একটি পূর্ণবয়স্ক দেখতে মানুষ। লম্বা-চওড়া দেহের গড়ন, যেমনটি হয়ে থাকে। কিন্তু সে কথা বলে, কাজ করে একজন বাচ্চার মতো। তাহলে, বলতে হবে সেই ব্যক্তির বৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু বিকাশ হয়নি। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং বিকাশ (উন্নয়নও বলা যেতে পারে)-এর মধ্যে অর্থনীতি খুব পরিষ্কার করে সীমারেখা অঙ্কন করেছে। একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের জনপ্রতি দ্রব্য-সামগ্রী ও পরিষেবার প্রকৃত মূল্য বৃদ্ধিকেই বলা হয় অর্থনৈতিক বৃদ্ধি। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক বিকাশ বলতে বোঝায়, একটি নির্দিষ্ট সময় একটি দেশের মানুষের জীবনধারণের মানোন্নয়নকে। মানবদেহের উচ্চতা বাড়লে, ওজন বাড়লে বলা হয় দেহের বৃদ্ধি হয়েছে। অর্থাৎ, উচ্চতা, ওজন এগুলো হলো বৃদ্ধির সূচক। ঠিক তেমনই অর্থনীতিতে আয় বা মাথাপিছু আয় হল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রধান সূচক। আবার, মানুষের বিকাশ বোঝার জন্য অন্য বিভিন্নরকমের নির্ধারক আছে, যেমন, বুদ্ধ্যঙ্ক (IQ) অথবা আবেগের পরিণতির সূচক। তেমনই অর্থনীতিতে উন্নয়ন বা বিকাশ বলতে জীবনধারণের মানোন্নয়নের বিভিন্ন সূচক, যেমন- শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, মানবদেহের প্রত্যাশিত আয়ু বৃদ্ধি ইত্যাদিকে নির্দেশ করে।
অর্থনীতির উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে মাথাপিছু আয় হল সকলের আয় যোগ করে তাকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে যা বের হয় তাই। এর থেকে সামগ্রিকভাবে ওই জনসমষ্টি সম্পর্কে ধারণা করা গেলেও কোনও ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা জানা যায় না। অথচ বাস্তবে সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য – কারণ ব্যক্তি খেতে পরতে পাচ্ছে কিনা, তার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা আছে কিনা ইত্যাদি সবই নির্ভর করে তার নিজের আয়ের উপর, গড়ের উপর নয়।
প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের স্লোগান হল ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’। আমাদের দেশে নাগরিকদের মধ্যে আয় এবং সম্পদের যে বিপুল বৈষম্য রয়েছে, তাতে কিন্তু এই স্লোগানটি প্রায় হাস্যকর বলে মনে হতে পারে। ভারতের আর্থিক উন্নতির হার অন্য উন্নত দেশের তুলনায় খুব একটা কম নয়। 2015 থেকে 2019 সালের মধ্যে ভারতের জিডিপি গ্ৰোথ 5 থেকে 8 শতাংশের মধ্যে, যা অনেক উন্নত দেশের থেকে বেশি। কিন্তু উন্নয়নের বিভিন্ন মাপকাঠিতে ভারতের অবস্থা কেমন তা দেখার প্রয়োজন রয়েছে। গত দুই দশকে অসাম্যের হার ভারতে প্রচণ্ড বেশি। অধ্যাপক টমাস পিকেটি তাঁর 'Capital in the 21st century' গ্ৰন্থে দেখিয়েছেন, ভারতের আর্থিক বৈষম্য 96 বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি! আবার 2017 সালে ক্রেডিট সুইস সংস্থা থেকে প্রকাশিত গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের সবচেয়ে বিত্তশালী পরিবারটিকে প্রথমে রেখে অন্য পরিবারগুলোকে সম্পদের ভিত্তিতে ক্রমানুসারে সাজালে দেখা যাবে, 2002 থেকে 2012 সাল পর্যন্ত এই ক্রমবিন্যাসের প্রথম 1 শতাংশ পরিবারের সম্পদ দেশের মোট সম্পদের 15.7 শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে 25.7 শতাংশ। আর শেষ 50 শতাংশ পরিবারের সম্পদ মোট সম্পদের 8.1 শতাংশ থেকে কমে হয়েছে 4.2 শতাংশ। কতটা ভয়ানক আয়-বৈষম্য, তা এই তথ্য থেকে খুব সহজেই অনুধাবনযোগ্য। বর্তমানে এই অসাম্য তো কমেইনি, বরং আরও বাড়ছে। 2018-19 সালে অক্সফ্যাম তুলে ধরল দেশে অসাম্যের এক নিদারুণ ছবি, মাত্র 1 শতাংশ মানুষের কাছে থাকা সম্পদ দরিদ্র 70 শতাংশ মানুষের মোট সম্পদের সমতুল।
আর এত বেশি আয় বৈষম্য যে দেশে, সেখানে তো গরিব তার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেই। আর তার প্রতিফলন ঘটেছে Social Mobility Index-এ (সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনও ব্যক্তি বা পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা কতটা বদলাল, এই সূচক সেটাই মাপে। এই সূচক অনুসারে 82টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান 76 নম্বরে! IIM Indore-এর অধ্যাপক পুনরজিৎ রায়চৌধুরী গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ‘গোটা ভারতের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার চোখে পড়ার মতো কম। 7-8 বছরের সময়কালে 10টি দরিদ্র পরিবারের মধ্যে অন্তত 7টি হয় দারিদ্রসীমা পেরোতে পারে না, নয়তো সীমা পেরোলেও অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল থেকে যায়। এবং 10টির মধ্যে খুব বেশি হলে 2টি পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে সুরক্ষিত হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক ভাবে সুরক্ষিত 10টি পরিবারের মধ্যে খুব বেশি হলে 2টি পরিবারের দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।'
অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান একজন মানুষের সুস্থ জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন। আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে বাস করছি যেখানে, রোজ প্রায় 15 জন মানুষ প্রতিদিন না খেয়ে থাকেন। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে প্রতি বছরই প্রায় এই দেশের ক্ষুধা নিবৃত্তির ব্যর্থতার করুণ কাহিনী প্রকাশ পাচ্ছে। আবার, অন্যদিকে, বিশ্বের অসুখী দেশগুলোর মধ্যেও স্থান করে নিচ্ছে আমাদের দেশ। এদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় 70 বছর, যা জাপান বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় 10 বছর কম। ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভূটানের গড় আয়ু বেশ কিছুটা বেশি। অন্যদিকে, এদেশে শিশুমৃত্যুর হার প্রায় 7.4 শতাংশ এবং বিগত কয়েক বছরে তা ক্রমবর্ধমান। ভারতের শিক্ষার হার 78 শতাংশ, যা অল্প হলেও আশা জাগায়। কিন্তু পুরুষদের শিক্ষার হার মহিলাদের তুলনায় বেশ কিছুটা বেশি। একটি রিপোর্ট থেকে এটাও দেখা যাচ্ছে যে, ভারতের গ্রামীণ অঞ্চলে 4 শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে 23 শতাংশ বাড়িতে কম্পিউটার আছে। এই মহামারীর পরিস্থিতিতে অনলাইনে পড়াশোনার যে হিড়িক পড়েছে, এবং নতুন শিক্ষানীতিতে অনলাইন পড়াশোনা এবং কোডিডকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া— এই দু'য়েরই মিলিত ফল হিসাবে পাওয়া যাবে বর্ধিত বৈষম্য। শিক্ষার বৈষম্য। যা পরবর্তীকালে, আয়ের বৈষম্যকে আরও প্রকট করবে।
এই বৈষম্যের অবসান ঘটানোর জন্য যা যা করা দরকার, সেই বিষয়ে কিন্তু সরকার কারও পরামর্শ শুনতে নারাজ। করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন সাধারণ মানুষের দুর্দশা লাঘবের জন্য অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ ছিল, মানুষের হাতে সরাসরি নগদ টাকা দেওয়া- যাতে তাদের অভাব মেটে এবং একইসঙ্গে অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। সরকার কিন্তু সে কথা শোনেনি। কেন্দ্রের ঘোষণা করা নীতিগুলো আদৌ কি মানুষের প্রয়োজন পূরণ করতে পারছে? এই বিষয়ে কোনও সমালোচনা বা পরামর্শই শুনতে রাজি নয় সরকার পক্ষ। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ় বলেছেন, ‘সারা পৃথিবীতেই স্বৈরাচারী শাসকেরা কারও কথা কানে তোলা পছন্দ করেন না। বিশ্বাস করেন বিভাজনের রাজনীতিতে।' তাঁর কথায়,শাসক সুযোগ পেলেই দোষ চাপিয়ে দেন দেশের মধ্যের বা বাইরের কোনও ‘গুরুতর শত্রু’-র কাঁধে এবং নিজের সমস্ত দায় কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। ঠিক এই জিনিসটা ভারতেও আমরা প্রত্যক্ষ করি। আমরা দেখি দেশের অর্থনীতিতে যখন ঝিমানো অবস্থা চলছে এবং মানুষ অর্থনৈতিক চাপে জর্জরিত, তখনই বিদেশি শত্রুর দিকে বারবার আঙুল তোলা হয়, যেন পেঁয়াজের কেজি একশো টাকা হওয়ার পিছনে বিদেশি হাত আছে। তখনই বোঝা যায়,"সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ স্লোগানের মধ্যে ‘সব কা সাথ’ কথার কথা মাত্র। ওটা আসলে একটি কল্পকাহিনি, ফিকশন, টিভির সিরিয়ালের মতো। সত্যি বলে ভুল করার কোনও মানে হয় না!
তখনই বোঝা যায়,’সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ স্লোগানের মধ্যে ‘সব কা সাথ’ কথার কথা মাত্র।