×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • আজকের করোনা আর শতবর্ষে হর গোবিন্দ খুরানা

    সুস্মিতা ঘোষ | 02-02-2022

    নিজস্ব ছবি

    শতবর্ষে পা দিলেন হর গোবিন্দ খুরানা (Har Gobind Khorana) আজ যখন RT-PCR টেস্ট (RT-PCR test) আর কোভিড ভ্যাকসিনের (Covid Vaccines) চর্চা দুনিয়া জুড়ে প্রতিটি ঘরে, তখন আমরা কতজন মনে রেখেছি যে এই দুইয়েরই পিছনে অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই নোবেলজয়ী (Nobel laureate) বিজ্ঞানীর?  মনে পড়ে এই মানুষটির আবিষ্কারের গুরুত্ব বোঝাতে কতজনের সঙ্গেই না তর্ক করতে হয়েছিল কখনও কখনও মনে হয়, ভাগ্যিস তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন নাহলে তাঁর জীবদ্দশাতেই অনেকে তাঁর কীর্তিকে অস্বীকার করার যেসব চিহ্ন রেখেছেন, নোবেল না পেলে তাঁর এই শতবার্ষিকীতে তাঁকে ক’জন স্মরণ করত সন্দেহ!

    হর গোবিন্দ খুরানা, সহকর্মীদের কাছে শুধুই "গোবিন্দ’, জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঠিক একশ বছর আগে 1922সালের জানুয়ারি মাসে, আর মাত্র এগারো বছর আগে 2011তে পরপারে যাত্রা করেন এই দীর্ঘ  89বছরের শেষ অবধি বিজ্ঞানের পাতায় তিনি স্বাক্ষর রেখে যেতে পেরেছেন, অজস্র আবিষ্কার, অজস্র কীর্তি নোবেল পুরষ্কার তাঁর যে কীর্তিকে সম্মান দিয়েছে অর্থাৎ জেনেটিক কোড আবিষ্কারে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে, অবশ্যই তা সবচেয়ে বেশি ঐতিহাসিক মূল্যের কিন্তু ক’জন জানে সেটা?

    এটা বুঝতে গেলে জিন তত্ত্বের কিছু মৌলিক জ্ঞান এবং কাহিনী ঝালিয়ে নেওয়া প্রয়োজন 

     

    জিন, এনজাইম, প্রোটিন  এবং ডিএনএ : আমরা কতটা জানি?

     

    শব্দগুলির সঙ্গে প্রায় সবাই কম বেশি পরিচিত কোনও সৎগুণ বা বদগুণ সম্বন্ধে আমরা হামেশাই বলি "ওটা তো জিনে আছে  জিন একটি ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির পার্থক্য বোঝায়, বা কারা কারা রক্ত সম্পর্কে জড়িত সেই বংশগতি বোঝায়, এটা সবাই জানে জিন শব্দটা তো কম পুরনো নয়- সেই প্রাচীন গ্রিক আমলের

     

    এনজাইম

     

    বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের জীববিজ্ঞানীরা একটা নতুন কথা বললেন- প্রকৃতি যে ভাষায় রচনা করে তার নাম এনজাইমের ভাষা এনজাইম শুনলেই কী মনে পড়ে? খাদ্য হজম করতে এনজাইম লাগে তাই না? বিংশ শতকের গোড়ার দিক থেকে বিজ্ঞানীরা বলতে শুরু করেন, শুধু খাদ্য হজম করতেই নয়, খাদ্য তৈরি করতেও এনজাইম লাগে সূর্যের উপস্থিতিতে বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর মাটি থেকে পাওয়া জল থেকে গাছ তৈরি করে কত রকম খাদ্য- মনে পড়ছে? সেই খাদ্য তৈরি কিন্তু হয় ছোট ছোট ধাপে প্রতিটা ধাপে এক বা একাধিক এনজাইম নামক যন্ত্র কাটা জোড়া করে শুধু কি খাদ্য তৈরি? চুলের রং বা চোখের রং, আলাদা আলাদা হয় যখন আলাদা আলাদা এনজাইম আলাদা আলাদা রং তৈরি করে মজা করে বলতে গেলে "জুতার মাপ, গায়ের রং, কান কটকট করে কিনা সমস্তই ভিন্ন ভিন্ন এনজাইমের কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতি

     

    এবার হয়তো বলবেন সেকি! জুতার মাপ গায়ের রং তো জিন থেকে আসে- এই যে আমার গায়ের রং আমার বাবার মতো?

     

    জিন জিনিসটা কিন্তু বহুদিনই একটা "তত্ত্ব মাত্র ছিল- ধরা ছোঁয়ার বাইরে কিন্তু ঊনবিংশ শতকের গোড়া থেকেই বিজ্ঞানীরা এক এক করে অনেক এনজাইম আবিষ্কার করছেন- তাদের ধরা ছোঁয়া যায়, টেস্ট টিউবের মধ্যে তাদের রাসায়নিক কাজকর্ম দেখতেও পাওয়া যায়

    বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দুই বিজ্ঞানী Beadle আর Tatum বললেন ওই জিন থেকেই এনজাইম আসে তাঁরা অনুমান  করলেন একটি জিন মানে একটি এনজাইম এনজাইমের রাসায়নিক প্রকৃতি ও জানা গিয়েছিল- এনজাইমরা রাসায়নিক ধর্ম অনুযায়ী সাধারণত প্রোটিন হয়

     

    আরও পড়ুন:রসায়নে এবারের নোবেলজয়ীরা কি সত্যিই জিন-কাটা কাঁচির জনক?

     

    প্রোটিন? যেটা খেলে শরীর তাগড়া হয়?

     

    প্রোটিন আসলে হল জীব শরীর তৈরি এবং বেঁচে থাকার সমস্ত পদ্ধতি চালানোর মালমশলা একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝাই: ধরুন একটা বাড়ি- সেটা সিমেন্ট, কাঠ, স্টিল বা অন্য ধাতু কাঁচ, প্লাস্টিক এই সব দিয়ে তৈরি বাড়িতে যে সব যন্ত্রপাতি থাকে, যেমন আলো, পাখা, ফ্রিজ, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার - এগুলোও সেই প্লাস্টিক, নানা রকম ধাতু, কাঁচ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি এগুলো হল মাল মশলা- যা দিয়ে বাড়ি, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সব বানানো যায় প্রোটিন এই অর্থে একাই একশো নয় একাই একশো কোটি এত বিভিন্ন ধরণের প্রোটিন আছে, যে তাদের গোনাই যায় না অনেক প্রোটিন ঠিক কী কাজ করে আমরা জানি আবার অনেক প্রোটিনই ঠিক কী ভাবে তাদের নির্দিষ্ট কাজগুলো করে, আমরা আজও জানি না বহু প্রোটিন আছে, যাদের অস্তিত্বই আমরা এখনও জানি না

     

    কিন্তু মোটামুটি ভাবে এদের কাজগুলো দুভাবে ভাগ করা যায়- একটা হচ্ছে গঠন, অর্থাৎ বাড়ি বানানোতে ইট-কাঠ-স্টিলের যা কাজ- কোষের গঠন, কোষের ভিতরের অঙ্গাণুর গঠন, অনেক কোষ মিলিত হয়ে তৈরি পেশীর গঠন, এবং প্রতিদিনের ক্ষয়ক্ষতির পূরণ দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে শরীরের যাবতীয় যন্ত্রের চালনা এই যে আমরা খাদ্য পরিপাক করি, নিঃশ্বাস নিই, হাঁটি, চলি, হাসি কাঁদি, ভালবাসি, প্রতিটি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে নানা ছোট বড় যন্ত্র- যাদের গঠন এবং কার্যপদ্ধতি পুরোপুরি ভাবে প্রোটিন নির্ভর 

     

    মোদ্দা ব্যাপার হল প্রোটিন একটা বিশেষ রাসায়নিক গোষ্ঠীর যৌগ, যারা জীবদেহে অসংখ্য রূপে বিরাজমান এবং বলা যায় জীবদেহ প্রোটিন দিয়েই বানানো

     

    জৈবরসায়নের চোখে প্রোটিন গোষ্ঠীর অসংখ্য সদস্যদের অপরিসীম বিভিন্নতার মধ্যে একটাই মিল, এরা সবাই  আসলে  অ্যামাইনো অ্যাসিড বলে এক প্ৰজাতির জৈব অণু দিয়ে গাঁথা অ্যামাইনো অ্যাসিড তাদেরই বলে যাদের মধ্যে COOH অর্থাৎ কার্বক্সিলিক অ্যাসিড এবং amino অর্থাৎ NH2- এই দুধরণের বিপরীত ধর্মী অবয়বই আছে

     

    দু'টি ভিন্ন অ্য়ামাইনো অ্য়াসিডের গঠন

     

    প্রোটিন হল পুঁতির মালার মতো সারি দিয়ে গাঁথা অ্যামাইনো অ্যাসিডের সমষ্টি, যাকে অ্যামাইনো অ্যাসিডের পলিমারও বলা চলে এই মালার মতো প্রোটিনের ফিতে ত্রিমাত্রায় নানা ভাবে ভাঁজ হয়ে কেউ ইঁটের কাজ করে, কেউ বা গিয়ার এর, কেউ বা পাম্প এর, কেউ বা মোটরের  শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া প্রোটিন এই ভাবেই চালায় যে প্রোটিনগুলি যন্ত্র হিসেবে কাজ করে, তাদের বেশির ভাগকেই এনজাইম দলভুক্ত করা যায়  

     

    অ্য়ামাইনো অ্য়াসিডের মালা গাঁথা

     

     তাহলে কি জিন কি রাসায়নিক ধর্ম অনুযায়ী প্রোটিন ই হল?

     

    প্রোটিন সম্বন্ধে একটা জিনিস জানা ছিল যে বেশির ভাগ প্রোটিন, বিশেষ করে যারা এনজাইম, গরম করলে তারা নষ্ট হয়ে যায় গরম করলে জীবাণু মরে যায়, তার একটা বড় কারণ হল জীবাণু দেহের প্রয়োজনীয় প্রোটিনগুলি গরমে নষ্ট হয়ে যায়

     বিজ্ঞানী গ্রিফিথ (Griffith) একটা পরীক্ষা করেছিলেন সেটা এই রকম: তিনি দু’ধরণের জীবাণু নিয়ে ইঁদুরে ইনজেক্ট করলেন এক ধরণের জীবাণু নিউমোনিয়া সৃষ্টি করে ইঁদুরকে মেরে ফেলে, অন্য ধরণের জীবাণু ক্ষতিকারক নয় তিনি ক্ষতিকর জীবাণুকে গরম করে ইনজেক্ট করে দেখলেন ইঁদুর মরে না এবার তিনি গরম করা ক্ষতিকর জীবাণুর সঙ্গে অন্য জীবাণুটি মিশিয়ে ইনজেক্ট করে দেখলেন আবার ইঁদুর মরছে এবং সাধারণ জীবাণুটি ক্ষতিকর জীবাণুতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে জিন যেহেতু সত্ত্বা বোঝায়, এই জীবাণুটির সত্ত্বার পরিবর্তন ঘটেছে, অর্থাৎ জিনে পরিবর্তন বা transformation ঘটে গেছে কিন্তু এই ট্রান্সফর্মেশন যে ঘটাল সে কিছুতেই প্রোটিন হতে পারে না, কারণ প্রোটিন তো গরমে নষ্ট হয়ে যায়

     

    গ্রিফিথের পরীক্ষা

     

    1944 সালে আভেরি ( Avery)  গ্রিফিথ-এর পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করার সময়ে জীবাণুকে ফাটিয়ে তার মধ্যে কী কী আছে বিশ্লেষণ করে দেখলেন যত প্রোটিন আছে, তাদের বাদ দেওয়া গেল নানা রাসায়নিক পদ্ধতিতে বাকি রইল সুতোর মতো একটা পদার্থ, রাসায়নিক ধর্মে যা  DNA অর্থাৎ deoxynucleic acid-এর সঙ্গে মিলে গেল 

    আভেরি  একরকম এনজাইম ব্যবহার করলেন, যা DNA-র সংস্পর্শে এলেই তাকে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলে নাম তার DNase (প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল ইংরেজি -ase লেজুড় ব্যবহার করা হয় enzyme-এর নাম বোঝাতে, প্রথম অংশটির নাম আসে এনজাইমটি কীসের ওপর কাজ করে, অর্থাৎ ভাঙে বা গড়ে এখানে এই এনজাইমটি DNA ভাঙে, তাই DNase) 

    নিউমোনিয়ার জীবাণু মেশানোর পরীক্ষা আর একবার করে দেখা হল - ক্ষতিকর জীবাণুকে গরম করে ফাটিয়ে সাধারণ জীবাণুর সঙ্গে মেশালে সে ক্ষতিকারকে রূপান্তরিত হল, কিন্তু একই পরীক্ষাতে DNase মিশিয়ে দিলে আর এই রূপান্তর হল না অর্থাৎ, ক্ষতিকর জীবাণু থেকে বেরিয়ে আসা DNAও যদি Dnase-এর প্রভাবে নষ্ট হয়ে যায়, তবে রূপান্তর ঘটবে না সাধারণ জীবাণু ক্ষতিকারক রূপ ধারণ করতে পারবে না অর্থাৎ অখণ্ড DNA ই রূপান্তর ঘটাচ্ছে, জিনে পরিবর্তন আনছে

     

     

    আভেরির পরীক্ষা

     

    DNA?  বুঝেছি  হ্যাঁ হ্যাঁ DNA তো জিন ! ডবল হেলিক্সের মতো দেখতে 

     

    অপরাধ বিজ্ঞানের সূত্রে DNA শব্দটা বেশ পরিচিত সবার কাছেই মৃতব্যক্তির পরিচয়, অপরাধীর পরিচয়, স্বীকার না করা পিতৃত্ব সব জানা যায় সম্ভাব্য রক্তসম্পর্কিত নিকট আত্মীয়দের DNA বিশ্লেষণ করে দেখলে এটা বেশির ভাগই জানেন কিন্তু জিনই যে DNA এটা এত সহজে প্রমাণিত হয়নি 

     

    আরও পড়ুন:এ ব্যথা কী যে ব্যথা

     

    DNA- চরিত্র

    কোষের মধ্যে লম্বা সুতোর মতো DNA থাকে, এটা ঊনবিংশ শতকের শেষেই আবিষ্কৃত হয় গত শতকের বিশের দশকে ফিবাস লিভিন (Phoebus Levene ) DNA-র রাসায়নিক চরিত্র সম্বন্ধে কিছু ধারণা দিতে সক্ষম হন তিনি বলেন যে DNA-তে চার রকম জৈব ক্ষার (base ) থাকে, adenine (A ), guanine (G ), cytosine ( C) এবং thymidine (T), যারা deoxyribose নামে এক রকম শর্করার এবং ফসফেটের সঙ্গে যুক্ত থাকে - ফসফেট থাকার কারণে এটি অ্যাসিড জাতীয়  1950 সালে শার্গফ (Chargaff) বললেন যে একটি DNA অণুতে যতগুলো , ঠিক ততগুলোই T, আর যতগুলো , ঠিক ততগুলোই C. এটি ধ্রুবসত্য বলে প্রমাণিত হওয়ার পর A = T , G =C -কে শার্গফের সূত্র বলা হয়  এই সূত্রের ছায়াতে DNA-র মধ্যে একটা জোড়-বাঁধার ইঙ্গিত পাওয়া যায় এবং DNA ক্রিস্টাল এর মধ্যে দিয়ে XRAY পাঠিয়ে ওয়াটসন এবং ক্রিক 1953 সালে দেখালেন যে DNA চেহারা এক-জোড়া ঘোরানো সিঁড়ির মত - যাকে ঐতিহাসিক double helix নামে ভূষিত করা হয় জোড়া সিঁড়ির জোড় বাঁধার একটা নিয়ম আছে- একদিকে যদি A থাকে, অন্য পারে থাকবে T, একদিকে যদি G  থাকে, অন্যপারে থাকবে জোড় বাঁধার এই নিয়মকে ওয়াটসন-ক্রিক জোড় (Watson-Crick pairing ) নাম দেওয়া হয়  জোড় বাঁধা সূত্র দুটি একে অন্যের বিপরীত মুখে (anti parallel ) বসে

     আবারও ইঙ্গিত পাওয়া গেল DNA জিন এবং এই জোড়-বাঁধা দেখে মনে করা হল কোষ বিভাজন তথা বংশ বিস্তারের সময়ে জোড় খুলে একটি একটি সুতো বিভক্ত কোষ বা পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় 

     

    DNA-এর চেহারা

     

    মোটামুটি এই সময়েই হার্শে (Hershey) এবং  চেজ (Chase) ব্যাকটেরিয়ার ওপর পরজীবী হয় এমন ভাইরাস, যাকে ফেজ (কেউ কেউ ফাজ ও বলে, Phage ) নিয়ে একটি পরীক্ষা করলেন এইভাবে:

     

    এইবার সত্যি সত্যিই প্রমাণ হল যে DNA- জিন

    পরে অবশ্য জানা গেছে যে অনেক ভাইরাসের ক্ষেত্রে ( যেমন করোনা ভাইরাস, HIV-র জিন DNA নয়, RNA - কিন্তু এই রকম ক্ষেত্রে DNA  RNA-কে প্রায় সমার্থক ধরা যায় )

     

    এর মধ্যে খুরানার অবদান কোথায় আর কতটা?

     

    এত কথা বলতে হল কারণ আণবিক জীববিজ্ঞানের যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে আগে শুনে থাকলেও DNA, প্রোটিন এনজাইম সব গন্ডগোল হয়ে যায় বেশিভাগেরই  জেনেটিক কোডের কাহিনী আরও জটিল- বুঝতে গেলে DNA প্রোটিন ইত্যাদির কথা ঝালিয়ে নেওয়া অবশ্য কর্তব্য  

     

    জেনেটিক কোড: অ্যামাইনো অ্যাসিডের বর্ণমালার সঙ্গে DNA- বর্ণমালার সম্পর্ক

     

    Covid ভ্যারিয়ান্টের দৌলতে sequencing শব্দটার সঙ্গে সবার পরিচয় আছে, যদিও আসলে ব্যাপারটা কী বেশির ভাগেরই কোনও ধারণা নেই 

     

    আগেই বলেছি প্রোটিন হল অ্যামাইনো অ্যাসিড বলে এক জাতির জৈব অণু দিয়ে গাঁথা যদিও অসংখ্য ধরণের অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকতে পারে, কিন্তু প্রাকৃতিক প্রোটিনে মাত্র কুড়ি রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিডই দেখতে পাওয়া যায় (কয়েক বছর হল 21তম বিরল অ্যামাইনো অ্যাসিডের খোঁজ অবশ্য পাওয়া গেছে) প্রোটিন যে অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে গাঁথা একথা 1902 সালে আলাদা আলাদা ভাবে বলেন এমিল ফিশার (Emil Fischer) এবং ফ্রান্জ হফমাইস্টার (Franz Hofmeister ) 

     

     1950 সালে ফ্রিডরিক সেঙ্গার (Frederick Sanger) এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যার দ্বারা ইনসুলিনে কোন কোন অ্যামাইনো অ্যাসিড ঠিক কোন কোন অবস্থানে (সিকোয়েন্স) গাঁথা আছে তা দেখাতে সক্ষম হন এই পদ্ধতিটির নাম দেন প্রোটিন সিকোয়েন্সিং এই আবিষ্কার সেঙ্গারকে 1958 সালে তাঁর প্রথম নোবেল পুরষ্কারটি এনে দেয় 

    সেঙ্গার একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন - প্রোটিনে যেমন নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলি গাঁথা থাকে, সেটা ইঙ্গিত করছে যে, ওই প্রোটিনটির সংকেতবাহী জিনটি ঠিক ওইভাবে একটি নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে সাজানো থাকবে 

     

    20টি অ্যামাইনো অ্যাসিডের বর্ণমালায় লেখা প্রোটিনের ভাষা সেই ভাষায় কী লেখা থাকবে সেটা ঠিক করবে সেই প্রোটিনটির জিন অর্থাৎ DNA - যার বর্ণমালাতে মাত্র চারটি অক্ষর (বেস ) A, T, G এবং C.

     

    দুরূহ ধাঁধা জেনেটিক কোড!

     

    ডবল হিলিক্স আবিষ্কারের জন্য ওয়াটসন এবং ক্রিককে 1961 সালে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করা হয় 1962 সালে পুরষ্কার নেওয়ার সময়ে দেওয়া বক্তৃতাতে ক্রিক প্রথম জেনেটিক কোড শব্দটির অবতারণা করেছিলেন

     

    মাত্র চারটি অক্ষরের দ্বারা অসংখ্য ধরণের প্রোটিনের ভাষার কোড লেখা কীভাবে যেতে পারে তাই নিয়ে অনেক অঙ্ক কষা এবং ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা চলছিল সব দেখে নোবেল লেকচারে ক্রিক বলেছিলেন যে মাত্র চারটি বেস দিয়ে যদি 20 টি অ্যামাইনো অ্যাসিডের কোড লেখে প্রকৃতি, তাহলে এক একটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের জন্যে একাধিক বেসকে নানা কম্বিনেশনে আসতেই হবে যদি দুটি বেস এক সঙ্গে কোড বানায় তাহলে AC, GA, TG  এইভাবে ১৬ রকম কম্বিনেশন হয়, 20 হয় না তাহলে সবচেয়ে সম্ভাব্য হল ত্রয়ী বা ট্রিপলেট কম্বিনেশন  AGA, ATC , CTG এই রকম করে 64 রকম কম্বিনেশন হতে পারে, যেটা 20টি অ্যামাইনো অ্যাসিডের পক্ষে যথেষ্ট

     

    কিন্তু এই অনুমান থেকে প্রমাণ হয় না যে কোনও কোডে মাত্র এক অক্ষর বা কোথাও দু অক্ষরের কোড প্রকৃতি ব্যবহার করে না 

     

    DNA  প্রোটিনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় RNA

    ক্রিক আরও একটি মতবাদ প্রচার করেন যা Central Dogma নামে খ্যাত  তিনি বললেন যে DNA তো কোষের কেন্দ্রে বসে থাকে, সেখানে থেকে কোড ব্যবহার করে প্রোটিন উৎপাদন করার জন্যে নিশ্চয়ই কোনও মধ্যস্থতাকারী আছে, যেটা কোষের সর্বত্র বিরাজমান - এবং খুব সম্ভবত সেটি RNA.  RNA অনেকটাই DNA-র মতো, চারটি বেস দিয়ে তৈরি, A, G , C এবং T বদলে খালি Uracil (U) এবং RNA-র সঙ্গে DNA আর একটা বড় তফাৎ হল এখানে জোড় বাঁধা সুতো নেই, RNA একক অর্থাৎ “single stranded.” ক্রিক আরও বললেন যে এই RNAগুলি আসলে DNAকে  বা জিনগুলিকে কপি করেই তৈরি হয় কোষের মধ্যে এবং এই কপি করার পদ্ধতির নাম ট্রান্সক্রিপশন একটি জিনের এই রকম কপি বা transcript যে RNA, তা একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরির সংকেত বহন করে বলে তাকে নাম দিলেন messenger RNA (mRNA). mRNA-র চারটি বেসে লেখা সংকেত যে ভাবে 20 অ্যামিনো অ্যাসিডের বর্ণমালায় লেখা প্রোটিনে অনূদিত হয়, সেই জৈবরাসায়নিক পদ্ধতিটির নাম দিলেন “translation.

     

    ছবি সৌজন্যে অন্তর্জাল

     

     

    প্রোটিন সংশ্লেষণের কারখানা রাইবোজোম এবং tRNA

     

    50-এর দশকের শুরুতে কোষের মধ্যে এক দানা দানা অঙ্গাণু আবিষ্কৃত হয়, যা এমনিও ভেসে বেড়ায় বা কোষের মধ্যে জালি জালি অঙ্গাণুর গায়েও আটকে থাকতে দেখা যায় এর নামকরণ হয় রাইবোজোম (ribosome).  পল জামেকনিক (Paul Zamecnik ), কী করলেন, না ইঁদুরের লিভার চটকে ধুয়ে যে জলটা অর্থাৎ নির্যাসটা পেলেন, অনুমান করলেন এর মধ্যে অনেক রকম এনজাইম আছে- কোষের বাইরে নিশ্চয়ই প্রোটিন সংশ্লেষণ করতে পারবে তাঁর অনুমান একদম সঠিক

     

    তিনি টেস্টটিউবে ওই নির্যাসটির মধ্যে বাইরে থেকে তেজষ্ক্রিয় গুণ বিশিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিড ঢেলে দিয়ে দেখলেন ওই যে দানা দানা ribosome, তার মধ্যে তেজষ্ক্রিয়তা ঢুকে ভারী হয়ে টিউবের নিচে পড়ে আছে  অর্থাৎ  ribosome তেজষ্ক্রিয় অ্যামিনো অ্যাসিড গেঁথে প্রোটিন সংশ্লেষণ করেছে আবার ওই টিউবের মধ্যেই দেখলেন এক ধরণের ছোট ছোট RNA ঘুরে বেড়াচ্ছে, যার মধ্যে তেজস্ক্রিয়তা ঢুকেছে , অর্থাৎ এরকম ছোট RNA আছে যাতে অ্যামিনো অ্যাসিডও লেগে থাকে  ক্রিক একটা কথা বলেছিলেন - কোনও adaptor নিশ্চয় আছে, যা অ্যামিনো অ্যাসিডগুলিকে ধরে ধরে mRNAর ওপর নিয়ে এসে প্রোটিন সংশ্লেষণ করে

     

    তিনি বুঝলেন এই তাহলে ক্রিক এর অ্যাডাপটার - তিনি তার নতুন নাম দিলেন tRNA (transfer RNA )- যে নাকি রাইবোজোমের মধ্যে অ্যামিনো অ্যাসিড ট্রান্সফার করে এক এক করে গাঁথতে সাহায্য করে 

     

    Zamecnik-এর পরীক্ষা

     

     

    tRNA, codon   anti-codon

     

    একটু আগে Trna-র কথা বলেছি- অ্যামিনো অ্যাসিডের বাহকের কাজ করে 60 এর দশকের গোড়াতে tRNA -র স্বরূপ জানা যায় রবার্ট হলি (Robert Holley) প্রথম Trna-র আসল চেহারা আবিষ্কার করেন এবং সেই কাজের জন্যে 1968 সালেই খুরানা ও নিরেনবার্গের সঙ্গে নোবেল পুরষ্কার ভাগ করে নেন 

     

    ছবি সৌজন্যে অন্তর্জাল

     

     

    হলি প্রথম যে TRNA-কে নিয়ে কাজ করেন সেটি এলানিন (alanine , ala ) অ্যামিনো অ্যাসিডটি যুক্ত ছিল পরে অন্য অন্য বিজ্ঞানী বাকি 19 টি অ্যামিনো অ্যাসিড যুক্ত tRNA -গুলি আবিষ্কার করেন দেখা গেল যে সমস্ত tRNA  সিকোয়েন্স প্রায় এক, তফাৎ শুধু মাঝখানের একটু জায়গার পর পর তিনটি বেসে এসব দেখে শুনে ক্রিক বললেন যে মাত্র তিনটি পরপর বেস যখন, তার মানে এরাও এক ধরণের ত্রয়ী  যেহেতু তাদের সিকোয়েন্স প্রতিটা অ্যামাইনো অ্যাসিডের ক্ষেত্রে আলাদা, তার মানে এরাও এক ধরণের কোডন  যেহেতু Trna-রা  ক্রিকের নিজের অনুমান অনুযায়ী এডাপ্টার, তারা নিশ্চয়ই Mrna-র  একটি একটি কোডনের সঙ্গে ওয়াটসন - ক্রিক জোড় বাঁধার নিয়মে জোড় বাঁধবে   অর্থাৎ mRNA -র কোডনে যদি থাকে GAG, সেখানে যে tRNA -টি জোড় বাঁধবে, তার মাঝখানে CUC ত্রয়ীটি থাকবে, উল্টো করে বসে যেহেতু  জোড় বাঁধতে গেলে উল্টো (anti ) বসে, তাই tRNAর মধ্যের ত্রয়ীটিকে anti-codon বলা উচিত  

     

    ধাপে ধাপে জেনেটিক কোডের ধাঁধার সমাধান

     

    1961 সালে মার্শাল নিরেনবার্গ (Marshall Nirenberg ) একটি যুগান্তকারী পরীক্ষা করলেন  তিনি একটি RNA বানালেন, যাতে একটিই বেস Uবারেবারে আছে অর্থাৎUUUUUUUUU.এরকম একটি দীর্ঘ পলিমার এতে তিনি কোষের নির্যাস দিয়ে প্রোটিন সংশ্লেষণ করার চেষ্টা করলেন এবং যে একটি প্রোটিন পেলেন তাতে একটিই অ্যামিনো অ্যাসিড আছে ফিনাইল এলানিন (phe ) পলিমার হিসেবে- phephephephephe এই রকম ভাবে  এতে প্রমাণ হল central dogma-র দ্বিতীয় অংশ RNA ট্রান্সলেশন হলে প্রোটিন পাওয়া যায়

    যখন শুধু A অর্থাৎ  AAAAAAA . নিলেন, তখন পেলেন অন্য একটি অ্যামিনো অ্যাসিড লাইসিন (lys) -এর পলিমার lyslyslyslyslyslyslys ……. এবং C-র পলিমার CCCCCCCCC…… থেকে পেলেন প্রোলিন (pro) -র পলিমার propropropropro……… কিন্তু G -এর পলিমার থেকে কিছু পেলেন না  U, phe -কে  A lys –কে  C- কে pro -কে কোড করে বোঝা গেল, কিন্তু ঠিক কিরূপে, কটা অক্ষর, একটা, না দুটো, না তিনটে না তার বেশি বোঝা গেল না 

     

     

    নিরেনবার্গের পরীক্ষা

     

    এবার তাঁরা, দুটো, তিনটে, চারটে  বেসকে একসঙ্গে পলিমার তৈরি হতে দিলেন- অবশ্যই এলোমেলো ভাবে- কারণ নিৰ্দিষ্ট প্যাটার্নে সাজানোর পদ্ধতি তখনও আবিষ্কার হয়নি  কম্বিনেশনগুলি থেকে যাকে বলে শর্টলিস্ট তাই করা গেল - অর্থাৎ এই এই বেস কম্বিনেশন থাকলে তার থেকে এই এই অ্যামিনো অ্যাসিড পাওয়া যায়, এবং বেস কম্বিনেশনগুলো ত্রয়ী হলেই সেটা মিলতে পারে ধাঁধার জট একটু আলগা হল 

     

    কাজি (Kaji ) দেখালেন যে শুধুমাত্র AAA এই ত্রয়ী যদি ব্যবহার করা যায়, তাহলে তার সঙ্গে lys-লেগে আছে এমন tRNA জোড় বাঁধতে পারে এটাই প্রথম সরাসরি প্রমাণ হল যে বেসগুলি ত্রয়ী হিসেবেই কোড তৈরি করে ধাঁধার প্রথম টুকরো 

     

    নিরেনবার্গ এই সময়ে সেভেরো ওচোয়ার (Severo Ochoa ) কাছ থেকে তাঁর 1959 সালের নোবেলজয়ী এনজাইম polynucleotide phosphorylase -এর ব্যবহার শিখে দুটি করে বেস, যেমন GA , AC এই সবের পরে তৃতীয় বেস লাগিয়ে GAC, ACC, ACU   এই ধরণের ত্রয়ী বানানোর চেষ্টা করলেন এবং দেখলেন এই সব ত্রয়ীর সঙ্গে জোড় বাঁধে কোন কোন tRNA - তাদের ল্যাজে আটকে থাকা অ্যামিনো অ্যাসিডরাই বা কারা এই ভাবে তাঁরা প্রায় গোটা পঞ্চাশেক ত্রয়ী কোডন কী কী অ্যামিনো অ্যাসিডের কোড নির্ধারিত করে, তা তালিকা ভুক্ত করেন

       

    একাধিক কোডন একই  অ্যামিনো অ্যাসিডের সংকেত বহন করে এরকম অনেকগুলি উদাহরণ পাওয়া গেল UAA, UAG, UGA এই তিনটি কোডনে বসে এমন কোনও tRNA নেই - তাই এদের নাম দেওয়া হল ননসেন্স কোডন এগুলিও ধাঁধার গুরুত্বপূর্ণ টুকরো   

     

    কিন্তু কোডন ট্রিপলেট হলে 64 রকম হতে হবে এতদিন পর্যন্ত 50টির অস্তিত্ব পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত বাকি? ধাঁধার বাকি টুকরোগুলো?

     

    হর গোবিন্দ খুরানা ও 64 কোডন

     

    খুরানা তখন এক দশক ধরে বেস এবং শর্করা, যাদের একসঙ্গে নিউক্লেওটাইড (nucleotide ) বলা হয়, তার সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ ইত্যাদি করে যাচ্ছিলেন পুরোপুরি রসায়নবিদের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে- অর্থাৎ টেস্টটিউবের মধ্যে, সেখানে কোনও কোষ বা জীবন্ত কোনও কিছুর ছিটেফোঁটাও নেই 1959 সালের অন্য নোবেলজয়ী আর্থার কর্নবার্গ (Arthur Kornberg ) দেখে ছুটে এলেন তাঁর কাছে এবং জৈব রসায়নে তাঁকে দীক্ষা দিয়ে বোঝালেন যে জিন-রহস্যে খুরানার এই অভিজ্ঞতা কতটা মূল্যবান হতে পারে  কর্নবার্গ খুরানাকে শেখালেন কোষ ফাটিয়ে কী করে নানা ধরণের এনজাইম বানাতে হয়, বিশেষ করে DNA পলিমারেজ (DNA polymerase ) যা নাকি কোষের মধ্যে এবং টেস্টটিউবের মধ্যেও DNA-র ছাঁচ পেলে তার কপি করতে পারে 

     

    এবার খুরানার কাছে জেনেটিক কোডের ধাঁধাটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল তিনি বুঝলেন যে বেসগুলিকে একটি সুনির্দিষ্ট ক্রমেই সাজাতে হবে, ঠিক যেরকম সুনির্দিষ্ট ক্রমে অ্যামিনো অ্যাসিডগুলি সাজিয়ে সাজিয়ে প্রোটিন তৈরি হয়

     

    তিনি দেখলেন যে  দুটো করে বেসের পলিমার, যেমন UCUCUCUCUC… এতে দুটি অ্যামিনো অ্যাসিড লুসিন (leu) এবং সেরিন (ser) -এর পলিমার দেয় কিন্তু তাদের কোডন কী কী বোঝা যায় না  ঠিক ছটি বেসের পলিমারের নানা কম্বিনেশন UCUCUC, UCUUCU এবং CUCCUC বানানোর পরে পরিষ্কার হল যে UCU হল ser এবং  CUC হল  leu. কোডন (codon )  ধাঁধার দুটি গুরুত্বপূর্ণ  টুকরো এবার আর পায় কে খুরানাকে একদম নিয়মানুগ প্রণালী মেনে 64 কোডনই ওই ভাবে বানিয়ে ফেললেন 

     

    64 কোডন

     

    শুধু তাই নয়, মাত্র ছয় বেসকে ছাড়িয়ে রসায়ন এবং এনজাইমকে মিশিয়ে আবিষ্কারও করলেন কী করে লম্বা লম্বা DNA এবং RNA সংশ্লেষ করা যায়- ঠিক যেমন প্রকৃতিতে থাকে  এবার এই সব লম্বা DNA -কে যখন কোষ ফাটিয়ে বানানো নির্যাস, যাতে রাইবোজোম, tRNA ইত্যাদি, অর্থাৎ টেস্টটিউবে প্রোটিন সংশ্লেষণ করার যন্ত্রপাতির সঙ্গে মেশানো হল, কৃত্রিম DNA থেকে কৃত্রিম প্রোটিন তৈরি হল কৃত্রিম এই  DNA-র কোথায় কী কোডন এবং অনুরূপ অবস্থানে কৃত্রিম প্রোটিনটির ঠিক কোন অ্যামিনো অ্যাসিড বসেছে তা নির্ধারণ করে বানানো হল একটি তালিকা, যা codon table নামে পরিচিত  নিরেনবার্গের তালিকা অসমাপ্ত ছিল - খুরানা তাকে শুধু পূরণ করলেন তাই নয়, একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে প্রমাণ ও করলেন  নিরেনবার্গ কোডন ধাঁধার যে যে সমাধান বলেছিলেন তারা ঠিকই আছে

     

    ননসেন্স কোডন তিনটিতে দেখলেন সেখানে পোঁছে অ্যামিনো অ্যাসিডের মালা গাঁথা বন্ধ হয়ে গেল তাই এদের অন্য নাম দেওয়া হল stop codon বা সমাপ্তি সূচক কোডন

    আর একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস দেখলেন এতদিন পর্যন্ত টেস্টটিউবে যখন প্রোটিন সংশ্লেষণ করা হতো, তখন ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি লবণ খুব বেশি মাত্রায় ব্যবহার করা হতো - প্রকৃতিতে অতটা থাকে না  একে প্রাকৃতিক মাত্রায় নামিয়ে আনতেই দেখলেন যে, যেসব কৃত্রিম DNA-তে  AUG কোডন নেই , সেখানে প্রোটিন সংশ্লেষণ খুব কম হচ্ছে, আর যাদের আছে, তাদের ঠিক যেখানে সর্বপ্রথম  AUG বা GUG কোডনটি  আছে ঠিক সেখান থেকে প্রোটিন সংশ্লেষণ শুরু হয় মিথাওনিন (met ) অ্যামিনো অ্যাসিডটি বসিয়ে   এই  সর্বপ্রথম  AUG -টিতে আবার সাধারণ  tRNA জোড় বাঁধে না  এই  বিশেষ tRNA -টির একপ্রান্তে অ্যামিনো অ্যাসিড met   অন্য প্রান্তে একটি  formyl গ্রুপ ঝোলে, এবং একে fmet- tRNA বলে অভিহিত করা হয় এই বিশেষ fmet- tRNA -টি বসার পরেই একটি  মিথাওনিন বসিয়ে শুরু হয়ে যায় অ্যামিনো অ্যাসিডের মালা গাঁথা, অর্থাৎ প্রোটিন সংশ্লেষণ  সেই কারণে এই  সর্বপ্রথম  AUG বা GUG কোডনটিকে প্রারম্ভিক কোডন (initiation codon ) নাম দেওয়া হল  কোডন ধাঁধার সব টুকরো মিলে গেল 

     

    সমাধান দাঁড়ালো এই : 1) কোডন তিন বেসের সমন্বয় বা ট্রিপলেট 2) 64 টি কোডন আছে 3) একাধিক কোডন একই অ্যামিনো অ্যাসিড সূচনা করতে পারে কিন্তু একই কোডন কখনও একাধিক অ্যামিনো অ্যাসিড সূচনা করে না যেমন UUA এবং UUG দুটিই  leu সূচনা করে প্রকৃতি সম্ভবত এই ব্যবস্থা রেখেছে যাতে কোডনে অর্থাৎ DNA-তে অর্থাৎ জিনে সামান্য পরিবর্তন অর্থাৎ মিউটেশন হলেও সেই পরিবর্তন জিনের আসল মানে অর্থাৎ প্রোটিনে পরিবর্তন কম আসে এককথায় মিউটেশনের ক্ষতিকারক প্রভাব কমানোর জন্যে প্রকৃতি অনেক অ্যামিনো অ্যাসিডএর জন্যেই একাধিক কোডনের ব্যাকআপ রেখেছে  4) ট্রিপলেট কোডনে সমাপতন বা overlap হয় না অর্থাৎ CUUACU যদি জিনে লেখা থাকে, তাহলে CUUর জন্যে  leu বসবে এবং  ACU-র জন্যে থ্রিওনিন (thr), মধ্যের UUA বা UAC -কে কোডন ধরা হবে না 5) তিনটি সমাপ্তি সূচক কোডন আছে 6) শুরু করার জন্যে একটি বিশেষ কোডন আছে, কিন্তু তার বিশেষতা জিনের মধ্যে তার অবস্থান দিয়েই নির্ধারিত হয়  

    এছাড়া জিনের ভাষা থেকে সংকেত প্রোটিনের ভাষাতে পৌঁছতে গেলে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম মানে প্রকৃতি সেটি হল দিক নির্দেশনা আমরা যেমন ইংরেজি বা বাংলা বাঁদিক থেকে ডানদিকে লিখি সেই রকম জিনের ( DNA  বা RNA) ভাষাতে পড়া শুরু হয় সেই প্রান্ত থেকে, যেটাকে 5’ ফসফেট বলে প্রোটিনের ভাষায় অনুবাদের সময়ে একটি মিথাওনিন বসে, যার COOH গ্রুপটিতে যুক্ত হয় জেনেটিক কোড অনুযায়ী নির্ধারিত পরবর্তী অ্যামিনো অ্যাসিডের NH2 group -টির এই ভাবে মালা গাঁথা চলতে থাকে, কোনও ফাঁক, কমা-সেমিকোলন থাকে না, সমাপ্তি সূচক কোডন এলে বাক্য শেষ অর্থাৎ ওই প্রোটিনটি তৈরি শেষ 

     

    জেনেটিক কোড ভাঙার সময়ে খুরানা- আবিষ্কৃত পদ্ধতিগুলি ও তার সুদূর প্রসারী প্রভাব

    নির্ধারিত ক্রম অনুযায়ী রাসায়নিক পদ্ধতিতে বেস গেঁথে গেঁথে কৃত্রিম ডিএনএ বা RNA বানানো আজকের দিনেও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ  RTPCR টেস্ট, জিন সিকোয়েন্সিং সবেতেই লাগে খুরানা এই পদ্ধতির পথিকৃৎ শুধু তাই নয় ছোট ছোট কৃত্রিম DNA জুড়ে যে কৃত্রিম ভাবে একটা গোটা জিন যে বানিয়ে ফেলা যায়, এটা তিনিই প্রথম দেখান অর্থাৎ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এরও তিনিই পথিকৃৎ

     

    নতুন জিন বানানোই হোক বা কোনও জানা জিনকে বিশ্লেষণ করে দেখতে গেলে একই জিন বা ডিএনএর অনেক অনেক কপি লাগে রাসায়নিক পদ্ধতিতে অত কপি বানানো প্রায় দুঃসাধ্য  খুরানাই প্রথম দেখান যে  অল্প পরিমাণ রাসায়নিক পদ্ধতিতে বানানো কৃত্রিম DNA-তে  DNA polymerase দিলেই  প্রচুর কপি বানানো যায় অত্যন্ত সহজে  প্রায় এক দশক পরে Mullis যখন PCR অর্থাৎ polymerase chain reaction কৌশলে একটি বিশেষ ধরণের DNA polymerase ব্যবহার করে অনেক অনেক কপি বানানোর পদ্ধতি পেটেন্ট করলেন, তখন মৌলিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল খুরানা কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ উদারতার সঙ্গে এই পেটেন্টকে কোনও চ্যালেঞ্জ করেননি 

    এই করোনাকালে নতুন ভাইরাসের প্রকৃতি জানা সম্ভব হতো না, ডায়াগনস্টিক টেস্ট অর্থাৎ RTPCR  rapid antigen test বানানো সম্ভব হত না, সম্ভব হত না জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে ভ্যাকসিন বানানো, যদি না জেনেটিক কোড জানা থাকত যদি না খুরানা পথ প্রদর্শন করে যেতেন 

     

    তাহলে বিতর্ক কসের?

     

    বিতর্ক এটাই, যে নোবেল পাওয়ার পরে খুরানার কৃতিত্ব ছোট করে দেখানো বা ভুলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা কেন! গুগল করে জেনেটিক কোডের আবিষ্কারকের নাম খুঁজলে খুরানার নাম আসে না অনেকে নাক সিঁটকে বলেন খুরানা কাজ এমন কিছু না! ভাবতে দুঃখ হয়, নিরেনবার্গের মতো বিজ্ঞানী, যাঁকে খুরানার সঙ্গে নোবেল পুরষ্কার ভাগ করে নিতে হয়েছিল জেনেটিক কোড আবিষ্কারের জন্যে- তিনিও ওই 1968, পুরস্কারের বছরে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো বাদ দিলে কোথাও খুরানার নামই করেননি নাম করেননি  Yanofsky, Kaji এবং আরও যাঁরা যাঁরা জেনেটিক কোড ভাঙার চ্যালেঞ্জে নেমেছিলেন Yanofsky আবার নিরেনবার্গ বা ক্রিকের গবেষণা পত্রগুলোকে "ক্লাসিক আখ্যা দিয়েছেন

    এখানে একটা তথ্য বলা ভাল এই "ক্লাসিক ছাপ মারা প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হয়েছিল "Nature’ এবং "Science’ নামক পত্রিকা দুটিতে- কোনও অলিখিত কারণে এই দুটি পত্রিকাকে সর্বশ্রেষ্ঠ "মনে করা হয় খুরানা কিন্তু এই পত্রিকাগুলিতে কখনও নিজের গবেষণা প্রকাশ করেননি তাঁর গবেষণা প্রকাশের ধরণ ছিল অন্য রকমের- তিনি তাঁর গবেষণার প্রতিটা ধাপ আলাদা আলাদা করে ছোট ছোট পদক্ষেপে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করে গেছেন এমন সব পত্রিকায়, (যাদের সংক্ষিপ্ত নাম হল JBC, JMB, JACS, PNAS) যেগুলি নির্ভর যোগ্য খুঁটিনাটি সম্বলিত পদ্ধতির জন্য বিখ্যাত বরং Science তাঁকে আমন্ত্রণ করেছে আত্মচরিত লেখার জন্য

     

    এর থেকে খুরানার "কর্মণ্যেবাধিকারস্তে জীবন দর্শনের আন্দাজ পাওয়া যায় কিছুটা তিনি নিজে নিজের প্রবন্ধে "সবারে আমি নমি ভাব বজায় রেখেছেন, নিরেনবার্গকে নিজের চেয়ে অনেক বেশি কৃতিত্ব দিয়েছেন এটা কিন্তু শুধু বিনয় নয়, যে কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সঠিক মূল্যায়ন করতে গেলে পূর্বসূরীদের কাজ সব সময়েই বর্ণনা করা উচিত, যে কারণে আমিও এখানে প্রয়োজনীয় ইতিহাস ব্যাখ্যা করলাম

     

    নিজের সম্বন্ধে বারবার বলেছেন "আমি ভাগ্যবান ভাগ্যবান অবশ্যই, কারণ বিশুদ্ধ রসায়নের কাজ করতে করতে যে মুহূর্তে জেনেটিক কোড ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করলেন, বুঝতে পারলেন রহস্যের বাকি অংশটা সমাধান করার দক্ষতা একমাত্র তাঁরই আছে এই কথাটা অবশ্য নিরেনবার্গও স্বীকার করেছেন তাঁর নোবেল-বক্তৃতায়, কিন্তু ভাষাটা কেমন যেন! ভাগ্যবান এই কারণে, জেনেটিক কোডের রহস্য উন্মোচনের কাজে নেমে পড়ার পর তাঁকে একটুও হোঁচট খেতে হয়নি, অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে এক এক করে ধাঁধার টুকরো নিক্ষেপ করেছেন, একদম সঠিক জায়গায়

    যাঁরা বিভিন্ন সময়ে তাঁর জীবনী লিখেছেন- বেশিরভাগই জন্মসূত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে জড়িত সবার বর্ণনাতেই প্রথম একটা শব্দ উঠে আসে, বিনয়ী আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে খুরানার শেষ কর্মস্থল ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT) -তে দেখেছি, সমস্ত নোবেলজয়ীদের মধ্যে তিনিই একমাত্র বিনয়ী তবে কি বিনয়ী হওয়া অপরাধ?

     

    খুরানার জীবনী থেকে আর একটা বড় জিনিস শেখা যায় সেই মুলতানের কোন প্রত্যন্ত গ্রামের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের ছেলে, ছোটবেলায় ভেবেছিলেন ইংরেজি সাহিত্য পড়বেন কলেজে প্রবেশের সময়ে মুখচোরা হওয়াতে ইংরেজী পড়ার জন্য যে ইন্টারভিউ দিতে হত, তাতে অযোগ্য প্রমাণ হলেন রসায়নে সে সব কিছু লাগত না কাজেই আজ যে সব ছাত্র ছাত্রী বা তাদের বাবা মা মনে করেন যে ছোটবেলা থেকেই ভবিষ্যৎ ঠিক করে ফেলা যায়, এবং কোনও কারণে সেই ছক কষা পথ থেকে বিচ্যুত হলেই জীবন নষ্ট- তাদের খুরানার জীবন পড়তে বলি প্রতিটা বিচ্যুতি থেকে তিনি নতুন পথের সন্ধান পেয়েছেন- তাঁর একজন জীবনীকার লিখেছেন, "a scientist who traversed boundaries.’

     

    পুনশ্চ 70-এর দশকের শেষের সঙ্গে সঙ্গে খুরানা মনে করলেন জিন রহস্যের অধ্যায় শেষ, নতুন কিছু করা উচিত 80-র দশক থেকে আমৃত্যু খুরানার গবেষণা ছিল  rhodopsin বলে একটি প্রোটিন, যা চোখের রেটিনার আলোক-গ্রাহিতা নিয়ন্ত্রণ করে অজস্র খুঁটিনাটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রেখে গেছেন দর্শন রহস্যের বিষয়েও  

     

     

     

     

     


    সুস্মিতা ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    কোনও ঢাকা না থাকলে করোনা সোজা বর্ষিত হতে পারে মাথায়, মুখে, নাকে, হাতে

    সংক্রমণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আর রোগের পরিসংখ্যানের তাৎপর্য বোঝে না সাধারণ মানুষ, সুযোগ নেয় মেডিক্যাল

    ল্যাবরেটরি বা প্রকৃতিতে করোনা ভাইরাসের ডেল্টাক্রন রূপ বলে কিছু নেই, এটা নিতান্তই মিডিয়ার সৃষ্টি।

    ল্যাবরেটরিতে প্লাস্টিক খেকো ব্যাকটেরিয়ার মিউটেশন ঘটিয়ে সাফল্য আসলেও তার বাস্তবিক প্রয়োগ এখনও দূর

    দেশের সর্বত্র আইসক্রিম পাওয়া গেলে ভ্যাকসিন বণ্টনও অবশ্যই সম্ভব

    আজকের করোনা আর শতবর্ষে হর গোবিন্দ খুরানা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested