×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • আমি প্লেগদেবী

    তরুণ গোস্বামী | 27-03-2020

    কলকাতায় প্লেগ যখন মহামারী

    ১৮৯৮ সালের গোড়ার দিককার কথা। কলকাতায় কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল, বোম্বাইয়ে একটা ভয়ানক ব্যাধি দেখা দিয়েছে, তার নাম প্লেগ। এমন সময় একদিন সন্ধ্যায় বম্বে মেল থেকে নামলেন এক মহিলা। সেযুগের রীতি অনুযায়ী তাঁর মুখ ছিল ঘোমটায় ঢাকা। হাওড়া স্টেশনের বাইরে এখন যেখানে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড হয়েছে, আগেকার দিনে সেখানে ছিল ঘোড়ার গাড়ির আড্ডা। সেই মহিলা একখানি ঠিকে গাড়ি ভাড়া করে তিনি চললেন কলকাতায়। গঙ্গার ওপরে কাঠের পুল বেরিয়ে গাড়ি যখন হ্যারিসন রোডে, কোচোয়ান জানতে চাইল, কোথায় যাবেন মা? মহিলা গাড়ির ভেতর থেকে জবাব দিলেন, আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি প্লেগদেবী। কোচোয়ান আঁতকে উঠে পিছন ফিরে দেখে, গাড়িতে কেউ নেই।

    ঊনিশ শতকের শেষভাগে প্লেগ নিয়ে এই গল্পটা ছড়িয়েছিল। তার কথা শুনিয়েছেন প্রেমাংকুর আতর্থী। তাঁর ‘মহাস্থবির জাতক’ বইতে আছে। কলকাতায় প্লেগ মহামারীর সময় প্রেমাংকুর নিতান্ত বালক। বয়স আট বছর। পরিণত বয়সে তিনি লিখেছেন, শহরে প্লেগ রোগ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্পোরেশন থেকে সবাইকে টিকে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগল। কিন্তু শহরবাসী তাতে রাজি হল না। গুজব ছড়াতে লাগল, প্লেগের টিকে নেওয়ার ১০ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত। কেউ আবার বলল, পেট থেকে এক পয়সা মাপের মাংসখণ্ড তুলে নিয়ে তার মধ্যে প্লেগের জীবাণু পুরে দেয়।

    তখন কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান ছিলেন কুক সাহেব। অনেকে তাঁকে মারবে বলে সুযোগ খুঁজতে লাগল।

    সেই আমলে সমাজে সর্বক্ষেত্রে ব্রাহ্মরা ছিলেন অগ্রণী। সাধারণ লোক যখন টিকে নেবে না বলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তাঁরা স্বেচ্ছায় গেলেন টিকে নিতে। প্রেমাংকুরও ছিলেন ব্রাহ্ম ঘরের সন্তান। কুক সাহেব তাঁকে টিকে দিয়েছিলেন। তারপরে প্রবল জ্বর এসেছিল। ২৪ ঘণ্টা ছিলেন অচেতন।

    ১৮৯৮ সালের প্লেগ সম্পর্কে সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় যে বিবরণ পাওয়া যায়, সে খুব সাংঘাতিক। সেখানে আছে, ‘প্লেগের কথা শুনিয়া কলিকাতাস্থ লোকের আতঙ্ক ভয়ানক বৃদ্ধি পাইয়াছিল। সকলেই বিভব দূরে ফেলিয়া পুত্রকন্যা লইয়া শহর ত্যাগে প্রস্তুত হইল। সে ভয়, সে ভাবনা সহজে বর্ণনা করা যায় না…।’

    সবাই ভেবেছিল, দূরে পালিয়ে গেলে মহামারীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। হাজার হাজার মানুষ ট্রেনে, ঘোড়ার গাড়িতে, আরও যেভাবে পারে শহর থেকে পালাতে চেষ্টা করল। স্ত্রী, সন্তানেরাও তাদের সঙ্গে ছিল।

    তখন হাওড়া স্টেশনে, স্টিমার ঘাটে কাতারে কাতারে মানুষের ভিড় হল। রেল কোম্পানি বাড়তি ট্রেন চালিয়েও অতিরিক্ত যাত্রীদের চাপ সামলাতে পারছিল না। এই সুযোগে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, নৌকা, মুটে, সকলেই ভাড়া হাঁকতে লাগল চারগুণ, পাঁচগুণ।

    এইরকম অবস্থা মাস তিনেক চলার পরে শহরে শুরু হল দাঙ্গাহাঙ্গামা। সরকার ঘোষণা করেছিল, কর্পোরেশনের লোক বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখবে, কারও প্লেগ হয়েছে কিনা। যদি রোগীর সন্ধান পায়, তাহলে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।

    একথা শুনে শহরে যত গরিব মানুষ ছিল, সরকারের ওপরে ভীষণ রেগে গেল। গুজব ছড়িয়েছিল, প্লেগ হাসপাতালে গেলে কেউ বাঁচে না। ডাক্তাররাই ইঞ্জেকশন দিয়ে রোগীকে মেরে দেয়। এমনকি প্লেগরোগী নিয়ে যাওয়ার জন্য যে গাড়ি পাঠায়, তার ভেতরে বিষ মাখানো থাকে। সুস্থ লোকও সেই গাড়িতে উঠলে কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যায়।

    শহরের গরিব মানুষকে যেন একপ্রকার পাগলামিতে পেয়ে বসল। ঝাড়ুদার, মেথর, ভিস্তিওয়ালা ও কুলি-মজুররা বলল, আমরা কাজ করব না। ধর্মঘট। গোটা শহর আবর্জনায় ও দুর্গন্ধে ভরে উঠল। অনেকে দলবদ্ধভাবে লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। কর্পোরেশন থেকে প্লেগের কোয়ারান্টাইন কেন্দ্র বানানোর জন্য ঠিকাদারদের দায়িত্ব দিয়েছিল। তাদের দেখলেই জনতা লাঠি নিয়ে তাড়া করত। অনেক নিরীহ ভদ্রলোকও ঠিকাদার সন্দেহে মার খেল।

    শেষকালে বাংলার ছোটলাট স্যার জন উডবার্ন ঘোষণা করলেন, প্লেগ হলে সকলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে না। বাড়িতে একটা পরিষ্কার ঘরে কোয়ারান্টাইন করে রাখলেই চলবে। তাতে মানুষের ক্ষোভ কিছুদূর প্রশমিত হল।

    কলকতায় যখন প্রথম প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে, স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন দার্জিলিং-এ। আমেরিকা থেকে ফিরে অতিরিক্ত পরিশ্রমে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন শৈলাবাসে। প্লেগের খবর শুনেই তিনি কলকাতায় ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু মহামারীর মোকাবিলা করার জন্য অত টাকা পাওয়া যাবে কোথা থেকে?

    তার কিছুদিন আগে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে বেলুড় গ্রামে জমি কেনা হয়েছিল। মঠ তৈরি হবে। স্বামীজি স্থির করলেন, জমি বিক্রি করে সেই টাকা প্লেগরোগীদের সেবায় ব্যয় করবেন। বাধা দিলেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের জননী সারদা দেবী। তিনি বোঝালেন, শুধু একবার ত্রাণকার্য চালিয়েই কি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের কাজ শেষ হয়ে যাবে? মঠ থাকলে ভবিষ্যতেও বহুবার মানুষের সেবার কাজ হতে পারবে।

    প্লেগ মহামারীতেই প্রথমবার ত্রাণের কাজ করেছিল তখনকার সদ্যগঠিত রামকৃষ্ণ মিশন। প্লেগ খুব ছোঁয়াচে রোগ। রোগীর ধারেকাছে কেউ যেতে সাহস পেত না। স্বামীজি ও তাঁর গুরুভ্রাতারা দরিদ্র বস্তিতে রোগীদের মধ্যে পড়ে থেকে দীর্ঘকাল সেবা করেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। তাঁর কথা শুনিয়েছেন সেকালের নামজাদা ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর। তিনি লিখেছেন, ‘একদিন চৈত্রের মধ্যাহ্নে রোগী পরিদর্শনান্তে গৃহে ফিরিয়া দেখিলাম, দ্বারপথে ধুলিধূসর কাষ্ঠাসনে একজন য়ুরোপীয় মহিলা উপবিষ্টা। উনিই ভগিনী নিবেদিতা।’

    রাধাগোবিন্দ কর সেদিন সকালে বাগবাজারের বস্তিতে প্লেগে আক্রান্ত এক শিশুকে দেখে এসেছিলেন। সে কেমন আছে খোঁজ নেওয়ার জন্য ভগিনী নিবেদিতা ডাক্তারের বাড়ির সামনে বেঞ্চিতে বসে অপেক্ষা করছিলেন। ছেলেটির খবর নেওয়ার পরে তিনি রাধাগোবিন্দ করের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন, বাগদি বস্তিতে প্লেগের পরিচর্যা করা যাবে কীভাবে।

     

    ইনফ্লুয়েঞ্জার কোপে

    ১৯১৮ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়, তখন পৃথিবীর লোকসংখ্যা ছিল ১৮০ থেকে ১৯০ কোটির মধ্যে। তার মধ্যে ৫০ কোটি লোকই আক্রান্ত হয়েছিল ইনফ্লুয়েঞ্জায়। মারা গিয়েছিল পাঁচ থেকে ১০ কোটি। মানুষের ইতিহাসে অত বড় মহামারী আর হয়নি।

    কলকাতায় ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর বর্ণনা দিয়েছেন অতুল সুর। তাঁর ‘শতাব্দীর প্রতিধ্বনি’ বইতে আছে, ভারতে সেবার ৮০ লক্ষ লোক ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা গিয়েছিল। কলকাতাতেও এত মারা গিয়েছিল যে, শ্মশানে দাহ করার স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। গঙ্গার পাড়ে আধ মাইল জুড়ে মড়ার খাটগুলো রাখা ছিল।

    এই মড়কের মধ্যেও কলকাতায় যুদ্ধজয়ের উৎসব করেছিল সাহেবরা। শ্যামবাজারে পোড়ানো হয়েছিল লক্ষ টাকার আতসবাজি। তার রোশনাইয়ে আলোকিত হয়ে উঠেছিল রাতের আকাশ।

    ঝিনঝিনিয়া রোগ

    এই রোগটারও বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন অতুল সুর। কলকাতার লোকে বলত ঝিনঝিনিয়া রোগ। ডাক্তারি পরিভাষায় তার নাম কী জানা নেই। ১৯৩৪ সালে ভয়াল ভূকম্পে ধ্বংস হয়েছিল বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সেই বছরই কলকাতায় দেখা দিল আর একরকম মহামারী।

    সে ভারী অদ্ভুত রোগ। একটা সুস্থ মানুষ রাস্তা দিয়ে দিব্যি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, হঠাৎ পুরো শরীর ঝিনঝিন করে উঠল। ধপ করে পড়ে গেল রাস্তায়। আশপাশের লোক দৌড়ে এসে দেখল, তার শরীরে প্রাণ নেই। চিকিৎসার সুযোগও পাওয়া যেত না সেই রোগে। ঝিনঝিনিয়া রোগে শহরে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কে কোথায় মরে পড়ে থাকত বাড়ির লোক জানতেও পারত না। কেউ হয়তো রাস্তায় বেরিয়েছে, বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলে সবাই চিন্তায় আকুল হত। শেষে সবাই হাতে একরকম পিতলের চাকতি বেঁধে রাস্তায় বেরোন অভ্যাস করল। তাতে নাম ও বাড়ির ঠিকানা লেখা থাকত। কেউ যদি পথে মারা যায়, রাস্তার লোক ওই দেখে তার বাড়িতে খবর দিত।

     

    শেষ কথা

    মানুষের ইতিহাসে মহামারী ঘুরে ঘুরে আসে। সেই অষ্টাদশ শতকে বিষয়টিকে একভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন এক ইংরেজ ধর্মযাজক। তাঁর নাম টমাস রবার্ট ম্যালথুস। তাঁর তত্ত্বের মূল কথা হল, জনসংখ্যা যখন খুব বেড়ে যায়, তখন দেখা যায় খাদ্যাভাব। এমন পরিস্থিতিতে প্রকৃতি নিজস্ব উপায়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। সে পাঠিয়ে দেয় মহামারী, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ।

    কোভিড-১৯ মহামারীর সময় ম্যালথুসীয় তত্ত্বের কথা মনে পড়ছে অনেকের।

    সব শেষে একটা কথা বলা যায়। কোনও মহামারীই কয়েক মাসের বেশি স্থায়ী হয় না। একসময় আপনা থেকে তার তীব্রতা কমে আসে। জীবন ফিরে যায় নিজের ছন্দে।

    এবার অবশ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনাভাইরাস ডেকে আনছে মন্দা। তার ধাক্কা সামলাতে অনেক সময় লাগবে।

     

    তথ্যসূত্র

    ---------------

    কলিকাতা সেকালের ও একালের : হরিসাধন মুখোপাধ্যায়

    প্রাচীন কলিকাতা : নিশীথরঞ্জন রায়, অশোক উপাধ্যায় সম্পাদিত

    মহাস্থবির জাতক : প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    প্লেগ : রাধাগোবিন্দ কর

    কলিকাতা দর্পণ : রাধারমণ মিত্র

    শতাব্দীর প্রতিধ্বনি : অতুল সুর

    টাউন কলকাতার কড়চা : বিনয় ঘোষ

     

     


    তরুণ গোস্বামী - এর অন্যান্য লেখা


    কলকতায় যখন প্রথম প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে, স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন দার্জিলিং-এ। আমেরিকা থেকে ফিরে অতিরিক্ত পর

    বিশ্বের কোথাও মেলে না কালী কলকাত্তাওয়ালীর তুলনীয় দৃশ্য

    আমি প্লেগদেবী-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested