×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • বিশ্বজনীন সংস্কৃতি ও মুক্তচেতনার অগ্রপথিক আমার স্যর

    সুনন্দা কবীর | 27-05-2020

    আনিসুজ্জামান

    বাঙালির জ্ঞানসাধনার উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক আনিসুজ্জমানের স্মৃতিতর্পণে তাঁর ঢাকা নিবাসী এক সুযোগ্যা ছাত্রী 

                                                    

    তিরাশি বছর বয়সে চলে গেলেন আনিসুজ্জামান।
    তাঁর জন্ম এখনকার পশ্চিমবঙ্গে, চব্বিশ পরগনার বসিরহাটে, 1937-এ। ঘরানায় লেখালেখির চর্চা ছিল। পিতামহ শেখ আবুহর রহিম লেখক ও সাংবাদিক। মা সৈয়দা খাতুনও লিখতেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় দেশত্যাগ করলেন, এলেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে। তারপর গড়িয়ে গেল সময়। পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিতেও কিছুটা জড়িয়ে ছিলেন। 1957 তে এম.এ.। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগ দিলেন 1959 সালে। 1969-এ ‘রিডার’ হয়ে গেলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরলেন আবার 1985 সালে। অবসর নিলেন 2003-এ।


    প্রতিভা, মেধা ও সুরুচির প্রতিভূ ছিলেন আনিসুজ্জামান। প্রিয়দর্শন, ভরাট, অভিজাত কণ্ঠস্বর, বিশুদ্ধ, প্রমিত উচ্চারণ, সহজ অথচ দৃঢ় এক ব্যক্তিত্ব। ছাত্রমহলে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন আনিসুজ্জামান। বলা বাহুল্য, সেই জনপ্রিয়তা তাঁর জন্য সবসময় সুখকর হয়নি।


    শিক্ষার সঙ্গে বিশ্বজনীন সংস্কৃতি ও মুক্তচেতনার পাঠ দিতেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন পরমতসহিষ্ণু উদারমনস্ক সংস্কৃতির বোধ ছাড়া দেশে কোনও মানবিক কল্যাণ বয়ে আসেনা। যে কারণে গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও ঠিক সেভাবে আমরা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে সামিল হতে পারিনি। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখা যায়নি। শোষণহীন, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন এখনও  অধরা, এখনও আমাদের রাজনীতি কোনও সর্বজনীন ঐকমত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। মানবিক মূল্যবোধকে সামনে রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আবেদন ছিল তাঁর ছাত্রদের প্রতি।
    ছাত্রজীবন থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে এই মানুষটির অবদান বিস্মৃত হওয়ার নয়।


    পেয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী’ ও ‘সরোজিনী বসু’ পদক। সার্ক- 2019 সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছিলেন। এছাড়াও দু’বার আনন্দ পুরস্কার এবং ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে সম্মানিত হয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে পেয়েছিলেন ‘একুশে পদক’, ‘বাংলা আকাদেমি’ ও ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’। 1998 সালে হয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক।


    মুজিবর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন 1971-এ। বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। রাজনীতিবিদ না হয়েও ছিল প্রবল দেশাত্মবোধ, যার জন্যে বিরোধিতা সত্ত্বেও 1961 সালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর সরকার থেকে কড়াকড়ির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। হাত কচলানোর সংস্কৃতি কিংবা আত্মসম্মানবোধের অবক্ষয় তাঁর মেরুদণ্ডকে দুর্বল করেনি কখনও। সহজ করে সত্যকথন তাঁর সহজাত ছিল। ফলে নানারকম হুমকির সঙ্গে সাম্প্রদায়িক ভীতিপ্রদর্শন ছিল নৈমিত্তিক, যার ফলে এক সময়ে তাঁর জন্যে দেহরক্ষীর ব্যবস্থা করতে হয় সরকারকে। বাংলাদেশ হওয়ার পর ক্ষমতাসীন মহলের কাছাকাছি থেকেও অন্যায় কোনও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেননি। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও নিজের আখের গোছানোয় নির্মোহ ছিলেন আনিসুজ্জামান।


    বাংলাভাষায় আদ্যন্ত নিবেদিত মানুষটি সামগ্রিকভাবে ভাষাটির চর্চা করেছেন আন্তরিক ভালবাসা থেকে। তিনি বলতেন বাংলা কোনও পোশাকি ভাষা নয়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাংলা ভাষারও একটা ব্যবহারিক ও সাহিত্যিক মূল্য আছে। তাদের কাব্য, গান, শিল্প– সবকিছুর সমৃদ্ধি দিয়েই আমাদের ভাষা। প্রমিত বাংলার পাশাপাশি এদের চর্চা ও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। যে ভাষার জন্য বাংলাদেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন, সে ভাষার প্রতি বহু ক্ষেত্রে অবহেলা, অনাগ্রহ তাঁকে ব্যথিত করত। সমৃদ্ধ পরিভাষা সত্ত্বেও অন্যভাষার আশ্রয় নেওয়া তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি কখনও।
    সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি হিসেবে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, নেতাজি সুভাষ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট  উপাধি পেয়েছিলেন।


    1960 সাল, কুমিল্লা থেকে এসেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়তে। কুমিল্লার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল চিরকালই বিখ্যাত ছিল। বিখ্যাত ছিল অ-সাম্প্রদায়িক চেতনার জন্যও। আমার বাবা সুধীর সেন প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এবং পরে শান্তিনিকেতনে গবেষক হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ থেকে আরম্ভ করে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেন, বিধুশেখর শাস্ত্রীমশাই– শ্রদ্ধেয় সে সমস্ত নাম এবং তাঁদের জীবনচর্চার আলোচনা মনে একটা পরোক্ষ প্রভাব ফেলেছিল। তাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই নিষ্করুণ মধ্যাহ্নে প্রথম যাঁর পাঠদান আমাকে আবিষ্ট করে রাখত, তিনি ছিলেন তরুণ এক অধ্যাপক, তাঁর নাম আনিসুজ্জামান। আদর্শ শিক্ষকের সমস্ত গুণের সমন্বয় এই নিরহংকার সজ্জন ব্যক্তিটির মধ্যে ছিল। তাঁর অসাধারণ পান্ডিত্য ও জ্ঞানের পরিমাপ করবেন বিদ্বজ্জনেরা। মত্সদৃশ কূপস্য মণ্ডুকের পক্ষে যেটা সম্ভব নয় কিছুতেই। সঙ্গে ছিল তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতা।


    প্রত্যক্ষ ছাত্রী হওয়ার সুবাদে একটা প্রশ্রয় ছিল। সেই প্রশ্রয়ে অনেক অযৌক্তিক আবদারও তাঁকে সামলাতে হত। এখানে প্রসঙ্গত একটা কথা বলি। তখন স্যর কলকাতায় ছিলেন। তাঁকে বলেছিলাম, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে লেখা আমার মা সুধা সেনের একটা চিঠি (যে চিঠির সাক্ষ্যে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়) এবং বিশ্বকবির উত্তর রয়েছে। সম্ভব হলে এই দু’টোর কপি নিয়ে আসতে। বলা বাহুল্য স্যর অনুরোধ রেখেছিলেন। তাছাড়া আমার সমস্ত পারিবারিক দুর্যোগে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, মাথায় হাত রেখেছেন পরম মমতায়। এ আমার এক পরম পাওয়া।


    তাঁর স্ত্রী বেবী, ভাল নাম সিদ্দিকা, যাঁর সঙ্গে প্রথমে প্রণয়, পরে পরিণয়, সেও আমার বান্ধবী। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব অক্লেশে পালন করার কারণে তাঁর সহজ সুন্দর সুযোগ্য স্ত্রীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ ছিলেন আনিসুজ্জামান। তাঁদের কন্যাদ্বয় রুচিরা ও শুচিতা এবং পুত্র আনন্দ।


    এবার একুশে বই মেলার উদ্বোধনে দেখলাম, শেখ হাসিনা তাঁকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। পরদিন ফোনে মৃদু বকুনিও দিলাম। বললেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।


    দেখতে দেখতে ইদ এল। প্রতিবছর এমন দিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাই। ভাবছিলাম, এখন থেকে আর কোনও দিনই ফোন তুলে বলতে হবে না, ‘স্যর সুনন্দা বলছি।’
     


    সুনন্দা কবীর - এর অন্যান্য লেখা


    তিরাশি বছর বয়সে চলে গেলেন আনিসুজ্জামান। স্মৃতিতর্পণে সুনন্দা কবীর।

    বিশ্বজনীন সংস্কৃতি ও মুক্তচেতনার অগ্রপথিক আমার স্যর-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested