×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ‘শ্যামাপ্রসাদী' সিভিল ওয়ার

    আশীষ লাহিড়ী | 11-12-2021

    নিজস্ব ছবি

    গৃহযুদ্ধ-টুদ্ধ নয়, সরাসরি সিভিল ওয়ার (Civil War) কথাটাই ব্যবহার করছি, যাতে কোনওরকম দ্ব্যর্থকতার অবকাশ না থাকে।

     

    এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা (Encyclopedia Britannica) জানাচ্ছে, সিভিল ওয়ার  হল ‘একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সেই রাষ্ট্রের অন্তর্গত এক বা একাধিক সংগঠিত অ-রাষ্ট্রিক শক্তির সহিংস সংঘর্ষ।'  তার মানে, ‘বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ কিংবা দাঙ্গাও এর আওতায় পড়ছে না।' সোজা কথায়, সিভিল ওয়ার মানে হল রাষ্ট্রের সঙ্গে এক বা একাধিক গোষ্ঠীর সহিংস সংঘর্ষ।

     

     

    না, কোনও রকম সিভিল ওয়ারের ডাক দিয়ে ইউএপিএ সেলগুলির বোঝার ওপর শাকের আঁটি হওয়ার উদ্দেশ্য আমার নেই। আমি কেবল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ডায়েরির দু-একটি মন্তব্য পড়ে বিহ্বল হয়ে সিভিল ওয়র শব্দবন্ধটার ঠিক অর্থ বোঝবার চেষ্টা করছি। কী বলেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ? তথাগত রায় শ্যামাপ্রসাদের যে ‘কমপ্লিট বায়োগ্রাফি’টি লিখেছেন, তা থেকে জানছি, 21 অগস্ট 1945 কেন্দ্রীয় সরকার আসন্ন শীতকালে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা করার পর শ্যামাপ্রসাদ নির্বাচনী প্রচারে মনপ্রাণ ঢেলে দেন। ভারতের অন্যান্য জায়গায় হিন্দু মহাসভার দশা তখন অত্যন্ত করুণ। বাংলায় উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত ও পরিশীলিত শ্যামাপ্রসাদের ব্যক্তিগত গরিমায় মহাসভার অবস্থা ততটা খারাপ নয়, তাই সকলেই চেয়ে আছে বাংলায় হিন্দু মহাসভা কী ফল করে তার দিকে।

     

     

    অত্যধিক শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করে 1945 সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে শ্যামাপ্রসাদ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক দিকে নির্বাচনী প্রচারের ধকল, অন্য দিকে আজাদ হিন্দ ফৌজ দিবসে ছাত্র মিছিলের উপর ব্রিটিশদের গুলি চালানোর প্রতিবাদে উত্তাল কলকাতাকে সামাল দেওয়ার চাপ, দুয়ে মিলে তিনি কাবু হয়ে পড়লেন। ডাক্তারবাবুদের পরামর্শে মধুপুরে তাঁদের পারিবারিক প্রাসাদ ‘গঙ্গাপ্রসাদ হাউস'-এ 1945-এর 27 ডিসেম্বর থেকে 1946-এর 27 জানুয়ারি, এই এক মাস পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিলেন। সেই বিশ্রামকালে তিনি ইংরেজি ও বাংলাতে ডায়েরি লেখেন। সেখানে 3 জানুয়ারি 1946 নানান প্রসঙ্গ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার ফাঁকে হঠাৎই, কোনও রকম পূর্বপ্রসঙ্গ ছাড়াই, লিখে ফেলেন,

     

     

    "শেষ বিচারে, বলপ্রয়োগের মোকাবিলা বলপ্রয়োগ করেই করতে হবে। সশস্ত্র সহিংসতার বিরুদ্ধে অ-প্রতিরোধের অভ্যন্তরীণ নীতি যে কোনও সমাজকেই শেষ পর্যন্ত ভেঙে চুরমার করে দেয়।'

     

     

    রায় মহাশয় নির্ভুল প্রত্যয়ে বলেছেন, গান্ধীবাদী অহিংসা-নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর কথা এটি।

     

     

    আমরা চমকিত হই। তা হলে কি শ্যামাপ্রসাদ তাঁর চিরশত্রু সুভাষ বোসের পথ ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম মারফত ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ডাক দিচ্ছেন? নাকি, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জঙ্গি ছাত্রদের সিভিল ওয়ার শুরু করার ‘কমুনিস্টি’ পরামর্শ দিচ্ছেন? তথাগতবাবু এর পটভূমিটি বুঝিয়ে বলার পর আমাদের ধন্দ কাটে। কী সে পটভূমি?

     

     

    1945 সালের নির্বাচনে হিন্দু মহাসভা গোহারান হেরেছিল। সর্বত্রই বিপুল সংখ্যক হিন্দুদের ভোট হাইজ্যাক করে নিয়েছিল কংগ্রেস। হুগলি জেলার নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামক এক অখ্যাত, অজ্ঞাত কংগ্রেস প্রার্থীকে সুখ্যাত, সর্বজনপরিচিত শ্যামাপ্রসাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদ পেয়েছিলেন 346টি ভোট, নগেন্দ্রনাথ 10216টি! এই অসম্মান, হিন্দু নির্বাচকমণ্ডলীর এই সার্বিক প্রত্যাখ্যান, শ্যামাপ্রসাদের বুক ভেঙে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হিন্দুরাও হিন্দু মহাসভাকে, খোদ শ্যামপ্রসাদকে ত্যাগ করে কংগ্রেসকেই তাদের মুক্তিদাতা ভেবে নিল, যে-কংগ্রেস কিনা খামোকা হিন্দু-মুসলমান মিলনের কথা বলে? মুসলমানদের মুসলিম লিগ আর হিন্দুদের হিন্দু মহাসভা– এই যে-বাইনারিটিকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য মহম্মদ আলি জিন্না আর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রাণপাত করছিলেন, তাকে তখনকার মতো চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের বাঙালি হিন্দুরা। জিন্নার দিক থেকে অবশ্য দুঃখের কিছু ছিল না, কারণ মুসলমানরা তো দলে দলে লিগকেই ভোট দিয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেসের জিত, লিগের জিত আর মহাসভার হারের এই ত্রিমেরু যন্ত্রণা শ্যামাপ্রসাদের মনে ধুঁইয়ে ধুঁইয়ে উঠছিল। তারই প্রতিক্রিয়ায় হঠাৎ-আলোর ঝলকানির মতন তাঁর মনে উদয় হল মুসলিম-বিরোধী সহিংস আন্দোলনের কথা। ‘বলশালী সন্ন্যাসী'-জোগানদার স্বামী প্রণবানন্দর গুণমুগ্ধ এই মানুষটির মনে হল, নির্বাচন-টির্বাচন দিয়ে কিছু হবে না, চাই সম্মুখ-যুদ্ধ। এ যেন জিন্নার ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন'-এরই হিন্দু প্রাক্-প্রতিধ্বনি। প্রাক্-ই বা কেন, কলকাতার দাঙ্গার পরেও (7 নভেম্বর 1946) তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত কিছু সৈন্যকে তাঁর মুসলমান-বিরোধী সিভিল ওয়রে সামিল করেছিলেন, তার প্রমাণ আছে। 

     

    আরও লক্ষণীয়, সিভিল ওয়রের সমান তালে চলেছিল তাঁর আধ্যাত্মিক আকুতি:

    হে করুণাময় ঈশ্বর, আমার অন্তরে তোমায় দেখতে দাও। নিজের জন্য আমি কিছুই চাইছি না, শুধু তোমার পায়ে একটু ঠাঁই দিও।... অনেক পাপ করেছি আমি, অনেক সময় ক্ষণিকের তৃপ্তির জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি। তোমার কাছে আমার কিছুই অজানা নেই।... জন্তুদের প্রবৃত্তিতাড়িত আচরণ আমি অনেক সময় লক্ষ করেছি। কিন্তু মানুষ, যার আত্মা আছে, যে ঈশ্বরকে চিনতে পারে, সে-ও যদি সব কিছু ভুলে এইসব হীন কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করে, তাহলে এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে?

     

     

    এমন কি হতে পারে যে, আত্মসমর্পণী আধ্যাত্মিকতা আর জঙ্গি সিভিল ওয়ারের কল্পনা দেহে মনে অবসন্ন এক জন মানুষের ক্ষণিকের ফ্রাস্ট্রেশনের মনস্তাত্ত্বিক বহিঃপ্রকাশ? না, তা নয়। কারণ ঠিক সাত দিন পরেই, 10 জানুয়ারি 1946 তিনি প্রাঞ্জল, অপ্রমত্ত ভাষায়, স্পষ্ট করে তাঁর মত ও যুক্তি প্রকাশ করলেন তাঁর বাংলা ডায়েরিটিতে। তথাগতবাবুর বইতে তার ইংরিজি অনুবাদ রয়েছে। তা থেকে বাংলায় পুনরনুবাদ করলে দাঁড়ায়:

     

     

    ‘দুটি পক্ষই (অর্থাৎ হিন্দু আর মুসলমান) যদি ভারতীয় সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখবার জন্যে একযোগে কাজ করে, যদি তারা নিজ নিজ বিশ্বাস মাফিক মিলেমিশে থাকতে পারে, তাহলে কোনও বিবাদ হয় না। কিন্তু মুসলমানরা অতি-উদ্যমী হয়ে উঠে যদি হিন্দুদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তাহলে নিজেদের রক্ষা করবার জন্য কী করতে হবে তা নিয়ে হিন্দুদের কোনও মাথাব্যাথা নেই। সেক্ষেত্রে সিভিল ওয়ার ছাড়া হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানের কোনও পথ নেই। সিভিল ওয়ার আমরা চাই না, কিন্তু ও-পক্ষ যদি নিয়তই নিজেদের প্রস্তুত করে রাখে এবং আমরা যদি অপ্রস্তুত অবস্থায় ওদের সম্মুখীন হই, তাহলে হার স্বীকার করতে হবে তো আমাদেরই। কংগ্রেস হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে, কোনওদিনই পারবে না সমস্যা সমাধান করতে।... হিন্দুদের সমর্থনের ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা যে-সংগঠন হিন্দুস্বার্থ-রক্ষাকেই পাপ মনে করে, সে কী করে লড়াই করবে এমন এক সংগঠনের সঙ্গে যে কিনা মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজে নিবেদিত? হিন্দুরা মননশীলতা ও আর্থিক সম্পদে এত অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও এই সহজ সত্যটা বুঝতে পারল না, এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে?’

     

     

    দুই ধর্মের চরিত্রগত ফারাককেই তিনি এর জন্য দায়ী করেন:

    ‘ইসলামের রয়েছে ঐক্যবদ্ধতার ও সমতার অনন্য এক চেতনা, যার অভাব রয়েছে হিন্দুধর্মে। জাতপাত, মত কিংবা ধর্মর ভিত্তিতে হিন্দুরা এমনভাবে বিভক্ত যে তারা একে অপরের মন বুঝতে পারে না। পক্ষান্তরে, একজন মুসলমান অবধারিতভাবেই অন্য একজন মুসলমানের সঙ্গে একাত্মতার বন্ধন অনুভব করে, কার কোথায় জন্ম, ভারতে, নাকি পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে, এসব কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।'

     

     

    হিন্দুধর্মের সেই জন্মগত ত্রুটি সিভিল ওয়ারের জিগির দিয়ে শুধরে নিতে চাইলেন তিনি।

     

    সিভিল ওয়ার না পাতি দাঙ্গা?

    প্রশ্ন ওঠে, এ কি সিভিল ওয়ার না নেহাতই এ-পাড়া ও-পাড়ার মস্তানদের পাতি দাঙ্গা? এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা-র লেখকদের মতে, ‘বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ কিংবা দাঙ্গা সিভিল ওয়রের আওতায় পড়ছে না।‘ অবশ্য আপনি বলতেই পারেন, এবি-র রায়ই শিরোধার্য করতে হবে, এমন কোনও মাথার দিব্যি কেউ দিয়েছে কি? তা ছাড়া, বলা তো যায় না, এবি-র মধ্যেও হয়তো ঘাপটি মেরে বসে আছে সেই ঘৃণিত, মরিয়া-না-মরে-রাম প্রজাতির দু’চারটি নমুনা, যার নাম সেকিউলারিস্ট?

     

     

    ভাল কথা। বরং আমরা তথাগতবাবুর বিমোহিত ব্যাখ্যানটিই অনুসরণ করি। প্রথমত তিনি বলেছেন, ‘যা লেখা যায় না, যা বলা যায় না' কিন্তু সত্য, তা লেখবার ও বলবার মতো হিম্মত একমাত্র শ্যামাপ্রসাদেরই ছিল, কয়েক মাস পরেই 1946-এর অগস্টে জিন্না যে-ডিরেক্ট অ্যাকশনের ডাক দেবেন, সেটা হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সিভিল ওয়ার ছাড়া আর কী?

     

     

    মুশকিল হচ্ছে, কোনও সিভিল ওয়ার কখনও তিন দিনে থেমে গেছে বলে শুনিনি। দ্বিতীয়ত, ওই দাঙ্গা বাধানোর জন্য জিন্না আর সুরাবর্দি ছাড়াও সবচেয়ে বড় অপরাধী তো রাষ্ট্র-পরিচালক ব্রিটিশ সরকার। তাদের পোষা সৈন্যদল যদি দাঙ্গার সময় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে বসে গঙ্গার নির্মল হাওয়া সেবন না করে, সঙ্গে সঙ্গে নামত কলকাতার রাজপথে, তা হলে কোথায় থাকত জিন্না-সুরাবর্দির সাধের ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’? ছাত্র আন্দোলনের ওপর গুলি চালাতে যাদের এতটুকু সময় লাগে না, তারা দাঙ্গার সময় নিষ্ক্রিয়! তৃতীয়ত, একটা উপনিবেশে সিভিল ওয়র চলছে, কিন্তু রাষ্ট্র-পরিচালকদের গায়ে আঁচড়টি লাগছে না, রকম কি হয় নাকি? চতুর্থত, শ্যামাপ্রসাদ যদি আগে থেকেই জিন্নাদের ডিরেক্ট অ্যাকশনের কথা আঁচ করে থাকেন, তা হলে এটাই প্রতিপন্ন হয় যে, ক্ষমতা থাকলে হিন্দুদের পক্ষ থেকে ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন'-এর ডাক তিনিই দিতেন। কারণ ‘নীচু জাত থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত কয়েক দল লোকের মন রাখতে গিয়ে অতি প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দেওয়ার সম্ভাবনা শিহরিত করেছিল তাঁকে। কিন্তু তাঁর আক্ষেপ, নির্বাচনে  প্র্ত্যাখ্যান করে সে-ডাক দেওয়ার ক্ষমতা থেকে তাঁকে বঞ্চিত করেছিল বাঙালি হিন্দুরা।

     

    সত্যিকারের সিভিল ওয়: আমেরিকা আর স্পেন

    অথচ, আশ্চর্যের ব্যাপার এই, 1945 সালে শ্যামাপ্রসাদ যখন হিন্দু-মুসলমানের আসন্ন পরিকল্পিত দাঙ্গাকে সিভিল ওয়ার বলে চালাতে চাইছেন, তার মাত্র ছ-বছর আগেই স্পেনে সত্যিকারের এক রক্তস্নাত সিভিল ওয়ার সমাধা হয়েছে। ফ্যাসিস্ট জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে রিপাবলিকানদের সেই লড়াই সারা বিশ্বের সুধীসমাজের সমর্থন ও সমীহ আদায় করেছিল। বহু দেশ থেকে সহমর্মীরা ছুটে গিয়েছিলেন তাঁদের হয়ে লড়াই করবার জন্য, দিয়েছিলেন প্রাণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট নির্মমতার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন রিপাবলিকানরা। হিটলার-মুসোলিনির বাহিনী স্পেনের বাস্ক প্রদেশের গের্নিকা নামক ছোট্ট একটি শহরকে বোমা ফেলে বিপর্যস্ত করে দেয়, হত্যা করে হাজার হাজার অসামরিক মানুষকে। মুশকিল হচ্ছে, রিপাবলিকানরা বেশির ভাগই ছিল শ্যামাপ্রসাদদের ঘৃণিত সেই সেকিউলারপন্থী প্রজাতির সদস্য। তাই হিন্দু-মুসলমান সিভিল ওয়ারের সুখস্বপ্নে বিভোর শ্যামাপ্রসাদের কাছে মাত্র ছ-বছর আগে স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারে সাড়ে সাত লক্ষ স্পেনবাসীর মৃত্যু উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মনে হয় না।

     

     

    অন্তরের এই দৃষ্টিক্ষীণতা অবশ্য শ্যামাপ্রসাদপন্থীদের কাছে গৌরবের বস্তু, কারণ এতদ্বারা প্রমাণিত হয়, একমাত্র হিন্দ-হিন্দি-হিন্দুই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তথাগতবাবু আমেরিকান সিভিল ওয়ারের প্রসঙ্গ তুলে দেখিয়েছেন, সেখানে সিভিল ওয়ারই দেশভাগ ঠেকিয়েছিল। সুতরাং, তাঁর দূরকল্পনা, শ্যামাপ্রসাদের বাসনা পূরণ করে এদেশে যদি হিন্দু-মুসলমান সিভিল ওয়ার বাঁধানো যেত, তাহলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের মতো এখানে মুসলমানরাও হয়তো হার মেনে নিয়ে ভাল মানুষের মতো অবিভক্ত ভারতে মাথা নীচু করে বাস করতে বাধ্য হত। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত শ্যামাপ্রসাদের বিচার্য ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, বাংলা ভাগ হোক বা না-হোক, হিন্দুদের হাতে মুসলমানরা যেন হারে, ঠিক যেমন, ব্যক্তিগত জীবনে সম্পূর্ণ সেকিউলার জিন্নার কাছে মূল ব্যাপারটা ছিল যেন তেন প্রকারেণ মুসলমানদের হাতে হিন্দুদের হার। আমেরিকার সিভিল ওয়ার কিন্তু বেঁধেছিল দাসপন্থী আর গণতন্ত্রপন্থীদের মধ্যে, অর্থাৎ সেকিউলার ইস্যু নিয়ে, ক্যাথলিকদের সঙ্গে পিউরিটানদের মারামারি সেখানে ছিল গৌণ। কাজেই শ্যামাপ্রসাদ-প্রকল্পিত হিন্দু-মুসলমান ‘সিভিল ওয়ার’-এর সঙ্গে সেটা তুলনীয় হল কি?

     

     

    কাজেই, সব মিলিয়ে দাঁড়াল এই, জিন্না আপামর মুসলমান সমাজের জন্য যা করতে চেয়েছিলেন, ভদ্রলোক হিন্দু সমাজের জন্য শ্যামাপ্রসাদ ঠিক সেটাই করতে চেয়েছিলেন। এঁরা উভয়েই মধ্যযুগীয় ক্রুসেডের নীতিকে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের উপযোগী করে সাজিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কেউই ধর্মীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। তফাত এই, জিন্না তাঁর জুয়োখেলায় জিতে গিয়েছিলেন, কংগ্রেসের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন তাস, শ্যামাপ্রসাদ জিততে পারেননি, কংগ্রেসই তাঁর হাত থেকে তাস ছিনিয়ে নিয়েছিল। বাংলা ভাগের প্রক্রিয়ায় কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটিই হয়ে উঠেছিল মূল গায়েন, শ্যামাপ্রসাদ বড় জোর তবলচি।

     

     

    পরাজিতের প্রতি মানুষের একটা স্বাভাবিক সহানুভূতি থাকে। কিন্তু সেই সহানুভূতি যদি নানা ভাষা, নানা মতের এই দেশকে এক মত, এক ভাষার ছাঁচে ঢালতে চায়, সেটাকে প্রতিহত করাই কি সুস্থ মানুষের কর্তব্য নয়?

     


    আশীষ লাহিড়ী - এর অন্যান্য লেখা


    জিন্না ও শ্যামাপ্রসাদ কেউই ধর্মীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি।

    ‘শ্যামাপ্রসাদী' সিভিল ওয়ার-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested