা রাজার সাজে না। কারণ রাজা 'হ্যাঁ' বললে তার মানে হয় 'হয়তো'। 'হয়তো' বললে তার মানে হয় 'না'। আর না বললে তিনি কোনও রাজা নন বা হতে পারেন না। তাই শাহিনবাগ থেকে কাশ্মীর সর্বত্র মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের একপেশে ধারণা ফুটে উঠছে। প্রকাশ্যে তিনি বলেন না। কেবল আড়াল থেকে মদত দিয়ে থাকেন।
2014-র পর থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর আগ্রাসী মনোভাব আজ বিজেপিতে ক্যানসারের মতো দেখা দিয়েছে। সেই সময় মোদী ভুলে গিয়েছিলেন তিনি ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান। কোনও দলীয় বা সাংগঠনিক প্রধান নন। তাই তাঁর তৈরি করা অসুখ চাইলেও চট করে সারবে না। সাম্প্রতিক উদাহরণ দলের জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা আর নবীন জিন্দল। তাঁরা অকারণে ইসলামের পয়গম্বর আর রসুল মহম্মদকে আক্রমণ করেছেন। হাস্যকরভাবে তাও অকিঞ্চিৎ একটি টিভি চ্যানেলের বিতর্কে। বিজেপি তাই 'ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট' বা 'পাড়ের বা ধারের নেতা' বলে তাঁদের ঘাড় থেকে নামাতে চাইছে। অবাক কাণ্ড বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র আজ পাড়ের নেতা! একেই বলে 'ঠেলার নাম বাবাজী'। বিশ্বজুড়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলি এককাট্টা হয়ে মোদী আর তাঁর সরকারের বিরোধিতায় সরব হওয়ায় আচমকাই গুটিয়ে গিয়েছেন মোদী।
2002-এ গুজরাত দাঙ্গার পর বিশ্বজুড়ে নিন্দিত হয়েছিলেন মোদী। আনুমানিক 14 বছর আমেরিকা তাঁকে ভিসাই দেয়নি। নূপুরের দাবি হাস্যকর। তিনি নাকি ইসলামের ধর্মীয় গ্রন্থ থেকেই পাঠ করেছেন। হলফ করে বলা যায় নূপুর মিথ্যা বলছেন। তিনি আরবি ভাষা জানেন না। পড়েনন। ফলে তাঁর পক্ষে ইসলামের ধর্মীয় গ্রন্থ সঠিকভাবে পড়া বা বোঝা অসম্ভব। তিনি অনুবাদ পড়ে বিদ্যা জাহির করছেন। যেমন সংস্কৃত না জেনেই অনেকে বেদ, উপনিষদ বা গীতা, পুরাণ পড়ে ফেলেন আর রাত পোহালেই হিন্দুত্ববাদী হয়ে যান।
আরও পড়ুন: শ্যাম না কূল, কোনটা রাখবেন মোদী?
আজ মোদীর নিজের দলের লোকেরাই তাঁর মাথায় পা দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। অনেকটা ডোন্ট কেয়ার ভাব। কে বেশি হিন্দুত্ববাদী তা প্রমাণের জন্য প্রতিযোগিতা চলছে। আর এই সব কিছুর জন্য দায়ী করা যায় মোদীকেই। তিনি এবং তাঁর কিছু অত্যুৎসাহী ভক্ত বেশ কিছুদিন থেকেই মুসলিম সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে দল বা সরকারের মধ্যে নম্বর কুড়োনোর লড়াইয়ে নেমে পড়েছেন। গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে উঠেছে সারা ভারত হিন্দু মহাসভা আর কিছু অতি হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় সংগঠন। জাতীয়তাবাদের অপব্যাখ্যা করে তাঁকে হিন্দুত্ববাদের মোড়কে মুড়ে ফেলে তারা ব্যক্তি আর সমষ্টিগত আক্রোশ চরিতার্থ করছে। ভালমন্দয় কেটে গিয়েছে মোদীর সাত বছর। ভালর থেকে মন্দই বেশি। যদিও সংসদের 303 আসন তাঁর দল বিজেপির দখলে। এটা নতুন বা আহামরি কিছু নয়। কংগ্রেস 30 বছর রাজত্ব করে সবকিছু ভাল করতে পারেনি। অথচ সংসদে 413টি আসন পেয়েছে। বেশ কয়েকবার 300-র গণ্ডি পেরিয়েছে। তাই আসন নিয়ে বড়াই করে দোষ খারিজ করা যায় না। এটা সবাই মানবেন। মোদীকেও মানতে হবে। আগামীদিনে 10 রাজ্যে নির্বাচন। সব মিলিয়ে সেখানে অন্তত 18-20 শতাংশ মুসলিম ভোট। তাই আজ অনন্যোপায় মোদী আর মোহন ভাগবত। সাম্প্রদায়িকতা নামক বাঘে চড়ে মোদী৷ তাঁর মাথায় পা দিয়ে হাঁটছেন তাঁরই দলের আগমার্কা কিছু সদস্য। মৌলবাদী মুসলিম নয়। তার থেকেও সাংঘাতিক গোষ্ঠীবাদী হিন্দুরাই আজ মোদীর শিরে চড়েছেন। শির না কাটা পর্যন্ত মনে হয় না তারা নামবেন। রেহাই পাবেন না নরেন্দ্র মোদীও।
নরেন্দ্র মোদীর ঘাড়ে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে এখন আরও সাঙ্ঘাতিক ধর্মান্ধ গোষ্ঠিবাদী মুসলিমবিদ্বেষী হিন্দু