×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • লকডাউন দমাতে পারেনি শিল্পীর উদ্ভাবনী শক্তি

    গোপা সেনগুপ্ত | 27-05-2020

    বেঁচে থাকার অস্ত্র: বাড়িতে তৈরি ডাবিং বুথ

    শিল্পীদের প্রতিদিন পরীক্ষা দিতে হয়। শিল্পীদের সংসারও চালাতে হয়। পরীক্ষা নেন দর্শকরা। তাঁদের সামনে, Front Of House (FOH) সেই পরীক্ষায় নামার চ্যালেঞ্জই শিল্পীর অক্সিজেন। আবার মঞ্চ থেকে নেমে এসে সোশাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে মাসকাবারি বাজারের লাইনেও দাঁড়াতে হয় সেই একই শিল্পীকে। কেমন করে বাঁচছি আমরা?

     

    কাল হোয়াটস্যাপ খুলে দেখি আমার এক বন্ধু একটা কবিতা পাঠিয়েছে। লেখিকার নাম সুমনা (পদবি দেওয়া নেই)। কবিতাটা এইরকম:

              MISSING YOU

    কেমন আছ মঞ্চরা? কার্টেন?
    First wing's, second wings?
    Follow, FOH, dimmer?
    কেমন আছ সাজঘর?

     

    মনে মনে বললাম, এ তো আমার কথা। আমিও তো লাইট, সাউন্ড, ক্যামেরা, অ্যাকশন শোনার অপেক্ষায় বা স্টেজের ফুটলাইট, উইংস, পর্দার ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য ছটফট করছি। কখনও মোবাইলের কোনও অ্যাপ থেকে নিজের অভিনয় দেখে ঘন ঘন মাথা নাড়ছি, না হয়নি, কিছুই হয়নি। ওটা ওইভাবে বলা উচিত ছিল। কখনও আবার একটা সংলাপ নিয়ে সারাদিন ধরে মনের মধ্যে লোফালুফি খেলছি। তবু, অভিনয় না করার আকুতিটা ভুলতে পারছি না।

     

    এইসব কথা হচ্ছিল শিল্পীদের নিয়ে গড়া ‘আমরা শিল্পী’ হোয়াটস্যাপ গ্রুপে। কথায় কথায় পার্থ মিত্র বললেন, “আমরা এই লকডাউনের সময়টা কাজে লাগাতে পারি।” স্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে দেওয়া হবে। যে যার ঘরে বসে মোবাইলে সেটা ভয়েস রেকর্ড করে পাঠিয়ে দেবে পার্থকে। পার্থ সেটাকে এডিট করে, মিউজিক বসিয়ে, প্রয়োজনীয় ছবি বসিয়ে গ্রুপে পেশ করবে। কাজ চলল তরতরিয়ে। নানান জন নানান শ্রুতিনাটক পেশ করল। এভাবেই শর্টফিল্মও তৈরি হতে লাগল। কী উৎসাহ সকলের মনে। মন বলল কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিই শিল্পীসত্ত্বাকে থামিয়ে দিতে পারে না। সে সৃষ্টি করবেই। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সে সৃষ্টির পথ খুঁজে নেবে।


    এ তো গেল আবেগের দিক। কিন্তু আরও একটা দিক আছে, যা না হলে শিল্পী বাঁচে না। সেটা শিল্পীর রোজগারের দিক, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির শিল্পীদের মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়:


    (১) পরিচিত মুখের শিল্পী, এঁদের অনেকে অত্যন্ত দক্ষ শিল্পী। অনেকের আবার দক্ষতা নেই, কিন্তু গ্ল্যামার আছে। এঁরা প্রায় প্রতিদিনই কাজ পান। এঁদের মোটা রোজগার। 


    (২) তারপর আসেন যাঁরা তাঁদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলে ‘টকি আর্টিস্ট'। এঁরা অনেকেই দক্ষ শিল্পী, দীর্ঘদিন মঞ্চে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা এঁদের আছে। কিন্তু এঁরা সব সময় কাজ পান না। বয়স বাড়লে কাজ আরও কমে যায়। এঁদের কাজের রোজও তেমন বেশি নয়। লকডাউনের এই দীর্ঘ সময়ে তাঁদের কোনও রোজগার নেই। তবে আর্টিস্ট ফোরাম সাধ্যমত তাঁদের আর্থিক সাহায্য করেছে। ভবিষ্যতের কোনও দিশা নেই এঁদের। No work no pay ব্যবস্থায় এঁদের কাজ করতে হয়। তিন হাজারের বেশি শিল্পী ‘আর্টিস্ট ফোরামে'র সদস্য। লকডাউনের পর প্রত্যেকেই যে কাজ পাবে তা নয়। তার উপর সামান্য টাকায় এঁরা কাজ করে থাকে। ফলে সংসার ধুঁকছে, ভবিষ্যৎ অন্ধকার। 


    (৩) তৃতীয় হলেন জুনিয়র আর্টিস্ট। সবার থেকে করুণ অবস্থা এই জুনিয়র আর্টিস্টদের। স্বাভাবিক অবস্থায় তাঁরা ফড়েদের মাধ্যমে দিন প্রতি 150/200 টাকায় কাজ পান। তবে, প্রতিদিন যে কাজ পাবেনই, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। অনেক জুনিয়র আর্টিস্ট এই পয়সায় সংসার চালান। ভাবছি, লকডাউনের সময়টাতে তারা বেঁচে আছে কীভাবে? এঁদের নালিশ জানাবার কোনও জায়গা নেই, কারণ এঁদের কোনও ইউনিয়ন নেই। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির করোনা যুদ্ধে এঁরা সামনের সারির সৈনিক। ফলে ক্ষয়ক্ষতি এখানে বেশি হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক ।


    এবার অভিনয়ের আর একটি দিকের প্রসঙ্গে কথা বলি। ডাবিং ও ভয়েস ওভার চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এদের প্রত্যেক এপিসোডে আয় অত্যন্ত অল্প। বিজ্ঞাপনের কাজে টাকাটা খানিকটা বেশি। মুম্বইয়ের ক্ষেত্রে চেহারাটা কিন্তু আলাদা। ওইখানে ডাবিং শিল্পীদের পারিশ্রমিক অনেক বেশি। কিন্তু বাংলার শিল্পীরা দক্ষ হলেও, সস্তার শিল্পী। এঁদের কোনও ইউনিয়ন এতদিন ছিল না। সম্প্রতি এঁরা একজোট হয়ে ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ ভয়েসওভার আর্টিস্ট ট্রানস্ক্রিপ্টারস এ্যান্ড সাউন্ড রি-রেকর্ডিস্ট অফ কলকাতা' নামে একটি সংগঠনের জন্ম দিয়েছেন, যার সংক্ষিপ্ত নাম ‘অভতার'। অর্থাৎ, এঁদের সঙ্গে ট্রান্সলেটর ও রি-রেকর্ডিস্টরাও আছেন। ‘অভতার' এঁদের পারিশ্রমিক ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে। একেই পারিশ্রমিক কম, তায় আবার লকডাউনে কাজ একেবারেই বন্ধ। ‘ত্রাহি মধুসূদন' অবস্হা। আগেই বলেছি, শিল্পী বিরূপ অবস্থাতেও সৃষ্টির পথ খুঁজে নেয়। এক্ষেত্রেও তাই হল। k77 নামে এক স্টুডিও জানাল, ঘরে বসে ডাবিং করার একটা পদ্ধতি পেয়েছে তারা। কী সেই পদ্ধতি?


    বানিয়ে ফেলা হল ডাবিং বুথ। পিসবোর্ড, পিভিসি পাইপ, মোটা পর্দার কাপড় দিয়ে তৈরি হল সেই বুথ। বুথটি সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা যাবে। বুথের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে দুটি অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সাহায্যে কাজটা করতে হবে। একটি ফোনে দৃশ্যটা দেখা যাবে, আর একটি ফোনে ডাবিংটা করা হবে। ডাবিং বুথের পিছন দিকটা খোলা। সেইদিক দিয়ে যাতে শব্দ না ঢোকে, সেইজন্য কম্বল বা মোটা কাপড় চাপা দিয়ে নিতে হবে। তাছাড়া, অভিনয় করার সময় ফোনের মাইক্রোফোনটা কীভাবে ধরলে কোনও অবাঞ্ছিত শব্দ আসবে না, সেটা বোঝাও বেশ কঠিন। মানে, ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু, ট্রায়াল অ্যান্ড এরর করতে করতে আমরা সব ডাবাররা হয়ত এই ব্যাপারে পরিপক্ক হয়ে উঠব। তখন ঘরে বসেই আমরা ডাবিং করতে পারব। তখন করোনা আমাদের রোজগার বন্ধ করতে পারবে না। শিল্পী তার সৃষ্টির রসদ এমনি করেই জোগাড় করে নেয়। প্রত্যেক শিল্পধারাই এই অবস্থায় বোধ হয় সেই পথ খুঁজে নিচ্ছে। এই আমার বিশ্বাস। তাকে কেউ থামাতে পারেনা। লেখক এস ওয়াজেদ আলির কথায় বলা যায়, ‘সেই ট্রেডিশন সমানে চলেছে।' ভবিষ্যতেও চলবে।

     


    গোপা সেনগুপ্ত - এর অন্যান্য লেখা


    শিল্পী তার সৃষ্টির রসদ যেকোনও পরিস্থিতিতেই জোগাড় করে নেয়।

    লকডাউন দমাতে পারেনি শিল্পীর উদ্ভাবনী শক্তি-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested