×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ‘তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে’

    অশোককুমার মুখোপাধ্যায় | 11-03-2020

    এই ছবি ঘিরেই যাবতীয় বিতর্ক

    রবীন্দ্রভারতীর চত্বরে ঢুকে, জনসমক্ষে যে অশ্লীল কাণ্ড ঘটিয়েছে কতিপয় বহিরাগতছাত্রছাত্রী, যারা তার নিন্দা করেননি এখনও, তাদের ঘৃণা করি। যে তৃণজীবী  বিদ্বজ্জন ভালো করে জানিনা’, ‘রাজনীতিটা ঠিক বুঝি না’, ‘ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে হবেইত্যাকার ঢোক-গেলা কথায় নিন্দা করা থেকে বিরত থাকতে চাইছেন বা চাইবেন, তাদের ঘৃণা, না-না ঘৃণা নয়, করুণা করি। কারণ, ওইসব দেব-দেবী প্রতিম চরিত্রগুলি এই ঢালের আড়াল নিতে গিয়ে তাদের পশ্চাদ্দেশের বাঁশ এবং খড়ের দিকটি উন্মোচিত করে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন, আমরা সাধারণ মানুষেরা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো, লুম্পেনকে লুম্পেন বলবার সাহস রাখলেও এইসব আলোকিতচরিত্রেরা নিতান্তই প্রভুভক্ত কানঝোলা সারমেয়!

     

    যারা বলবার চেষ্টা করবেন, ‘আহা ওইসব বাচ্চা ছেলেমেয়েরা একটা দুষ্টুমি করে ফেলেছেকিংবা সামান্য ঘটনা’, তাদের উদ্দেশে তীব্র ন্যক্কারে ভরা শ্লেষ্মা নিক্ষেপ করতে-করতে বলব,  হে মহোদয়, মহোদয়া, আপনাকে-আপনাদের ঘৃণা করি। একটি মেয়েলি রুমাল দিয়ে পূর্ণবয়স্ক উলঙ্গতা ঢাকবার চেষ্টা করছেন! আপনারাই পংক্তির গায়ে পংক্তি দাঁড় করানোকে কবিতা,  রঙের প্রলাপকে ছবি,  সুর ও বাণীর তেল-জল মিশ্রণকে গান বলে চিনতে বাধ্য করেছেন বহুজনকে। আপনাদের আমদানি করা ছত্রিশ পার্বণের পথ বেয়েই এসেছে এইসব জঞ্জাল-সংস্কৃতির প্রদর্শনী।

     

    ঘৃণা করি রবীন্দ্রভারতীর সেইসব প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্রছাত্রীদের যারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থেকে বিবৃতি দিয়ে চলেছেন। হে ধীমান ছাত্রছাত্রীবৃন্দ আপনাদের লজ্জা করছে না এই ভেবে যে, চোখের সামনে এমন অশ্লীল মর্কটবৃত্তি দেখবার সময় আপনারা গোপাল অতি সুবোধ বালকেরমতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন? আপনাদের নির্মল সাহস, যা নাকি ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিক ধর্ম, তা কোন রাখালদার ক্যান্টিনে চা খেতে গিয়েছিল? এখন লজ্জা হচ্ছে না নাম লুকিয়ে ঘোমটার আড়ালে কাপুরুষের মতো বিবৃতি দিতে? অবশ্য, শুধু আপনারাই বা কেন, আপনাদের অধ্যাপকেরাও তো সংগোপনে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করছেন! বোঝাই যাচ্ছে কী এক ত্রাসের রাজত্ব জারি রবীন্দ্রভারতীর আকাশে-বাতাসে। হায় রবীন্দ্রভারতীর ছাত্র এবং অধ্যাপকবৃন্দ! আর কতকাল বৃহন্নলাবৃত্তি করে কালক্ষেপ করবেন? শমীবৃক্ষে রাখা অস্ত্রগুলি লৌহমলে ভরে ওঠবার আগে তা হাতে তুলে না নিলে সমাগত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আপনাদের পতন অনিবার্য।

     

    যে সমস্ত আপাতগম্ভীর সমাজবিজ্ঞানী রবীন্দ্রভারতীর ঘটনার মধ্যে এখনকার সমাজের নতুন কোনও মানসিক বিকার ইত্যাদি খুঁজে বের করবার চেষ্টা করছেন, তাদের বাগাড়ম্বরের উদ্দেশে তিনটে তুড়ি। আপনাদের শূন্য দেওয়া হলেও বেশি নম্বর হয়ে যায়! জেনে রাখুন, এ মানসিকতা কোনও নতুন অসুখ নয়তখনকার দিনে নবমীতে পাঁঠা ও মোষ বলি করিয়া গায়ে রক্ত, কাদা মাখিয়া মোষের মুণ্ডু মাথায় লইয়া পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা হইত। আর বৃদ্ধ পিতামহ তাহার সমবয়স্কিলোক, পুত্র - পৌত্র লইয়া হাতে খাতা লইয়া কাদামাটির গান করিত। সে সব অতি অশ্লীল ও অশ্রাব্য গান। বাড়ির মেয়েদের সম্মুখেও সেইসব গাওয়া হইত এবং পাছে ভুল হয় এজন্য হাতে লেখা খাতা রেখে দিত ইহাকে অপর কথায় খেউড় গান বলিত। তখনকার দিনে এ সবের প্রচলন ছিল এবং লোকে বিশেষ আপত্তি করিত না, বরং আনন্দ অনুভব করিত। কিন্তু ইংরাজি শিক্ষা ও কেশব সেন মহাশয়ের অভ্যুদয় হইতে ধীরে ধীরে এ সব উঠিয়া যায়।’ (কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা/মহেন্দ্রনাথ দত্ত)

     

    সত্তর দশকের মাঝামাঝি নকশাল আন্দোলন থিতিয়ে পড়বার পর, ‘নবযুগের পতাকাবাহী কিছু গাই-বাছুর ছাত্র কলেজ হস্টেলে আমদানি করবার চেষ্টা করেছিল রবীন্দ্রনাথের মায়াবনবিহারিণী’, ‘একলা চলো রে’, ‘আরো আরো, প্রভু, আরো আরো’-কে অশ্লীল শব্দ যোজনা করে গাইবার সংস্কৃতি, বিশেষত, শেষোক্ত গানটি ব্যবহার করা হত কোনও ছাত্রীকে র‌্যাগিং করবার সময়ে। সেই নিদারুণ সময়েও, তদ্দণ্ডে, মুখোমুখি এর প্রতিবাদ হয়েছে। এবং সেইজন্যই এইসব গানেরও সামাজিক প্রদর্শনী করবার সাহস হয়নি কারও। অশ্লীলতা দমন করাটাই শিক্ষা। বিবর্তনের বিপরীতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের দিকে চলাটা শুধু অবৈজ্ঞানিকই নয়, তা অপশিক্ষা। অপশিক্ষার দমন কেশব সেনের অভ্যুদয়ে ঘটেছিল, পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ হাতে-নাতে যা আমাদের দেখিয়ে গেছেন।

     

    এইজন্যই ঘৃনা করি ওই ময়ূরপুচ্ছধারী, সর্বজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীকুলকে কারণ, তারা যেন রকেট বিজ্ঞানের গবেষণা করে নতুন কোনও আহৃত তথ্যের সন্ধান দিচ্ছেন! এমন তথ্য, যা আমরা বহুদিন জানি। দিচ্ছেন এমন সময়ে, যখন অশ্লীলতা দমন করবার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

     

    এইজন্যই, কোনও বাছবিচার না করে, কোনওরকম ভূমিকা ছাড়াই নির্ভেজাল ঘৃণা উপহার দিতে চাইব শ্রীরামপুর কলেজের সেইসব অভিযুক্ত ছাত্রছাত্রীদেরহে লুম্পেন যুবক-যুবতীরা! আপনাদের সাহস হবে মুখ্যমন্ত্রীর কবিতার ল্যাজামুড়োয় অশ্লীল শব্দ বসিয়ে বুক-পিঠে তা প্রদর্শন করবার? সাহস হবে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের অশ্লীল প্যারডি বানাবার?  হবে নাকারণ, আপনাদের চামড়া তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন যথেচ্ছাচার করা যায় তার বড় কারণ, আপনারা দেখেছেন, বাম-ডান-পুব-পশ্চিম সব কুমির-ডাঙা খেলা রাজনৈতিক দল প্রয়োজন মতো রবীন্দ্রনাথকে ধরে এবং ছাড়ে। বোঝাই যাচ্ছে আপনাদের অভিভাবকদের তত্ত্বাবধান এবং স্কুলের দশ-বারো বছরের জীবন আপনাদের শিক্ষিত করেনি, সাংস্কৃতিক লুম্পেন তৈরি করেছে।

     

    যদি সত্যি আমরা মনে করি যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের মুখে ভাষা দিয়েছেন, গান দিয়েছেন, দৃষ্টি দিয়েছেন, আধুনিক মন দিয়েছেন, যদি সত্যিই মনে করি রবীন্দ্রনাথ আমাদের, প্রতিটি বাঙালির, পরম পাওয়া, সাতরাজার ধন এক মানিক, তবে এইসব লুম্পেনদের কঠোরতম দণ্ড দাবি করতে আমাদের গলা যেন না কাঁপে। তা যদি না চাই আজ, বাঙালি জাতির মাথার উপরে যেন বজ্র নেমে আসে, বাঙালি যেন ভেসে যায় যুগান্তকারী বন্যায়, বাংলার ঘরে-ঘরে যেন প্রতিটি প্রাণের সম্ভাবনা ভ্রূণেই বিনষ্ট হয়।

     

     


    অশোককুমার মুখোপাধ্যায় - এর অন্যান্য লেখা


    ঘৃণা করি রবীন্দ্রভারতীর সেইসব প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্রছাত্রীদের যারা ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ থেকে বিবৃত্ত

    ‘তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে’-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested