×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • সাহিত্যের বিশ্বপথিক মানবেন্দ্র

    সৌভিক ঘোষাল | 05-08-2020

    চলে গেলেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তুলনামূলক সাহিত্যের অসামান্য অধ্যাপক, ছক ভাঙা অনন্য অনুবাদক। সাহিত্যপ্রেমী বাঙালি পাঠকেরা সকলেই তাঁকে চেনেন বাংলার অন্যতম বিশিষ্ট অনুবাদক হিসেবে। ইউরো-আমেরিকান সাহিত্যের বাইরে তাকানোর চোখ তৈরি করার ক্ষেত্রে তাঁর নিরলস প্রয়াসের কথাও বুধজনেরা জানেন। লাতিন আমেরিকান সাহিত্য, আফ্রিকান সাহিত্য প্রভৃতির অনুবাদ, টীকা ইত্যাদি সহযোগে তৃতীয় দুনিয়ার সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য। এইসব অনুবাদকর্ম ছিল তাঁর নিজস্ব প্রগতিশীল রাজনীতি ভাবনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ইউরো-আমেরিকান সাহিত্যের মধ্যে দিয়েই কেবল বাইরের জগৎকে চেনা যে মূলত আমাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, আর মননের শৃঙ্খল ভাঙার জন্য যে সচেতনভাবে এই গণ্ডি পার হওয়া দরকার, সে কথা তিনি বারবার বলতেন।

     

     

    গার্সিয়া মার্কেজ, বরিস পাস্তেরনাক, জুলে ভার্ন, এডগার অ্যালান পো প্রমুখ সুপরিচিত সাহিত্যিকদের লেখা অনুবাদের পাশাপাশি তাঁর অনুবাদের মাধ্যমেই অধিকাংশ বাঙালি পাঠক জেনেছে আলেহো কার্পেন্তিয়ের, হুয়ান রুলফো, সেসার ভায়েহো, ভাসকো পোপা, নিকানোর পাররার, চেসোয়াভ মিউজ, ডেরেক ওয়ালকট সহ আরও অনেক অনেক সাহিত্যিককে।

     

    যশস্বী অধ্যাপক বা অনুবাদক পরিচয়ের বাইরে তিনি ছিলেন বিশিষ্ট কবিও। ক্রীড়া সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর মুন্সিয়ানা ছিল। রবীন্দ্রনাথের কিশোর সাহিত্যকে নানাদিক থেকে বিশ্লেষণ করে তাঁর লেখা বইটি অনেক নতুন চিন্তার সন্ধান দেয় আমাদের। ভারতের নানা ভাষার গল্পর পাঁচখণ্ডের একটি সংকলনের সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। অনুবাদ করেছিলেন বিখ্যাত মালয়লাম লেখক ভৈকম মুহম্মদ বশীরের অনেকগুলি ছোটগল্প। দেশ দুনিয়ার কিশোর সাহিত্যের অনুবাদ ও সংকলন প্রকাশের মধ্যে দিয়ে বাঙালি শিশু কিশোরদের মনকে প্রথম থেকেই সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তর দিকে মেলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর নিরলস প্রয়াসের জন্যও তিনি আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

     

     

    মানববাবু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য পড়তে আসার আগে ছিলেন ভূতত্ত্বের মেধাবী ছাত্র। বুদ্ধদেব বসু প্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের আকর্ষণ এমনই ছিল যে, বিভিন্ন বিষয় থেকে সেখানে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসত। বুদ্ধদেব বসু ছাড়াও সেখানে মাস্টারমশাই হিসেবে ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নরেশ গুহ, ফাদার আঁতোয়ান প্রমুখরা। পরে মানববাবু নিজে, অমিয় দেব, নবনীতা দেবসেন প্রমুখরা সেখানে যুক্ত হন। আরও পরে যুক্ত হন শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়। এনাদের ক্লাসের খ্যাতি এমনই ছড়িয়ে পড়ে যে, যাদবপুরের নানা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা চলে আসতেন তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র না হয়েও। বিভাগে ছিল খোলামেলা পরিবেশ। ক্লাস করার ক্ষেত্রে কোনও বাধা আসত না। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ষাটোর্ধ্ব বাদল সরকার এই বিভাগের নিয়মিত ছাত্র হয়েছিলেন রীতিমত পরীক্ষা দিয়ে। তিনি যখন ছাত্র, তখন পাঠক্রমে আবার রয়েছে তাঁরই লেখা নাটক। এরকম অনেক আশ্চর্য ঘটনা প্রায়ই ঘটত এই বিভাগে।

     

    যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের পাঠক্রমের মধ্যে দেশ কালের কোনও গণ্ডি ছিল না। পাশাপাশি পড়া হত রামায়ণ ও ইনিড, অভিজ্ঞান শকুন্তলম ও ইডিপাস রেক্স, মহাভারত ও দন কিহোতে। আফ্রিকার সাহিত্য, লাতিন আমেরিকার সাহিত্য, পূর্ব ইউরোপের সাহিত্য, বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য এসবের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকানোর ব্যবস্থা ছিল এরিয়া স্টাডিজের বিশেষ পাঠে। ইউরো-আমেরিকান সাহিত্যের বাইরে তাকানোর জন্য যে পরিচিতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ অর্জন করেছিল, তার অনেকটাই কৃতিত্ব মানববাবুর। তাঁর অনুবাদকর্মগুলির দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি বিশ্ব সাহিত্যের অচেনা, অল্পচেনা রত্নগুলিকে নিরলস অনুবাদকর্মের মধ্যে দিয়ে কী কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠায় তিনি নিয়ে এসেছিলেন বাঙালি পাঠকের জন্য। শুধু অনুবাদই তিনি করেননি। বইগুলির মধ্যে যে ভূমিকা, ভাষ্য, টীকা-টিপ্পনি আমরা পাই, সেসবও আমাদের সাহিত্যের জানা-বোঝার জগৎকে অনেকটা বিস্তৃত করে দেয়।

     

    লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের অনুবাদের কথাই ভাবা যাক। 1960 ও 70-এর দশকে কয়েকজন তরুণ লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিকের লেখা ইউরো-আমেরিকান জগতে বিশেষ সাড়া ফেলে। এই সাড়ার সূত্রে অব্যবহিত আগের পর্বের লেখকেরাও বৃহত্তর পরিধিতে পঠিত হতে থাকেন। সব মিলিয়ে এই পর্বটাকে লাতিন আমেরিকান বুম হিসেবে অভিহিত করা হয়। অব্যবহিত আগের লেখকদের মধ্যে ছিলেন বোর্হেস (আর্জেন্টিনা), মিগুয়েল আস্তুরিয়াস (গুয়েতেমালা), আলেহো কার্পেন্তিয়ের (কিউবা), হুয়ান রুলফো (মেক্সিকো) প্রমুখ। আর লাতিন আমেরিকান বুম এর তরুণ লেখকদের মধ্যে ছিলেন হুলিও কোর্তাজার (আর্জেন্টিনা), কার্লোস ফুয়েন্তেস (মেক্সিকো), গার্সিয়া মার্কেজ (কলম্বিয়া), মারিও ভার্গাস ইয়োসা (পেরু)।

     

     

    গার্সিয়া মার্কেজ-এর কর্ণেলকে কেউ চিঠি লেখে না, বা সরল এরেন্দিরার অনুবাদ যখন মানববাবু করছেন, তখনও বাংলায় গার্সিয়া মার্কেজ অনুদিত হননি। পরে যে গার্সিয়া মার্কেজ ও লাতিন আমেরিকান সাহিত্য অনুবাদের ঢল নামবে বাংলা সাহিত্যে, তার ভগীরথ নিঃসন্দেহে মানববাবু। শুধু গার্সিয়া মার্কেজই নন। হুয়ান রুলফো বা আলেহো কার্পেন্তিয়েরের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব মানববাবুরই। আলেহো কার্পেন্তিয়েরের রচনা সংকলনটির কথাই ভাবা যাক। এই বইটিতে মানববাবু কার্পেন্তিয়েরের দুটি উপন্যাস – এই মর্তের রাজত্ব ও মৃগয়া এবং ছটি গল্পের অনুবাদ করেছেন। আর তার পরেই এসেছে তাঁর একটি অসামান্য প্রবন্ধ – কুহকী বাস্তবতা, বাস্তবের কুহক ও আলেহো কার্পেন্তিয়ের। একইভাবে উল্লেখ করা যায় হুয়ান রুলফোর কথাসমগ্র বইটির কথা। লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের এই বিস্ময়কর প্রতিভা কেবল একটি উপন্যাস ও কয়েকটি ছোটগল্প লিখেছিলেন। পেদ্রো পারামো নামে উপন্যাসটিকে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মনে করা হয়। মানববাবু যখন এর অনুবাদ করলেন, তখনও এই কথাকার আমাদের এখানে প্রায় অপরিচিত। এই বইয়ের শেষে তাঁর লেখা “হুয়ান রুলফোর স্থানুজগৎ” নামে যে অনবদ্য প্রবন্ধটি রয়েছে, তা বাঙালি পাঠকের জন্য রুলফো প্রবেশক হিসেবে অনবদ্য। এইভাবে অচেনাকে চিনিয়ে দেওয়ার কাজ মানববাবু সারা জীবন ধরে করে গেছেন।
     

    আমরা আপাতত চলে আসি “এই স্বপ্ন এই গন্তব্য” নামে প্রকাশিত লাতিন আমেরিকান কবিতার অসামান্য সংকলনটির দিকে। এখানে আরহেনতিনার (যাকে আমরা জানি আর্জেন্টিনা উচ্চারণে) এল সালভাদোর, কুবা (কিউবা), গুয়াতেমালা, চিলে, নিকারাগুয়া, পেরু, মেহিকো, হাইতির বিশিষ্ট কবিদের প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতাগুলি এক জায়গায় রয়েছে। সেইসঙ্গে রয়েছে লাতিন আমেরিকার কবিতা জগতে প্রবেশের একটি বিস্তৃত মহামূল্যবান প্রাককথন। “লাতিন আমেরিকান বিদ্রোহী কবিতা : পটভূমি ও লক্ষ্য” নামের এই অসামান্য প্রবন্ধটির সঙ্গেই আমরা স্মরণ করতে পারি ব্রাজিলের দুই বিশিষ্ট কবি এডওয়ার্ড কামাউ ব্রাফেট ও ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা সংকলনের ভূমিকা হিসেবে লেখা “স্তব্ধতার সংস্কৃতি” নামক প্রবন্ধটির কথা।

     

     

    এই সমস্ত অনুবাদ ও প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের দেখাতে থাকেন লাতিন আমেরিকার রক্তাক্ত ইতিহাস ও তার থেকে নতুন এক লাতিন আমেরিকাকে গড়ে তোলার স্বপ্ন কীভাবে সেখানকার সাহিত্যে ভাষা পাচ্ছে। ভারতে বাণিজ্য করতে আসার স্বপ্নে মশগুল ক্রিস্টোফার কলম্বাস পঞ্চদশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে পর্তুগাল থেকে বাণিজ্যতরী নিয়ে বেরিয়ে শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও দক্ষিণ আমেরিকায়। এরপর স্পেন ও পর্তুগালের তরফে বেশ কিছু অভিযান চলে গোটা দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জগুলিতে। মায়া, আজটেক ও ইনকা সভ্যতার অতীতকে প্রায় সম্পূর্ণ মুছে ফেলে লুটেরা কনকিস্তাদাররা। লক্ষ লক্ষ অধিবাসীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর ফলে ঔপনিবেশিক শাসন এক নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়। খনি থেকে সোনা, রূপো সমেত নানা সম্পদ আহরণ করাই হোক, বা চাষবাস সহ হরেক শ্রমসাধ্য কাজ করাই হোক – তার জন্য লোকের অভাব দেখা যায়। সেই অভাব পূরণ করতে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা হয় হাজারে হাজারে মানুষকে। তাদের ক্রীতদাস হিসেবে লাগিয়ে দেওয়া হয় নানা কঠোর পরিশ্রমের কাজে, চলে অমানুষিক অত্যাচার। গোটা স্প্যানিশ আমেরিকা বা পোর্তুগিজ শাসিত ব্রাজিলের এই শোষণের পর আসে স্বাধীনতা। এবং তারপরে আবার নয়া উপনিবেশের জমানা। এই প্রেক্ষাপটে লাতিন আমেরিকার বিদ্রোহী কবি কথাকারেরা ইউরোপীয় আখ্যান জগৎ থেকে সচেতনভাবে স্বতন্ত্র হতে চেয়েছেন। সেটা রচনার বিষয় ও প্রকৃতি উভয় দিক থেকেই। তাঁদের লেখায় রয়েছে এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিকতা, যা তাদের লেখার বিষয়বস্তু ও রীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁরা, লাতিন আমেরিকার ইতিহাস জুড়ে যে শোষণ চলেছে ঔপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক যুগে, তাকে ও তার প্রতিক্রিয়াকে নানাভাবে ধারণ করতে চান তাঁদের গল্প উপন্যাসে। যেমন, যে লাতিন আমেরিকান কথাকার প্রথম নোবেল পুরস্কার পাবেন, সেই আস্তুরিয়াসের ‘ব্যানানা ট্রিলজি’। নয়া ঔপনিবেশিক জমানায় আমেরিকান ফ্রুট কোম্পানি লাতিন আমেরিকার বিরাট পরিমাণ জমিই শুধু নিজেদের হস্তগত করেনি, বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে। শ্রম শোষণ ও সম্পদ শোষণের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকেও তারা নিয়ন্ত্রণ করেছে প্রবলভাবে ও এইসূত্রেই জন্ম নিয়েছে ব্যানানা রিপাবলিক নামের এক নতুন রাজনৈতিক অভিধা। সম্পদের লুঠতরাজ, শ্রম শোষণ, স্বৈরতন্ত্র এবং সে সবের প্রতিক্রিয়াজাত দ্রোহ রাজনীতির ব্যাপারটি লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে কীভাবে উঠে আসছে অনুবাদ ও প্রবন্ধের মাধ্যমে বাঙালি পাঠককে তার সাথে নিরন্তর পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মানববাবু। তাকাতে শিখিয়েছেন ইউরোপ আমেরিকার বাইরের সাহিত্যের দিকে। লাতিন আমেরিকার সাহিত্য, আফ্রিকার সাহিত্য, পূর্ব ইউরোপের সাহিত্যকে আমরা যতটা চিনেছি আজ, তার অনেকটাই অবদান অধ্যাপক অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

    ---------------------------------------------------------------------------------------------------------------- 

    লেখক সাহিত্যের শিক্ষক

     


    সৌভিক ঘোষাল - এর অন্যান্য লেখা


    চলে গেলেন তুলনামূলক সাহিত্যের অসামান্য অধ্যাপক, অনন্য অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

    সাহিত্যের বিশ্বপথিক মানবেন্দ্র-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested