আবার নতুন আতঙ্ক! সাগরপার থেকে কোভিডের নতুন স্ট্রেইন ওই বুঝি এল রে! ভারত তো আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা আবার পুরোদমে চালু করতে গিয়েও পিছিয়ে গেল ভয়ে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে এই বলে যে, ওমিক্রন চিন্তার বিষয়।
সাবধানের মার নেই, সবাই জানে। তাই বলে কি আতঙ্কে থাকতে হবে? ওমিক্রনের ব্যাপারে আতঙ্কের কি সত্যিই কিছু আছে? সত্যিটা বোঝানোর জন্যে কিছু কিছু তথ্যের অবতারণা করি।
ওমিক্রন কি ?
এটি covid-19 রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস অর্থাৎ SARS-Cov2 এর একটি নতুন প্রজাতি, যাকে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকাতে “নতুন'' বলে দেখতে পাওয়া গেছে।
মিউটেশন কী বা কাকে বলে?
মিউটেশন হল বদল। সম্পত্তি-বাড়ি-জমির মালিকানা বদল হলে মিউটেশন বলে, শুনেছেন বোধহয়! আবার জিন শব্দটাও শুনেছেন হয়তো, সেই জিনের মধ্যে পরিবর্তনকে মিউটেশন বলা হয়। মিউটেশন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। প্রকৃতি এবং সংখ্যাতত্ত্বের নিয়ম মেনে ঘটে থাকে।
এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা আমি গত বছরে একটি লেখাতে করেছি পড়ে দেখলে ধারণা আরও স্পষ্ট হবে।
আরও পড়ুন: ভাইরাসের মিউটেশন স্বাভাবিক ধর্ম, ভাল-মন্দ দু’দিকেই যেতে পারে
মোদ্দা কথা, এই যে জিন হল যে কোনও জীবের জীবন কাহিনী লেখার জৈবরাসায়নিক তথ্য, কোড বা ভাষাও বলা চলে। আমরা যখন কোনও তথ্য নথিভুক্ত করি, তখন কয়েকটি বাক্য সেই তথ্যের বর্ণনা দিতে ব্যবহার করি।
একটা খুব সহজ উদাহরণ দিই। ধরা যাক, একটি অনুষ্ঠানের বিবরণ দেওয়া হচ্ছে এই বাক্যটি দিয়ে “সম্মাননীয় ব্যক্তিদের মাল্যদান করে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হল''। যদি কেউ লেখে “সুসম্মাননীয় ব্যক্তিদের মাল্যদান করে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হল'' তাহলে বাক্যটি একটি সাধারণ বর্ণনা থেকে প্রশংসায় পর্যবসিত হয়। ভাবুন তো, এবার যদি কেউ লেখে, “অসম্মাননীয় ব্যক্তিদের মাল্যদান করে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হল'', চমকে উঠে ভাববেন তো, এটা আবার কি ধরণের বক্রোক্তি!। আবার যদি লেখা হয় “সম্মানীয় ব্যক্তিদের মাল্যদান করে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হল'', তাহলে কিন্তু অর্থ একেবারেই বদলায় না, কারণ এখনকার ভাষায় সম্মাননীয়র স্থলে সম্মানীয়ও চলে, যদিও ব্যাকরণের সূক্ষ্ম বিচারে সম্মানীয় শব্দটি ভুল।
তাহলে এখানে আমরা বানানের মধ্যে তিন ধরণের পরিবর্তনের দেখলাম- দু ধরনের পরিবর্তনে বাক্যটির অর্থ বদলাল, তৃতীয় ক্ষেত্রে বদলাল না।
মিউটেশন কি ক্ষতিকারক ?
ওপরের উদাহরণের জের টেনেই বলতে পারি, যে জিনের ভাষার পরিবর্তন অর্থাৎ মিউটেশনের জন্য মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক বিকার ঘটতে পারে। বাস্তব ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক বিকারের সম্ভাবনা আরও কম, তার কারণ প্রকৃতি যে ভাবে জিনের ভাষার অভিধান রচনা করেছে, সেখানে অনেক শব্দই আছে, যাদের একটু আধটু বানানের হেরফের হলে অর্থ বদলায় না। একটি শব্দের একটিই বানান, এধরণের শব্দের থেকে বানানের হেরফের চলে এরকম ধরণের শব্দের ব্যবহারই বেশি।(জিনের অভিধানে একটি বানানে একাধিক অর্থ এমন ঘটনা ঘটে না)। অর্থাৎ কিনা মানে বদলায় এমন মিউটেশনের সংখ্যা খুবই কম।
আরও পড়ুন:আবার সে এসেছে ফিরিয়া
লাভজনক বা ক্ষতিকারক মিউটেশন সংখ্যায় কম
অর্থ বদলায় এমন মিউটেশন অর্থাৎ লাভজনক বা ক্ষতিকারক মিউটেশন সংখ্যায় কম হলেও হয়। দুটি উদাহরণ দিই: সিকল সেল অ্যানেমিয়া একটি রোগ, যেখানে রক্ত কণিকাটি গোল না হয়ে কাস্তের মতো আকারের, এই লোহিত কণিকাগুলি খুব সহজে ভেঙে গিয়ে অ্যানেমিয়া অর্থাৎ রক্তাল্পতার সৃষ্টি করে। জিনের ভাষায় হিমোগ্লোবিনের মধ্যে মাত্র একটি অক্ষরের পরিবর্তন তাতেই বিশাল ক্ষতি। আবার প্রয়াত প্রখ্যাত অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলরের অত্যধিক ঘন আঁখিপল্লবের পিছনেও আছে একটি মিউটেশন।
প্রকৃতির বেশির ভাগ সম্পর্ক যেমন খাদ্য খাদকের, লাভজনক বা ক্ষতিকারক মিউটেশনের ভূমিকা সেখানে বিশাল। এই মিউটেশনগুলিই বিবর্তন আনে। বিবর্তন খাদ্যকে খাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। আবার খাদ্যের অভাব পড়লে খাদকের মধ্যে বিবর্তন ঘটে নতুন ধরণের খাদ্যাভ্যাস তৈরি করতে সাহায্য করে।
বিবর্তন আসতে বহু প্রজন্ম লাগে, জীবাণু-বিষাণুর প্রজন্ম এগোয় খুব তাড়াতাড়ি
বড় বা উন্নত প্রাণীদের ক্ষেত্রে বিবর্তন আসতে কয়েক যুগ অর্থাৎ অনেক প্রজন্ম কেটে যায়, কিন্তু জীবাণু বা বিষাণু (ভাইরাস) এর এক একটি প্রজন্ম কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা মাত্র, কাজেই তাদের বিবর্তন আসে অনেক তাড়াতাড়ি। কয়েক দিনের মধ্যেই নানা রকম নতুন মিউটেশন দেখা যেতে পারে, এবং তারা এই জীবাণু-বিষাণুর মধ্যে বিবর্তন আনতে পারে। এই পৃথিবীতে সবাই বাঁচতে চায়। কাজেই যখন ওষুধের প্রভাবে বা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রভাবে জীবাণু-বিষাণুরা কাবু হয়ে পড়ে, তখন প্রকৃতি তাদের সাহায্য করে মিউটেশন এনে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াতে বদল আনতে, যাতে তাদের নতুন নতুন প্রজন্ম ওষুধের মধ্যেও বাঁচতে পারে, বা প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্থাৎ ইমুনিটিকে ধোঁকা দিতে পারে। রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু-বিষাণুর বিবর্তন রোখার একটাই উপায়, এদের ছড়িয়ে পড়তে না দেওয়া। যত ছড়াবে, তত বংশবৃদ্ধি করবে, তত নতুন প্রজন্ম আসবে, এবং তত বিবর্তন হবে। ওষুধ ব্যবহার করে যদি এদের রোখা যায় তবে তখনই সেই ওষুধটা ব্যবহার করা উচিত, যেখানে পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে যে এই ওষুধটা কাজ করবেই। এই যে লোকে অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে ভাবে যে এতে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়া যাবে, এতে যে পৃথিবীর কি ক্ষতি হচ্ছে ভাবা যায় না। এই সব অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের শরীর থেকে বাইরের পরিবেশে ছড়িয়ে সেখানকার জীবাণু-বিষাণুকে ধীরে ধীরে আগে থেকেই সতর্ক করে দিচ্ছে। এরা আস্তে আস্তে ওষুধের মধ্যেও দিব্যি বাঁচতে শিখছে, যেটাকে বলা হয় ড্রাগ রেসিস্টেন্স। ওষুধের মধ্যে বাঁচতে পারা জীবাণু-বিষাণুরা কিন্তু আগামীদিনের একটা বড় সমস্যা। এমন দিন আসতে পারে যেদিন কোনও ওষুধই কাজ করবে না।
আরও পড়ুন: রসায়নে এবারের নোবেলজয়ীরা কি সত্যিই জিন-কাটা কাঁচির জনক?
Covid ভাইরাসের বিবর্তন
Covid-19 রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের কথায় আবার আসি। এদের মধ্যে সারাক্ষণ নানা মিউটেশন গজাচ্ছে। কেউ কেউ ধরা পড়ছে, অনেকগুলোই ধরা পড়ছে না। ভাইরাসের মিউটেশন ধরতে পারার একমাত্র পদ্ধতি হল সিকোয়েন্সিং (sequencing), এটি একটি অত্যন্ত জটিল এবং খরচ সাপেক্ষ পদ্ধতি। প্রতিটি covid রোগীর ক্ষেত্রে করার প্রশ্নই আসে না। সারা পৃথিবীর প্রতিটি এলাকায় আলাদা ভাবে প্রতি সপ্তাহে যদি অন্তত কিছু রোগীর সিকোয়েন্সিং করা যেত, তাহলেও বা কত রকম মিউটেশন হচ্ছে, কোন সময়ে, কোন এলাকায় কী মিউটেশন বেশি পাওয়া যাচ্ছে, তাদের কেউ বেশি ক্ষতিকর কিনা এই সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত। এই যে পাঁচটা প্রজাতির নাম মুখে মুখে ঘোরে এদের আবিষ্কার কিন্তু খুব বিচ্ছিন্ন। বিজ্ঞানীরা হাতের কাছে যা যা স্যাম্পল পেয়েছেন, তার থেকে এই মিউটেশনগুলোর সিকোয়েন্স, অর্থাৎ জিনের ভাষার বানানগুলি জানা গেছে, তার থেকে নামকরণ ইত্যাদি করা হয়েছে। এর থেকে কোনও মতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না যে মাত্র এই কটি মিউটেশনই Covid-19 রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের মধ্যে দেখা গেছে। শুধু মাত্র ভারতে যে পরিমাণ মানুষ covid-19এ আক্রান্ত হয়েছে তাতে ভারতেই নানা মিউটেশন সম্পন্ন বিভিন্ন প্রজাতি থাকার কথা। কিন্তু ভারতে সিকোয়েন্সিং হয়েছে যৎসামান্য, এবং তাতে ধরা পড়েছে শুধুমাত্র ডেল্টা প্রজাতি আর কিছু কিছু সাগরপার থেকে আমদানি প্রজাতি।
ওমিক্রন কি সত্যিই মারাত্মক ? এতে শুনছি 30টা মিউটেশন আছে!
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ওমিক্রন চিন্তার বিষয়। কিন্তু যেই "এটি কি বেশি ছোঁয়াচে? এটি কি বেশি মারাত্মক?' জাতীয় প্রশ্ন করা হয়, তখনই জবাব দেয় “এখনও জানা যায়নি।'' আপনাদের কি মনে পড়ছে, গত বছরেও ঠিক এই সময়ে UK স্ট্রেইন, ডেল্টা স্ট্রেইন ইত্যাদি নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, যে কারণে আমি মিউটেশন নিয়ে আমার লেখাটিতে বলেছিলাম যে মিউটেশন নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই, কিন্তু কোভিড নিয়ে সমস্ত সাবধানতা চালিয়ে যেতে হবে। কি আশ্চর্য! ঠিক এক বছর বাদে ঠিক এক কথারই পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে!
কথায় বলে, "The more the merrier!' হয়তো সেই ভেবেই বেশি মিউটেশন থাকলে বেশি মারাত্মক হতে পারে ধরে নেওয়া হচ্ছে কি? অঙ্ক কষে কিছু কিছু বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন বটে কোভিড ভাইরাসের অমুক অমুক জায়গার সিকোয়েন্স মানুষের শ্বাসনালীর কোষে আটকানোর জন্যে দায়ী, এবং সেই সেই জায়গায় মিউটেশন হলে আরও ক্ষতিকারক হতে পারে। কিন্তু সত্যটা এই যে কোভিড রোগ এবং কোভিড ভাইরাসের কর্মপদ্ধতি নিয়ে শত সহস্র তাত্ত্বিক গবেষণা হয়েছে, তার মধ্যে যৎসামান্যই পরীক্ষিত সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই আজ পর্যন্ত কোনও প্রমাণ নেই যে এতগুলো মিউটেশনের কারণেই ওমিক্রন বেশি মারাত্মক হবে। বিশ্বের সমস্ত জিনতত্ত্ববিদের একই মত। আসলে বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা কোভিডের শুরুর দিকে অনেক ভুল কথাই বলেছে বলে এখন হয়তো আর রিস্ক নিতে চায় না। সাবধানের মার নেই নীতিতে সতর্কবার্তা প্রচার করছে!
আরও পড়ুন: করোনা ভ্যাকসিনের রূপকথা আর বাস্তবতা
সেকেন্ড ওয়েভ কোন স্ট্রেইন ছড়িয়েছিল?
এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। গত বছরের মিউটেশন নিয়ে যে প্রাথমিক আতংক ছড়িয়েছিল, সেটা প্রায় উবে গিয়েছিল ভারতে এবছরের প্রথম দুটো মাসে। দৈনিক তখন সংক্রমণ নেমে এসেছিল 8-9 হাজারে। কিন্তু সংক্রমণ হার বা মৃত্যু হার কোনটাই শূন্যতে নামেনি। আর তারপরই আছড়ে পড়ল সেকেন্ড ওয়েভ। মে মাসের মৃত্যু মিছিল, কোন স্ট্রেইন, কোন ভ্যারিয়ান্ট, কেউ বলতে পারবে? জবাব আছে কারও কাছে?
তাহলে কী করা উচিত?
বরং আবারও বলব, আমদানি স্ট্রেইন, ওমিক্রন, এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
মাথায় কিন্তু রাখতেই হবে কোভিড যায়নি। এখনও সরকারি হিসেবে দিনে ন'হাজার আক্রান্ত। সাধারণ জ্বরজারি-সর্দিকাশি ধরে নিয়ে টেস্ট করানো হয়নি এমন কেস নিশ্চয়ই আরও অনেক বেশি, এবং তারা নিঃশব্দে ছোঁয়াচ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। খুব সম্প্রতি, ভারতে ওমিক্রন ঢোকার আগে, দিল্লিতে এক মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন ওপর মহলের বিজ্ঞানী কোভিডে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এদের সবাই বহুদিন আগেই ভ্যাকসিনের দুটো ডোজই নিয়েছেন। অর্থাৎ যেমন বলা হয়েছিল, ভ্যাকসিন কিন্তু কোভিড রোগ আটকাবে না, মৃত্যুহার কমাতে পারে। বুস্টার অর্থাৎ তৃতীয় ডোজের প্রয়োজন আছে কি? হয়তো আছে। দিয়েই দেখা যাক না- ক্ষতি তো হবে না! আর মাস্ক? জনসমক্ষে ওটা নাক মুখ দিয়ে ভাইরাস ঢোকা আটকাতে পরতেই হবে। জানি না কবে বলতে পারব “ওটার দরকার নেই।”
(ড: সুস্মিতা ঘোষ ডায়াগনোরাইট-এর প্রতিষ্ঠাত্রী এবং জৈব-রসায়নবিদ। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের প্রাক্তন পোস্ট ডক্টরাল ফেলো। সুস্মিতার ডায়াগনোরাইট একটি সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত স্টার্ট-আপ সংস্থা, যার লক্ষ্য সকলের জন্য সুলভে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ডায়গনস্টিক্স।)
ভাইরাসের মিউটেশন স্বাভাবিক ঘটনা, ওমিক্রন নিয়ে অযথা আতঙ্কের কিছু নেই।