×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • ল্যাবরেটরির বাইরে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা

    গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় | 09-08-2022

    ল্যাবরেটরির বাইরে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা

    মেঘনাদ সাহার নাম আমরা সবাই শুনেছি, বাঙালী বিজ্ঞানী বলতে জগদীশচন্দ্র ও সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে একসঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারণ হয়। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সী যুবক যে সমীকরণ আবিষ্কার করেছিল, তা জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা বা অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। পুরস্কার না পেলেও কোনও এক বছরে নোবেল পুরস্কারের জন্য তিনজনের শর্টলিস্টের অন্যতম নামটি ছিল মেঘনাদ সাহা। তিনিই আবার ছিলেন মানুষের উন্নতির জন্য সদাসচেষ্ট বিজ্ঞানী, স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত দেশপ্রেমিক, এবং স্বাধীন দেশের লোকসভাতে নির্বাচিত সাংসদ। মেঘনাদ আমাদের দেশের বিজ্ঞানের ইতিহাসে একক; জাতিবিভক্ত সমাজের নিচুতলার এক হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে শুধুমাত্র নিজের প্রতিভা ও চেষ্টাতে বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলের প্রথম সারিতে স্থান করে নেওয়ার উদাহরণ আর একটিও পাওয়া যাবে না। দেশপ্রেমের দীক্ষা তিনি নিয়েছিলেন বাঘা যতীন ও পুলিনবিহারী দাশের কাছ থেকে; দেশের মানুষের জন্য কাজ করার প্রেরণা তাঁকে জুগিয়েছিলেন তাঁর শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র।

    নিজের গ্রামে স্কুল ছিল না, দারিদ্রের জন্য তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। যখন সামর্থ্য হয়েছে, সেখানে নিজের মায়ের নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেননিজের বাড়িতে দুঃস্থ ছাত্রদের রেখে পড়াশোনা করিয়েছেন। দারিদ্রকে তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে, বুঝেছেন এই বিশাল দেশের অভুক্ত জনগণের উন্নতিতে প্রয়োজন ভারি শিল্প। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় তিনি দেখেছেন কংগ্রেস নেতা কৈলাসনাথ কাটজু একটি দেশলাই তৈরির কারখানার দ্বারোদ্ঘাটন করে দেশ শিল্পের পথে এগিয়ে চলেছে বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন। কালবিলম্ব না করে কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্রকে দিয়ে তৈরি করিয়েছিলেন জাতীয় প্ল্যানিং কমিটি, যা আমাদের দেশের অধুনালুপ্ত প্ল্যানিং কমিশনের পূর্বসূরী। গান্ধীজির  চরকা ও ক্ষুদ্র শিল্প নীতির বিরুদ্ধে দঁড়িয়ে তাঁর সেই প্রয়াস সাফল্য পায়নি। তবে হাল তিনি ছাড়েননি, স্বাধীন দেশের প্রথম লোকসভার নির্বাচনে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থীকে পরাজিত করে সংসদে গেছেন, সেখানেও তাঁর মতকে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন। অকাল মৃত্যু তাঁর সেই সংগ্রামে ছেদ টেনে দিয়েছিল। একই সঙ্গে ক্যালেন্ডার সংস্কার কমিটির হাল ধরেছিলেন, তৈরি করেছিলেন এক বিজ্ঞানভিত্তিক নতুন ক্যালেন্ডার বা রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ। পরিহাস এই যে ভারত সরকার তা গ্রহণ করেছে, কিন্তু মেনে চলার প্রয়োজন বোধ করেনি।

    বিধ্বংসী বন্যার সময় প্রফুল্লচন্দ্রকে সামনে রেখে ত্রাণ ও উদ্ধারের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই সময়েই তিনি বন্যার কারণ ও তার থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধিকে ব্যবহার করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে একের পর এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন দামোদর উপত্যকার বন্যা সম্পর্কে, এর ফলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণের দাবি উঠে আসে এবং শেষপর্যন্ত ১৯৪৩ সালে বিদেশী সরকার এক কমিটি তৈরি করেনমেঘনাদ হয়েছিলেন তার সদস্যএই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে দামোদর ভ্যালি প্রকল্প রূপায়িত হয়েছিলদুর্ভাগ্যবশত মেঘনাদের অনেকগুলি সুপারিশ শেষপর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি, তার কুফল আমরা আজ পর্যন্ত ভোগ করছি

    জাতিবিভক্ত হিন্দু সমাজে উচ্চবর্ণের বিদ্রূপের শিকার হয়েছেন মেঘনাদ, হিন্দু হস্টেলে অন্যদের সঙ্গে  পংক্তিভোজনের অধিকার তাঁর ছিল না। ছাত্রজীবনে নিজের নাম নিজে রেখেছিলেন মধুসূদনের অমর কাব্যের বিদ্রোহী চরিত্রের নামে, স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন এই সমাজের প্রতি মনোভাব। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলেন প্রাচীন শাস্ত্রের প্রতি যুক্তিহীন আনুগত্য দেশের বিজ্ঞান তথা সমাজের উন্নতির পথে অন্তরায়, এবং সে কথা প্রকাশ্যে বলে প্রাচীনপন্থীদের রোষের মুখে পড়েছেন, কিন্তু পিছিয়ে আসেননি। তাঁর ব্যঙ্গোক্তি 'সবই ব্যাদে আছে' এখন প্রবাদবাক্যে পরিণত। সেই খরশান বিদ্রূপের চাবুকধারী মানুষটিকে আমাদের এখন বেশি প্রয়োজন ছিল।

    বিজ্ঞানপ্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের উন্নতির পথ খুঁজেছিলেন মেঘনাদ, হয়তো আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা বলব যে তিনি বিজ্ঞানের উপরে একটু বেশিই আস্থা রেখেছিলেন। সেই প্রয়াস তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল জওহরলাল নেহরুর কাছে। কিন্তু সেই নৈকট্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, স্বাধীনতার আগেই বিজ্ঞান বিষয়ে নীতির জন্য হোমি ভাবার উপর নির্ভর করতে শুরু করেন নেহরু। মাটিতে পা দিয়ে চলা মেঘনাদ নিউক্লিয় বিজ্ঞানকে যখন চিকিৎসার কাজে লাগানোর জন্য চেষ্টা করছেন, তখন ভাবা পরমাণু বিদ্যুতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। দুজনের মতবিরোধে দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ নিউক্লিয় পদার্থবিদ সাহাকে ছাড়াই তৈরি হয়েছিল অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন। ভাবার সেই স্বপ্ন অবশ্যই আজ সার্থক, কিন্তু তার জন্য দুই দশকেরও বেশি সময় লেগে গিয়েছিল। ভারত যখন প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎ তৈরি করেছিল, তখন নেহরু, মেঘনাদ বা ভাভা কেউই জীবিত ছিলেন না।

    বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নেহরুর স্বপ্নের Temples of Modern India রূপায়িত হয়েছিল কিছু কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের মাধ্যমে, বঞ্চিত হয়েছিল দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। মেঘনাদের তীব্র আপত্তি অরণ্যে রোদন রয়ে গিয়েছিল। হয়তো সেই সময় দরিদ্র দেশের অন্য কোনও পথ ছিল না, কিন্তু যা ছিল আপৎকালীন ব্যবস্থা, তাই পরে হয়ে দাঁড়াল নিয়ম। ফলে আমরা এমন এক বিজ্ঞান গবেষণার পথ বেছে নিয়েছি যেখানে ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশের সঙ্গে দেশের সেরা বিজ্ঞানীদের কোনও যোগাযোগ হয় না। বিজ্ঞানশিক্ষা থেকে গবেষণাকে বিচ্ছিন্ন করার এই নীতি কোনও উন্নত দেশ অনুসরণ করে না; অনেক শিক্ষাবিদের মতেই মেঘনাদের পথ না ধরা আমাদের দেশের বিজ্ঞানচর্চার মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়েছে।

    বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সফল মেঘনাদ হয়তো ল্যাবরেটরির বাইরে তাঁর প্রিয় চরিত্র মেঘনাদের মতোই ট্র্যাজেডির নায়ক।

    #AzadiKaAmritMahotsav #HarGharTiranga #MeghnadSaha


    গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় - এর অন্যান্য লেখা


    বিশ্বমানের বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি মেঘনাদ পীড়িত মানুষের হয়ে লড়াইয়ের জন্য প্রথম লোকসভায় বামপন্থী

    ল্যাবরেটরির বাইরে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested