×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • 1971 আজকের ভারতের শিক্ষক

    সুদীপ্ত সেনগুপ্ত | 15-12-2021

    নিজস্ব ছবি।

    আজ থেকে ঠিক 50 বছর আগে বাঙালি প্রমাণ করেছিল যে সে ভাষিক সত্ত্বাকে ধর্মীয় সত্ত্বার ঊর্ধে স্থান দেয়। বাংলাভাষী হিসাবে এতে আমি গর্বিত। আবার এই গর্বের কারণটাই দেশের অন্য প্রান্তে প্রতিবেশীকে যে চিরস্থায়ী শত্রুতে পরিণত করেছে, তা আমাকে ব্যথিত ও হতাশ করে। ইতিহাসের দুই বিপরীতমুখী চলনের টানাপোড়েনের মাঝখানে পড়ে অস্থিরতাই সম্ভবত বাঙালির নিয়তি।

     

    করাচি প্রেস ক্লাবে এক জমায়েতে সেখানকার সাংবাদিকদের সঙ্গে কলকাতা থেকে যাওয়া সাংবাদিক দলের সদস্য হিসাবে কথা হচ্ছিল (ফেব্রুয়ারি, 2014)। ভারত ও পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রীতির সম্পর্ক, দুদেশের সাংবাদিকরা যখন অনেক দিন পর বিশ্বের যেখানেই দেখা হোক না পরস্পরকে ভ্রাতৃসুলভ আলিঙ্গন করে দেশীয় আড্ডায় মেতে ওঠেন, তখন দুই দেশের সরকারের মধ্যে চিরস্থায়ী বৈরভাব কেন? এই আলোচনায় পাকিস্তানের অগ্রগণ্য এক সাংবাদিকের বক্তব্য ছিল, দুই বন্ধু, স্বামী, স্ত্রী, দুই প্রতিবেশী – যে কোনও দুই পক্ষের মধ্যে যখন লড়াই হয়, দেখবে শেষ মারটা যে মেরেছে সে ভুলে যায়, যে মার খেয়েছে সে ভুলতে পারে না। সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার আগে তোমার প্রেমিকার সঙ্গে হাজার চিঠি চালাচালির কথা তুমি ভুলে যাবে, কিন্তু শেষ যে চিঠিটা লিখে উত্তর পাওনি, তার কথা কোনও দিন তুমি ভুলবে না, সে অনায়াসে ভুলে যাবে। তেমনই 1971 হল আমাদের – অন্তত শাসকবর্গের দৃষ্টিতে – একটা অসমাপ্ত কাহিনি। ভারত পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদ করেছে 71-এ, আর কাশ্মীরে দশকের পর দশক ধরে দুনিয়া যা দেখছে তা হল পাকিস্তানের দিক থেকে বদলা নেওয়র চেষ্টা। পাশ থেকে এক তরুণ সাংবাদিক জুড়ে দিলেন, হিসাব বরাবর করনে কা খেল!

     

     

    রাষ্ট্র হিসাবে অহং-এর হিসাব চুকানোর যে চেষ্টা পাকিস্তান আজও করে যাচ্ছে, ভাষা পরিচয়ের বিচারে সেই অহং-এর হিসাবই বাঙালি বুঝে নিয়েছিল 1971-এ। উর্দুই হবে পাকিস্তানের ভাষা, কারণ সেটাই মুসলমানের আসল ভাষা, নিজের ভাষা – এই ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছিল সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি। সে সদর্পে ঘোষণা করেছিল ধর্মে মুসলমান, ভাষায় বাঙালি হওয়া সম্ভব। এই ভাষা সত্ত্বাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়েই পূর্ববঙ্গের বাঙালি নিজের রাষ্ট্রীয় সত্ত্বা বর্জন করেছিল। পাকিস্তান বা পবিত্র ভূখণ্ড থেকে সে হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ বা বাংলা ভাষার ভূখণ্ড ইসলামের দর্শন এবং ইতিহাসের সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে, তারা জানেন, এ বড় সাধারণ কথা নয়! এ লড়াইয়ের ভুরি ভুরি নজির আছে এমনও নয়! হাজার হাজার যুবকের প্রাণ ও যুবতীর সম্ভ্রম, মহানগর ঢাকা সমেত শহরাঞ্চলে সমাজের বৌদ্ধিক নেতৃত্বদানকারী অংশের একটা বিরাট অংশের জীবন এই লড়াইয়ে মূল্য হিসাবে দিতে হয়েছে। বিনিময়ে পাওয়া গিয়েছে নিজের ভাষার মর্যাদা, ভাষার নাম সম্বলিত নিজের দেশ আর 28 বছর পর পাওয়া গিয়েছে বাংলা ভাষা শহিদ দিবস 21 ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রপুঞ্জের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি। সারা পৃথিবীতে ভাষার স্বাধীনতা ও বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বাংলা ভাষার একটা বিশেষ স্থান আছে এটা বাংলাদেশের বাঙালির মতো ভারতের বাঙালি হিসাবে আমারও শ্লাঘার কারণ।

     

    আরও পড়ুন:এ আঁধারে মশাল হাতে ওঁরা সব আন্দোলনের নারী

     

    বিজ্ঞান বলে কোনও থিয়োরি বা তত্ত্ব যখন ব্যবহারিক প্রয়োগ করতে গিয়ে মেলে না বা ব্যর্থ হয়, তখন তাকে পরিত্যাগ করে নতুন থিয়োরির সন্ধান করাই ঠিক। এই যে 50 বছর আগে আমরা বাঙালিরা লড়াই করে সাভারকার-জিন্নার ধর্ম সম্প্রদায়ভিত্তিক দ্বিজাতি তত্ত্বকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণ করলাম তার ফলটা কী হল? আমরা ভারতীয়রা জাতি হিসাবে কি মেনে নিলাম যে, ধর্ম পরিচয়ই মানুষের প্রধান পরিচয় এবং তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন হতে পারে, এই তত্ত্ব ভুল? বর্তমান ভারতের দিকে তাকালে তা তো মনে হয় না। বরং গত কয়েক বছরের ভারতের ছবিটা নিবিড় ভাবে দেখলে উল্টোটাই তো মনে হয়। একটা ব্যবহারিক প্রয়োগে ভুল বলে প্রমাণিত তত্ত্বকেই তো ঠিক বলে খাড়া করার চেষ্টা চোখে পড়ে, যেখানে ভারতীয় হওয়ার জন্য হিন্দু হওয়ার কথা বলা হয় এবং ভাষা-সহ যে কোনও সত্ত্বার বহুত্ববাদ প্রবল ভাবে অস্বীকার করা হয়। বাঙালি যা ভুল প্রমাণ করেছে, ভারতের বৃহদংশ তাকেই 50 বছর পর ঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, এর মধ্যে একটা দুই বিপরীতমুখী ভাবনার সংঘাত আছে। ভারতের বৃহদংশের কাছে বাঙালি একটু একটেরে, কেমন যেন আড় হয়ে থাকা একটা জনগোষ্ঠী বলে যে পরিচিত, তার মূলে কি এই সংঘাত প্রশ্নটার উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু তাতে প্রশ্ন করা আটকায় না!

     

    1971-এর আর একটা শিক্ষা রাষ্ট্রক্ষমতার সুনিপুণ এবং সদর্থক ব্যবহার। মার্চ মাস থেকে সংঘাত শুরু। ভারতীয় বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিল, সাধারণ নাগরিকের সাহায্য ও প্রশ্রয় পেয়ে উর্দি ছাড়াই পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে মিশে সেখানকার মাটিতে কাজ করল, ইতিমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করে এবং আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে এমন আবহ তৈরি করলেন যে মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে বাংলায় ঢুকতে সাহস পেল না। আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী আগে ইন্দিরা গান্ধী নামক এক মহিলা এটা করতে পেরেছিলেন, এটা ভাবলেও ভারতীয় এবং নারী-পুরুষের সমমর্যাদায় বিশ্বাসী এক জন মানুষ হিসেবে আমি গর্ব বোধ করি। আমার মতো আরও অনেকেই নিশ্চয় করেন! কারণ, বর্তমান শাসককুল এবং তাদের অনুগত সোশাল মিডিয়া বাহিনী যখন আর দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার পিতা ও পুত্রের গঞ্জনা না করে টাচপ্যাড স্পর্শ করেন না, তখন ইন্দিরা সম্পর্কে তারা এত নিস্পৃহ কেন?

     

    উপরের শেষ দুটো প্যারাগ্রাফে যে দুটো প্রশ্ন উঠছে, তাতেই কিন্তু বোঝায় যায় 1971 ইতিহাস হয়ে যায়নি। 50 বছরে ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা এগিয়ে যেতে পারিনি। তাই বর্তমান ভারতের শিক্ষকের ভূমিকায় 1971-এর ভারতকে রাখতেই হচ্ছে।

     


    সুদীপ্ত সেনগুপ্ত - এর অন্যান্য লেখা


    সদ্যপ্রয়াত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে আবেগের সুনামিতে একবারও আমাদের মনে পড়ল না অন্য কৃতীদের।

    আয়কর হানা - Independent Public Spirited Media Foundation এবং Centre for Policy Research-এ

    তৃণমূলের কর্মী সমর্থক বলে তোলাবাজি করা গুণ্ডারা এলাকার বাসিন্দা প্রবীণ নেতা সৌগত রায়কে চেনে না!

    22 জুন শর্ত সাপেক্ষে রথযাত্রার নির্দেশে প্রভু জগন্নাথের তো অখুশি হওয়ার কোনও কারণ দেখা যাচ্ছে না। জয়

    রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মুর বিরুদ্ধে বিরোধীদের যশবন্ত সিনহা কোনও প্রার্থীই নন

    সোনার পালঙ্কে তুলোর গদিতে শুয়ে 170 বছরের লেডি লিবার্টির প্যারিস থেকে টোকিও যাত্রা।

    1971 আজকের ভারতের শিক্ষক-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested